প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও ফলাফল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর।


প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগের সময়কে বলা হয়ে থাকে সশস্ত্র শাস্তির যুগ। কারণ এই সময় প্রায় প্রতিটি ইউরোপীয় রাষ্ট্র নানাভাবে তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। উপরে বর্ণিত বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীর আকার বৃদ্ধির আলেখ্য থেকে দৃষ্টিগোচর হয় যুদ্ধ না হলেও কোনো দেশ নিশ্চুপ বসে থাকেনি। তারা আইন করে নির্দিষ্ট বয়সের মানুষকে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য করে। এক্ষেত্রে বিশেষ যুদ্ধের প্রস্তুতির ভাব অনেকটাই স্পষ্ট। এসময় বিভিন্ন শক্তিশালী দেশের দখলে থাকা অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রগুলো যেমন স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। তেমনি শক্তিশালী দেশগুলোর সন্দেহ, পরস্পর বিশ্বাসহীনতা, ভয়-ভীতি আর স্বার্থপর তৎপরতা বাড়িয়ে তোলে তাদের সম্পর্কের শীতলতা। ১৯ শতকের একেবারে গোড়া থেকে এক দশক নানা কারণে দুটি জোটে বিভক্ত হয়ে যায় পুরো ইউরোপ। এর সাথে যুক্ত হয় পুরো বিশ্বে তাদের সাথে। সম্পর্কিত দেশগুলোও। আর সাথে জড়িত কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-


১. জাতীয়তাবাদ: ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকে যে উগ্র ফরাসি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছিল তা অনেকাংশে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকেও প্রণোদিত করে। বলতে গেলে এর মধ্যদিয়েই অনেক ইউরোপের দেশ স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। ১৮১৫ সালের ভিয়েনা কংগ্রেস বাস্তবে রূপায়িত হয়নি। তবে ১৮৪৮ সালের পর থেকে শুরু করে ১৮৭০- এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ অর্জন করে তাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। এর মধ্যে ইতালি, জার্মানি, গ্রিস, সার্বিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রের কথা বলা যেতেই পারে। পাশাপাশি তাদের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আরো অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশ চেষ্টা করতে থাকে স্বাধীন হওয়ার। এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে হঠাৎ জাগ্রত হওয়া জাতীয়তাবাদ পুরো ইউরোপকে ঠেলে দেয় এক ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্যে।


২. জাতিগত দ্বন্দ্ব: ইউরোপের বাইরে উপনিবেশ স্থাপন নিয়ে স্থানীয় পরিসর এবং নানা উপনিবেশে বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রতিনিয়ত সংঘাত চলে আসছিল। এরই মধ্যে ঘটে যায় বিখ্যাত সিডানের যুদ্ধ। যুদ্ধের পর ১৮৭১ সালে জার্মানি ফ্রান্সের থেকে লরেন ও আলসেস কেড়ে নেয়। এ দুই এলাকার মানুষ দীর্ঘদিন ফ্রান্সের অধীনে থাকায় নিজেদের ফ্রান্সের অধিবাসী বলে মনে করার পরেও নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে দখল করা হয় স্থান দুটি। অন্যদিকে জার্মান জাতির অংশ ও নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতেও তারা জার্মান এই দাবিও তোলা হয় তখন। এ থেকে ফ্রান্স ও জার্মানির সংঘাত শুরু হয়। পাশাপাশি এমনি নানা অসম্ভব বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে ১৮৭০ সালের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয় ঐক্যবদ্ধ ইতালি। ঐক্যবদ্ধ ইতালির সাথে ট্রেনটিনো ও ট্রিয়েস্টের সংযুক্তীকরণ নিয়ে একটি যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। এ অঞ্চল অস্ট্রিয়ার দখলে থাকায় তাদের বিরুদ্ধে ইতালির অভিযান হয়ে যায় অবশ্যম্ভাবী। পাশাপাশি বলকান অঞ্চলে জাতিগত দাঙ্গা আরো চাঙ্গা হলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়।


৩. উপনিবেশ বৃদ্ধি: ইউরোপের নানা দেশে শিল্প বিপ্লবের পর নানা ধরনের শিল্পজাত পণ্যের উৎপাদন বহুলাংশে বেড়ে যায়। এই বাড়তি পণ্যের বিপনন ও বাজারজাতকরণ নিয়ে ঝামেলায় পড়ে দেশগুলো। তখন নতুন ভূখণ্ড দখলের অন্যরকম এক তাগিদ লক্ষ করা যায় তাদের মধ্যে। তাদের এই দখলবাজির প্রবণতাও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সৃষ্টির জন্য অনেকাংশে দায়ী।


৪. অর্থনৈতিক ও সাম্রাজ্যবাদ: ইউরোপে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল চোখে পড়ার মত। অর্থনৈতিক দৈন্য তাদের বিশ্বের নানাদেশে উপনিবেশ স্থাপনে প্রণোদিত করে। এ নিয়েও ইউরোপের নানা দেশের মধ্যে চলত ক্রমাগত সংঘাত। বিশ্বের নানা স্থানে তাদের পণ্যবাজার সৃষ্টি নিয়ে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয় এ থেকে প্রতিষ্ঠা লাভ করে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত। এই সংঘাত একদিন অনেক বড় আকার ধারণ করে রূপ নেয় বিশ্বযুদ্ধের। এক্ষেত্রে বিশেষ করে অস্ট্রো-হাঙ্গেরি ও রাশিয়ার অর্থনৈতিক দ্বন্দের কথা বলা যেতে পারে সবার আগে। পাশাপাশি ব্রিটেন অধিকৃত অঞ্চলের দিকে জার্মানির দৃষ্টি গেলে একটি যুদ্ধ হয়ে পড়ে অনিবার্য। আর সবদিক থেকে বিশ্লেষণ করলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল অর্থনৈতিক।


৫. সামরিক শক্তি বৃদ্ধি: বিশ্বের নানাস্থানে বাজার সৃষ্টি ও বিভিন্ন দেশের সাথে অহেতুক প্রতিযোগিতা বহুগুণে বৃদ্ধি করে প্রতিটি দেশের সামরিক বাহিনীর আকার। বর্ধিত সেনাবাহিনীর ভরণপোষণের জন্য যে অতিরিক্ত অর্থ প্রয়োজন অনেক দেশের পক্ষে এ সংস্থানও সম্ভব ছিল না। তাই যুদ্ধ আর দখলবাজিতে মেতে উঠতে হয় তাদের অস্তিত্বের প্রয়োজনেই। তাদের ধারণা ছিল বিভিন্ন দেশের সাথে যুদ্ধে জিততে পারলে তাদের শক্তিমত্তা যেমন বাড়বে তেমনি বিশাল সৈন্যদলের দায়ভারও বইতে হবে না তাদের।


৬. ইতালি ও জার্মানির একত্রীকরণ: ইউরোপের দুটি বিশাল ভূখণ্ড হিসেবে ইতালি ও জার্মানির কথা বলা যেতে পারে যারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে বিভক্ত থাকায় কোনোদিন নিজেদের অবস্থান জানান দিতে পারেনি। বিসমার্ক কিংবা গ্যারিবন্ডি আর কাউন্ট কান্ডুরের মত নেতার কৌশলে একত্রিত হয় জার্মানি ও ইতালি। তারপর থেকে তারা নিজেদের অধিকার প্রসঙ্গে বেশ সোচ্চার থাকেন। এতে করে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর আঁতে ঘা লাগে। তারা বুঝতে শুরু করে ধীরে ধীরে ইতালি কিংবা জার্মানির শক্তিবৃদ্ধি তাদের জন্য আখেরে মঙ্গল বয়ে আনবে না। আর শেষ পর্যন্ত ইতালি আর জার্মানির বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধটা লেগেই যায়।


৭. দুর্দমনীয় জার্মানি: বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড হিসেবে ইউরোপের নানা শক্তির হাতে নিষ্পেষিত ছিল জার্মানি। তারা ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর বিসমার্কের নেতৃত্বে অনেক শক্তিশালী অবস্থানে চলে যায়। একসময় যেসব দেশ তাদের দখল করে রেখেছিল এক্ষেত্রে তাদের শক্তিমত্তা ওই দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যায়। এদিকে দীর্ঘদিন শোষিত জার্মানির মধ্যে তখন কাজ করছে তীব্র প্রতিশোধস্পৃহা। বিসমার্কের হাত ধরে যে নতুন ঐক্যবদ্ধ জার্মানি আত্মপ্রকাশ করেছিল তা কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ামের সময় এসে ইউরোপের দুর্দমনীয় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। ইউরোপের অন্য দেশগুলোর সেনাসংখ্যা বৃদ্ধি ও সামরিক প্রস্তুতি দেখে তারাও থেমে থাকেনি। একটি পর্যায়ে সবগুলো শক্তিকে একই সাথে চ্যালেঞ্জ করে তারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন করে তোলে। বিশেষ করে কাইজার দ্বিতীয় ইউলিয়াম বিসমার্কের নীতি ত্যাগ করেন। তিনি মনে করেন ঐক্যবদ্ধ জার্মানিই সবকিছু নয়। আর এতে করে তিনি জার্মানি, অস্ট্রো-হাঙ্গেরি বলকান রাষ্ট্রগুলোর পাশাপাশি তুরস্ক পর্যন্ত নিজ দখলে নিয়ে গঠন করতে চেয়েছেন নিজস্ব এক বিস্তৃত সাম্রাজ্য। আর এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার চিন্তাই তাকে এতটা আগ্রাসী করে তোলে যা আসন্ন করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।


৮. অস্ট্রিয়ায় রদবদল: অস্ট্রো-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যে দ্বৈত রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৮৬৭ সালের দিকে হ্যাপসবুর্গরা তাদের শাসন নীতি পরিবর্তন করে। শাসন ক্ষমতায় জার্মান আভিজাত্যের প্রাধান্য খর্ব করা নিয়ে এসময় দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। বিশেষ করে একইসাথে জার্মান ও অস্ট্রিয়া দুই দেশের অভিজাতদের মানিয়ে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা বেশ কঠিন হয়ে যায়। অস্ট্রিয়ার রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের গৃহীত নানা উদ্যোগ হিসেবে সেখানে জার্মানদের প্রভাব ক্ষুত্বের চেষ্টা করা হয়। বিভিন্নভাবে দেশের অভ্যন্তরে নিয়ে আসার চেষ্টা করে স্লাভদের। এভাবে ক্রমাগত স্নাভ অভিবাসন তাদের অভ্যন্তরীণ সংকটকে আরো বড় করে।


৯. দখলবাজ মনোভাব: ইউরোপে নানা দেশের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি হেতু তারা পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধ হারিয়ে ফেলে। বিশেষ করে প্রতিটি দেশ এবার চেষ্টা করে সীমাবদ্ধ সুযোগের মধ্যে থেকে যতটুকু পারা যায় নিজ রাজ্য পরিসীমা বাড়িয়ে নেয়া। বিশেষ করে ফ্রান্স ও ব্রিটিশদের নৌপথে যে দীর্ঘদিনের সংঘাত তা আরো বড় আকারে হতে পারত। কিন্তু এবার সময়ের চাহিদায় যুদ্ধের প্রকৃতি বদলে যায়। উপনিবেশ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী জার্মানি এবং ইতালি নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে হাজির হয়।


১০. চুক্তি ও জোট গঠন: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার বেশ আগে থেকেই ইউরোপের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে একটি। নতুন ধারা সৃষ্টি হয়। এসময় নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন দেশ পরস্পরের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এই চুক্তি তাদের শক্তিমত্তার পাশাপাশি যুদ্ধবাজ প্রবণতাও বাড়িয়ে তোলে বহুলাংশে। এতে করে দেখা গেছে অনেক দুর্বল অর্থনীতির দেশও অহেতুক ক্ষমতা প্রদর্শনের ইচ্ছায় বিশাল সেনা সমাবেশ করে বসে। আর ওই সেনা সমাবেশ তাদের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে।


১১. অমীমাংসিত বিরোধ: ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের শত্রুতা কাজ করছিল। ঐতিহাসিকভাবে পরস্পরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ দিনে দিনে আরো ভয়াবহ রূপ লাভ করে। এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকেই একটি যুদ্ধ আসন্ন হয়ে পড়ে। ভূমি দখল, শক্তি প্রয়োগ আর যুদ্ধবাজ প্রবণতা এই দেশগুলোর সম্পর্কহানির মূল কারণ।


১২. শাসনগত জটিলতা: রাজতান্ত্রিক শাসনের ক্রমবিস্তার ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জনগণের অধিকার বিপন্ন করেছিল।

অরাজক পরিস্থিতিতে রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য জনগণকে কোনো একটা কাজে ব্যস্ত রাখাটা তখনকার প্রশাসনের জন্য বেশ জরুরি ছিল। দেশে শিক্ষা, চিকিৎসা আর কর্মসংস্থানের অভাব যখন চরমে তখন শাসকগোষ্ঠী নিজেদের পিঠ বাঁচাতে আগ্রহ দেখিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এতে অন্তত কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হয়। অতিরিক্ত সেনাসদস্য নিয়োগ শাসকদের একটি সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করে। এদিকে সামরিক দিক থেকে বলবান কিন্তু শাসনান্ত্রিক কাঠামোয় জট পাকিয়ে ফেলেছে এমন রাষ্ট্রগুলোর শাসকরা নিজের ক্ষমতা সংহত করতেই পা বাড়ায় ভয়াবহ এ যুদ্ধের দিকে।


১৩. দ্রুত যুদ্ধ শেষের প্রচারণা: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই এর প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির আপাত হিসাব দেখে অনেক সচেতন ও বিবেকবান মানুষ এর থেকে পিছিয়ে আসতে শুরু করেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ তখন প্রচার চালায় যুদ্ধ শুরু হলে তাদের জয়লাভ সময়ের ব্যাপার। আর এক্ষেত্রে প্রত্যেক পক্ষই দাবি করে খুব দ্রুত যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার। আর তারপর জনগণকে নানা সুবিধার প্রতিশ্রুতি পর্যন্ত দেয়া হয়। এই প্রচারণাও অনেক দিক থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে প্রণোদিত করে।


১৪. সিলাইফেনের ভূমিকা: প্রখ্যাত জার্মান সেনানায়কের নাম আলফ্রেড গ্রাফ ফন সিলাইফেন। তিনি বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মানিকে প্ররোচিত করেন। বিশেষ করে তিনি ১৯০৫ সালের দিকে অবসর গ্রহণের পূর্বে জার্মানির উন্নয়নে কিছু প্রস্তাবনা পেশ করে যান। এক্ষেত্রে ১৯০৪ সালে রুশ-জাপান যুদ্ধে রাশিয়া হার মানলে তার প্রস্তাবনা বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যা প্ররোচিত করে অন্যসব যুদ্ধবাজ জার্মান সেনানায়ককে। প্রাথমিকভাবে অনেক দুঃসাহসী এ পরিকল্পনাও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য অনেকাংশে দায়ী।


১৫. ভিয়েনা কংগ্রেস: ফ্রান্স আধুনিক ইউরোপের ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফরাসি বিপ্লব যেমন ইউরোপের রাজনৈতিক ইতিহাস ও মানচিত্র বদলে দিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছিল। তেমনি ওয়াটারলুর যুদ্ধে নেপোলিয়নের পরাজয় ইউরোপের ইতিহাসকে প্রবাহিত করে ভিন্ন খাতে। যুদ্ধজয়ী ব্রিটেন, প্রুশিয়া, রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া এ সম্মেলনের আয়োজক ছিলো। এক্ষেত্রে অস্ট্রিয়ার মন্ত্রী মেটারনিক পুরো ইউরোপকে জোর করে ঠেলে ফরাসি বিপ্লব- পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার প্রস্তাবনা পেশ করে। এ প্রস্তাবনাও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর জন্য অনেকাংশে দায়ী।


১৬. ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়া যুদ্ধ: ১৮৭০-৭১ সালের দিকে অনুষ্ঠিত ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়া যুদ্ধ ইউরোপের শক্তিসাম্য নষ্ট করে। নিকট ভবিষ্যতে এ ভারসাম্যহীনতা বিভিন্ন শক্তিশালী দেশকে নিপীড়নকারী ও ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করে। শেষ পর্যন্ত এই শক্তিসাম্য নষ্টের ঘটনা অনেক দিক থেকে বিশ্বযুদ্ধকে প্রণোদিত করেছে।


১৭. বিসমার্কের দূরদর্শী পররাষ্ট্রনীতি: কুশলী নেতা ও সমরনায়ক অটো ফন বিসমার্কের নেতৃত্বে পতনোন্মুখ জার্মানি ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করে। তারা অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরির সাথে জোট গঠন করে শক্তিমত্তা আরো বাড়িয়ে তোলে। পাশাপাশি রশিয়ার সাথে সফল কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারায় জার্মানির শক্তিমত্তা বেড়ে যায়। তিনি ফ্রান্স ছাড়া ইউরোপের প্রায় সব রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন। এজন্যই হয়ত ফ্রান্স জার্মানির প্রতি বিরূপ অবস্থান দেখিয়ে আসছে দীর্ঘদিন। এ দ্বিপক্ষীয় চুক্তির দুর্বলতা ও জার্মানির দ্রুত শক্তিবৃদ্ধির হেতু একটাই, যুদ্ধ জড়িয়ে পড়া।


১৮. কাইজার দ্বিতীয় উইলহেম: একমাত্র ফ্রান্স ছাড়া ইউরোপের প্রায় সবগুলো দেশের সাথে চুক্তি করেছিলেন বিসমার্ক। তিনি জানতেন চুক্তি করে নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধি না করে অহেতুক যুদ্ধে জড়ালে শিশু জার্মানির পক্ষে তখনকার ইউরোপে টিকে থাকা সম্ভব হবে না। তবে কাইজার দ্বিতীয় ইউলহেম ক্ষমতায় বসলে তার অদূরদর্শিতা বিসমার্ককে ত্যক্ত বিরক্ত করে। তিনি ১৮৯০ সালে পদত্যাগ করলে কাইজার দ্বিতীয় উইলহেম আরো অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন। তিনি সাগরে ইংরেজ বাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার মত আরেকটি শক্তিশালী নৌ-বাহিনী গড়ে তোলেন। নৌবাহিনীর দিক থেকে জার্মানির এমন শক্তিশালী অবস্থানে চলে যাওয়া ১৯০৪ সালের দিকে অ্যাংলো-ফরাসি জোট গঠনে বাধ্য করে। এরপর জোট আরো শক্তিশালী করে তুলতে ১৯০৭ সালে তারা রাশিয়াকে নিজেদের সাথে যুক্ত করে।


১৯. জার্মান-ইংরেজ নৌবহর: কাইজার দ্বিতীয় উইলহেমের উত্থানের আগে সাগরে অপ্রতিরোধ্যভাবে রাজত্ব করত ইংরেজ নৌবাহিনী। তারা পর পর বেশ কয়েকটি নৌযুদ্ধে জয়লাভের মধ্য দিয়ে পুরোপুরি সাগরের ত্রাস হিসেবে আবির্ভূত হয়। ঠিক এমনি পরিস্থিতি কাইজারের পক্ষ থেকে জার্মান নৌবাহিনী গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন গ্রান্ড অ্যাডমিরাল অ্যালফ্রেড ফন টার্পিজ। ১৮৯৮-১৯১২ সালের মধ্যে তাঁর প্রচেষ্টায় জার্মান নৌবাহিনী ইংরেজদের সাথে সমান তালে পাল্লা দিয়ে লড়ার ক্ষমতা অর্জন করে। এদিকে ফার্স্ট সি লর্ড জ্যাকি ফিশার নতুন করে ঢেলে সাজান ইংরেজ নৌবাহিনীকে। দুই দেশের

নৌবাহিনীর শক্তিমত্তা বৃদ্ধি নতুন করে আরেকটি সংঘাতে জড়াতে প্রণোদিত করে যাকে প্রথম মহাযুদ্ধের অন্যতম পরোক্ষ কারণ হিসেবে ধরা যেতে পারে।


২০. ক্রমবর্ধমান সামরিকবাদ: ১৯০৪ সালের পর ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশ সেনাবাহিনীর আকার বৃদ্ধি করে। এ বর্ধিত সেনাবাহিনী তাদের কৃতকর্মের জন্য কোনো নির্বাচিত সরকার নয় বরং দায়ী থাকতো সম্রাটের কাছে। বেশিরভাগ যুদ্ধবাজ সম্রাট চাইতেন যেভাবেই হোক শান্তিতে-অশান্তিতে তার রাজ্যসীমা কিঞ্চিত হলেও বৃদ্ধি পাক। এ নীতি বুঝতে পেরে সামরিক বাহিনীর প্রধানরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তাদের অহেতুক যুদ্ধবাজ নীতিও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচ্য।

Previous Post