মুক্তিযুদ্ধ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা আলোচনা কর।
তৎকালীন পরাশক্তির মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নই বাঙালি গণহত্যাকে প্রথমে নিন্দা জানায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ভারত তথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা রেখেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সােভিয়েত ইউনিয়নের নীতি সব সময় একই গতিতে প্রবাহিত হয়নি। সময় ও বাস্তবতার সাথে সাথে বিভিন্ন সময় সোভিয়েত নীতিতে নানা পরিবর্তন। লক্ষ করা যায়। মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত নীতির তিনটি পর্যায় ছিল।
সােভিয়েত নীতির প্রথম পর্যায় (মার্চ-জুন):
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত নীতির প্রথম পর্যায়ে সতর্কতা লক্ষ্য করা যায়। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ কমিউনিস্ট পার্টির ২৪তম কংগ্রেসে ব্রেজনেভ ভাষণে 'পূর্ব বাংলার' জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমাধানে পৌছার কথা উল্লেখ করেন। প্রেসিডেন্ট পদগর্নি ২ এপ্রিল ইয়াহিয়াকে পাঠানাে একটি পত্রে জরুরি ভিত্তিতে রক্তপাত ও নির্যাতন বন্ধ করে শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করার জন্য পাকিস্তানকে আহ্বান জানান। ৬-১০ জুন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরন সিং রাশিয়া সফর করে রাশিয়াকে বাংলাদেশ ইস্যুতে আরােও সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান। যদিও এ পর্যায়ে রুশ নীতি শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের পক্ষে আবর্তিত হয়। জুন মাস পর্যন্ত রুশ নীতি এ ধারায়। চলে।
সােভিয়েত নীতির দ্বিতীয় পর্যায় (জুলাই-নভেম্বর) :
জুলাই মাসের ৯-১০ তারিখে হেনরি কিসিঞ্জারের পাকিস্তান হয়ে চীন সফর করার পরই উপমহাদেশে কূটনেতিক বিপ্লব ঘটে। তিনি পিকিং থেকে ফিরেই ঘোষণা করেন ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করলে চীন হস্তক্ষেপ করবে এবং আমেরিকা ভারতের সাহায্যে নাও এগিয়ে আসতে পারে। এর ফলে ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের পারস্পরিক নিরাপত্তার অভাববোধ থেকে ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট স্বাক্ষরিত হয় "রুশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি"। এ চুক্তি পাকিস্তানকে নৈতিকভাবে দুর্বল করে। রাশিয়া এতাে দিন বিবৃতি ও পত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণহত্যার নিন্দা, শান্তিপর্ণ উপায় সমস্যা সমাধানের যে নীতিতে ছিল সে অবস্থান থেকে সরে এসে ভারতের পক্ষে সক্রিয় নীতির দিকে অগ্রসর হয়। পরের মাসে র্থাৎ ২৭-২৯ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মস্কো সফরের পর রুশ নীতির এ অবস্থান আরাে দৃঢ় হয়। সােভিয়েত নীতির দ্বিতীয় পর্যায়ে একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বাঙালি বিরোধী যে কোনাে আন্তর্জাতিক সমাধানের বিরুদ্ধে ভারতের সঙ্গে সােভিয়েত ইউনিয়নও তৎপর হয়ে ওঠে।
সােভিয়েত নীতির শেষ পর্যায় (৩ ডিসেম্বর- স্বাধীনতা পর্যন্ত) :
পাকিস্তান ন্যায়সঙ্গ শান্তিপূর্ণভাবে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হওয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে। ৩ ডিসেম্বর চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হলে সােভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধের জন্য সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন তার সীমান্ত রক্ষা ও জাতীয় স্বার্থে নিস্ক্রিয় থাকবে না বলেও হুমকি দেয়। যদিও জাতিসংঘ ও জাতিসংঘের বাইরে ভারতকে কূটনৈতিক ও নৈতিক সমর্থন দিলেও সে সময় রাশিয়া একটি বড় ধরনের যুদ্ধে জড়াতে চায়নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন এই পর্যায়ও বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছে অনুযায়ী নির্বাচিত প্রতিনিধির (আওয়ামী লীগ) কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরকে প্রাধান্য দেয়। পাকিনস্তান এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। যুদ্ধ ভয়াবহ রূপ নিলে সােভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধবিরতি বিলম্বিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে- যেন ভারতীয় বাহিনী সামরিক বিজয়ের প্রয়ােজনীয় সময় ও সুযোগ পায়। নিরাপত্তা পরিষদের পরিবর্তে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ৭ ডিসেম্বর একটি যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব উত্থাপিত হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তৃতীয়বারের মতো ভেটো প্রয়ােগ করে। ভারতীয় বাহিনী ঢাকা দখল করার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত যে কোনো প্রকারে যুদ্ধবিরতি পদক্ষেপকে বানচাল করাই ছিল এ ভেটো দানের উদ্দেশ্য। আর তাই ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করার পর নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর ভেটো প্রয়োগ না করায় শেষ পর্যন্ত ২১ ডিসেম্বর যুদ্ধবিরত প্রস্তাব গৃহীত হয়।
এভাবে দেখা যায়, রুশ নীতি আগাগোড়া মধ্যপন্থী হলেও মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে সােভিয়েত ইউনিয়ন কৌশলগত কারণে বাংলাদেশপন্থী নীতি গ্রহণ করে। তবে মুক্তিযুদ্ধে ন মাস গণহত্যার বিরুদ্ধে ও বাঙালির ন্যায়সঙ্গত দাবির স্বপক্ষে ভূমিকা রাখে।