বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও আমেরিকার ভূমিকা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা আলোচনা কর
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল খুবই হতাশাব্যঞ্জক ও বিতর্কিত । মার্কিন সরকারী নীতি পাকিস্তানপন্থী হলেও কংগ্রেস এবং সিনেটের বিপুল সংখ্যক সদস্য, সরকারি কতিপয় আমলা ও বুদ্ধিজীবী মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন।
মার্কিন গণমাধ্যম, জনমতও ছিল বাংলাদেশের প্রতি সহানুভৃতিশীল। তবে তৎকালীন নিক্সন, রোজার্স ও ড. কিসিঞ্জার প্রশাসন পুরো ন'মাস পাকিস্তানের জন্য নৈতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সমর্থন যুগিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন নীতর চারটি পর্যায় ছিল।
মার্কিন নীতির প্রথম পর্যায় (মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত) :
এ পর্যায়ে মার্কিন নীতির প্রকৃতি ছিল কৌশলগত নিরপেক্ষতা। এ সময় মার্কিন সরকার বাংলাদেশ সমস্যাকে পাকিস্তানের 'অভ্যন্তরীণ ব্যাপার' হিসেবে অভিহিত করে। কিন্তু ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কীটিং ওয়াশিংটনের এই দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করে ১৫ এপ্রিল বলেন,
পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা কোনোভাবেই অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হতে পারে না এবং অভ্যন্তরীণ ব্যাপারের অজুহাতে সারা বিশ্ব দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখতে পারে না।
পত্র-পত্রিকার প্রতিবাদ ও প্রবল জনমতের চাপে ৭ মে ওয়াশিংটন পাকিস্তানের জন্য সমরাস্ত্র সরবরাহ ও আর্থিক সাহায্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে । এছাড়া ১২ জুন ১৯৭১ নিক্সন প্রশাসন পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানান। তবে অস্ত্র সাহায্য বন্ধ থাকলেও প্রচুর মার্কিন অস্ত্র পাকিস্তানে যাচ্ছে বলে পত্র-পত্রিকায় সমালােচনা শুরু হলে পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বলা হয় যে,
অস্ত্রগুলো সরবরাহের জন্য ২৫ মার্চের আগেই চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছিল ।
জুনের শেষ নাগাদ মার্কিন সরকার পাকিস্তানের মিলিয়ন ডলারের দুটি চুক্তি করে যে অর্থ বাঙালি হত্যাযজ্ঞে ব্যবহৃত হয়। তবে পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানো সত্ত্বেও ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের জন্য এসময় যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সাহায্য পাঠানো অব্যাহত রাখে। মে মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ভারতর শরণার্থীদের জন্য ৩০ লক্ষ মার্কিন ডলার সাহায্য দেয়। অবশ্য এর উদ্দেশ্য ছিল হােয়াইট হাউস বিরোধী সমালােচনার তীব্রতা কমিয়ে অনা এবং সাহায্য অব্যাহত রেখে রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করা।
মার্কিন নীতির দ্বিতীয় পর্যায় (জুলাই থেকে আগস্ট ১৯৭১ পর্যন্ত) :
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন নীতির দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় জুলাই মাসে । এ পর্যায়ে মার্কিন নীতির দুটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়।
- রাশিয়াকে প্রতিরোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে স্বীকৃতি এবং জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের প্রতিশ্রুতি দেয়। এ উদ্দেশ্যে হেনরি কিসিঞ্জারের হঠাৎ করে বেইজিং সফরের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তান ঘেঁষা নীতি সক্রিয় হয়ে ওঠ
- যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা হয়েছিল যে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে জুলাই মাসে "রুশ-ভারত পরিকল্পনা" চূড়ান্ত করা হবে। তাই এ পরিকল্পনা মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র তৎপর হয় । দ্বিতীয় পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ছিল অখন্ড পাকিস্তানের অধীনে একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করা এবং যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া। কিন্তু কোনোটিই সম্ভব হয়নি। কাজেই দ্বিতীয় পর্যায়েও মার্কিন নীতি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়।
মার্কিন নীতির তৃতীয় পর্যায় (সেপ্টেম্বর -৩ ডিসেম্বর ১৯৭১) :
এ পর্যায়ে নিক্সন প্রশাসন আরো বেশি পাকিস্তানপন্থী নীতি অবলম্বন করে। কলকাতায় অবস্থানকারী বাঙালি নেতৃবৃন্দের একাংশের সঙ্গে (খন্দকার মুশতাক আহমেদপন্থী) সমঝোতার চেষ্টা করে। এ ছাড়াও পাকিস্তান সরকারকে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের জন্য চাপ দেয়। যদিও মুজিবনগর ও ভারত উভয় সরকার মার্কিন এ উদ্যোগ প্রত্যাখ্যান করে। এমনকি ৫-৮ নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ওয়াশিংটন সফরকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানপন্থী নীতি থেকে সরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন। ফলে একটি যুদ্ধ যে অনিবার্য তা পরিষ্কার হয়ে যায়
মার্কিন নীতির চতুর্থত পর্যায় (ডিসেম্বর ১৯৭১) :
৩ ডিসেম্বর "পাক-ভারত যুদ্ধ" শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রচণ্ড ভারত বিরোধী ও পাকিস্তান ঘেঁষা নীতি অনুসরণ করতে থাকে। পাকিস্তানকে যাবতীয় নৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দানের জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সন হেনরি কিসিঞ্জারকে নির্দেশ দেন। নিক্সনের এ নীতিকে "Tilt Policy" নামে অভিহিত করা হয়েছে। ৬ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ভারতের জন্য ৮৬.৬ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সাহায্য সাময়িকভাবে বন্ধ ঘাষণা করে। অপরদিকে জাতিসংঘের মাধ্যমে কূটনৈতিক চাপ প্রয়ােগও অব্যাহত থাকে। উল্লেখ্য, ৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘে মার্কিন স্থায়ী প্রতিনিধি জর্জ বুশ ভারতকে প্রথম আক্রমণকারী বলে উল্লেখ করেন। ৭ ডিসেম্বর হোয়াইট হাউসে সাংবাদিক সম্মেলনে কিসিঞ্জারও ভারতকে আক্রমণকারী ও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিযুক্ত করেন। দিল্লি ও মস্কোর ওপর চাপ প্রয়ােগ করতে যুক্তরাষ্ট্র "এন্টারপ্রাইজ" নামে পারমানবিক জাহাজের নেতৃত্বে ৮টি জাহাজের একটি "টাস্ক ফোর্স" বঙ্গোপসাগরে পাঠানাের নির্দেশ দেয়। এটা "টাস্ক ফোর্স-৭৪" নামে পরিচিত। একই সঙ্গে যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে জাতিসংঘে মার্কিন কূটনীতি সত্রিয় থাকে। উল্লেখ্য, যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ৪ ও ১২ ডিসেম্বর যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় মার্কিন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। কিন্তু সোভিয়েত ভেটোর কারণে দুটো প্রস্তাবই নাকচ হয়ে যায়। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মার্কিন 'টাস্ক ফোর্স-৭৪' ভারত মহাসাগর ত্যাগ করে। এভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন নীতি একদিকে যেমন বাংলাদেশ বিরােধী ছিল, তেমনি নিজ দেশের জনগণ কর্তৃকও নীতিটি পরিত্যক্ত হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি পর্যায়ে ভূমিকা :
নিক্সন প্রশাসন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিরােধী শক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করলেও মার্কিন সংবাদপত্র, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদসহ বেসরকারি পর্যায়ে প্রায় সর্বস্তরের মার্কিন জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা পালন করেছিল। এমনকি অনেক আমলাও বাঙালির সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জর্জ হ্যারিসনের "বাংলাদেশ কনসার্ট" ছিল মুক্তিযুদ্ধের এক বিরাট অনুপ্রেরণা। এভাবে মার্কিন শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা নানাভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছিলেন। আমেরিকার নাগরিকরা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে গঠন করে বিভিন্ন সংগঠন। তাদের বাংলাদেশের পক্ষে ভূমিকা পাকিস্তানপন্থী মার্কিন প্রশাসনকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল। মার্কিন রাজনীতিবিদ বিশেষ করে কয়েকজন সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্য সরকারি নীতির কঠোর সমালােচনা করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, সিনেটর সাক্সবে, সিনেটর কেইস, কংগ্রেসম্যান গ্রাস হেলপান ও গালাকার, সিনেটর হ্যারিস, সিনেটর পার্সী, সিনেটর মাস্কী, ওয়াল্টার মনডেল ও এডওয়ার্ড ব্রুক প্রমূখ।
সুতরাং দেখা যায় যে, মার্কিন সরকারি পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা হলেও বেসরকারি পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ছিল ব্যাপক সহানুভূতি। কংগ্রেস, সুশীল সমাজ ও প্রচার মাধ্যমের সতর্কতা এবং প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন পাকিস্তানকে যতোটা সমর্থন ও সহযোগিতা করতে চেয়ছিল ঠিক ততটা করতে সক্ষম হয়নি।