আইয়্যামে জাহেলিয়া বলতে কি বুঝায়? আইয়্যামে জাহেলিয়া যুগে আরবের রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা আলোচনা কর।

প্রাক-ইসলামি যুগে আরবদের রাজনৈতিক,সামাজিক,ধর্মীয়,অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা আলোচনা কর। অথবা, আইয়্যামে জাহেলিয়া বলতে কিবুঝায়? আইয়্যামে জাহেলিয়া যুগে আরবের রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা আলোচনা কর।

আইয়ামে জাহেলিয়া বা অন্ধকার যুগ বলতে কি বুঝায়?

মহানবী (স:) এর নবুয়াত প্রাপ্তির পূর্ব যুগকে আইয়্যামে জাহেলিয়া যুগ বা অন্ধকার যুগ বলা হয়। আইয়াম অর্থ যুগ এবং জাহেলিয়া অর্থ অন্ধকার, কুসংস্কার, বর্বরতা। যে যুগে আরব দেশে কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও আল্লাহ প্রদত্ত ধর্মীয় অনুভূতি লােপ পেয়েছিল সে যুগকেই অন্ধকার যুগ হিসেবে চিহিৃত করা হয়। তবে অন্ধকার যুগের সময়কাল সম্বন্ধে ইসলামী চিন্তাবিদদের মধ্যে মতবিরােধ রয়েছে।

অনেকের মতে, হযরত আদম (আ) হতে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নবুয়ত প্রাপ্তি পর্যন্ত দীর্ঘ সময়কেই অন্ধকার যুগ বলা যেতে পারে। কিন্তু এ অভিমত সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য, কারণ এ ক্ষেত্রে সকল নবী ও রাসুলকেও অস্বীকার করা হয়। হযরত আদম (আ.) হতে মহানবি (স)-এর আবির্ভাব পর্যন্ত বিশ্বের ইতিহাসে যে সকল সভ্য জাতি ও সভ্যতা চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে, সেগুলােকে তমাচ্ছন্ন বলে আখ্যায়িত করা ইতিহাসকে অস্বীকার করা ছাড়া কিছুই নয়।

অপর একদল মনে করেন যে, হযরত ঈসা (আ)-এর তিরােধানের পর হতে মহানবী (স)-এর আবির্ভাব পর্যন্ত প্রায় ছয় শতাব্দী কালকে অন্ধকার যুগ বলে চিহ্নিত করা যায়। কারণ এ সময় ঐশী জীবনবিধান সম্পর্কে জগৎ সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল। ইহুদী ও খ্রিস্টানদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এ যুগের তমসাকে আরও পরিবর্ধিত করে ও কুসংস্কার এর দিক নির্দেশনা প্রদান করে, কিন্তু পরীক্ষার কষ্টিপাথরে এ অভিমতও গ্রহণযােগ্য হতে পারে না। কারণ খ্রিস্ট্রীয় ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত দক্ষিণ আরব ও উত্তর আরবে শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসায়-বাণিজ্যে শিল্প-সাহিত্য, রাজনৈতিক চেতনাবােধ, অর্থনৈতিক উন্নতি, সামাজিক ব্যবস্থার সুষ্ঠু ব্যবহার যতখানি উৎকর্ষতা লাভ করেছিল, তাকে অন্ধকার বলে আখ্যায়িত করলে সত্যের অপলাপ করা হবে।

তবে বলা যায়, ইসলাম পূর্ব যুগের আরববাসী বা আরব জাতি বলতে আইয়ামে জাহেলিয়ার অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল অর্থাৎ হেজাজ এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অধিবাসীরা অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীদের তুলনায় অধিকতর বর্বর, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, নৈতিকতাহীন, উচ্ছৃঙ্খল এবং অজ্ঞানতায় নিমজ্জিত ছিল।

ঐতিহাসিক বর্ণনায় জানা যায় যে, মহানবি (স) এর জন্মের প্রাককালে উত্তর এবং দক্ষিণ আরবে সমৃদ্ধশালী রাজবংশ স্বীয় আধিপত্য বিস্তার করেছিল। উত্তর আরবের হীরা ছিল একটি সমৃদ্ধশালী নগরী। হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা) কর্তৃক ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে হীরা অধিকৃত হলে এর সুরম্য হর্মরাজি মুসলিম বাহিনীকে স্তম্ভিত করে তােলে। প্রণিধানযােগ্য যে, পরবর্তীতে কুফা শহর ও মসজিদ সম্প্রসারণে হীরার স্থাপত্য রীতির অনুকরণ করা হয়েছিল। বস্তুত দক্ষিণ আরবের হিমাইয়ারী রাজ্য খিষ্ট্রীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর এক বিস্ময়কর প্রতিভা। এ রাজবংশের অহংকারী আবরাহা কাবাগুহ ধ্বংস করতে গিয়ে নিহত হয়েছিল। সুতরাং এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, দক্ষিণে আরব মিনাইয়ান, সাবিয়ান ও হিমাইয়ারী সভ্যতাকে অজ্ঞতার আবর্তে নিক্ষেপ করা যায় না। অপরদিকে উত্তর আরবের নুফুদ অঞ্চলে নাবাতিয়ান, পালমিরা ঘাসসানি ও লাখমিদ রাজ্যগুলাের সমৃদ্ধির প্রতি লক্ষ্য করলে এগুলােকেও অন্ধকারাচ্ছন্ন বলা যায় না। তাছাড়া উত্তর আরবের মরুময় নুফুদ অঞ্চলসহ নজদ ও হিজাজ প্রদেশে মরুচারি বেদুইনদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র ছিল। গােত্র কলহ, কাব্যে কুৎসা রচনায় মত্ত রক্তলােলুপ লুটেরা বেদুইনদের মধ্যে পার্শ্বর্তী সভ্যতার ছোয়া দাগ কাটতে পারেনি। দুর্দ্যনীয়, দুর্বিনীত অত্যাচারী হিজাজ ও নজদবাসীর ইতিহাস প্রাক-ইসলামি যুগের অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায়।

বিশেষত হিজাজ ও তৎপার্শ্বস্থ এলাকায় নৈরাজ্যের ঘনঘটা বিরাজমান ছিল। হিজাজে প্রচলিত আরবি ভাষায় কুরআন অবতীর্ণ হয়। এ জন্য অন্ধকার যুগের আরব বলতে হিজাজ ও পার্শ্ববর্তী এলাকা এবং অন্ধকার যুগ বলতে সে সময়কে বুঝতে হবে।

প্রাক-ইসলামি যুগে আরবদের রাজনৈতিক অবস্থা :

ইসলাম পূর্ব যুগে আরবের রাজনৈতিক অবস্থা বিশৃঙ্খলাপূর্ণ এবং হতাশাব্যঞ্জক ছিল। কোনা কেন্দ্রীয় শক্তির নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্ব না থাকায় আরবে গােত্র শাসন প্রাধান্য লাভ করে। তাদের মধ্যে কোনাে ঐক্য ছিল না। গােত্রসমূহের মধ্যে সব সময় বিরােধ লেগেই থাকত।

১. গোত্রীয় শাসন :

অন্ধকার যুগে আরবের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল বিশৃঙ্খল,স্থিতিহীন ও নৈরাজ্যের অন্ধকারে ঢাকা। উত্তর আরবের বাইজান্টাইন ও দক্ষিণ আরবের পারস্য প্রভাবিত কতিপয় ক্ষুদ্র রাজ্য ব্যতীত সমগ্র আরব এলাকা স্বাধীন ছিল। সামান্য সংখ্যক শহরবাসী ছাড়া যাযাবর শ্রেণির গােত্রগুলোর মধ্যে গােত্রপতির শাসন বলবৎ ছিল। গােত্রপতি বা শেখ নির্বাচনে শক্তি,সাহস, আর্থিক স্বচ্ছলতা, অভিজ্ঞতা, বয়ােজেষ্ঠ্যতা ও বিচার বুদ্ধি বিবেচনা করা হত। শেখের আনুগত্য ও গােত্রপ্রীতি প্রকট থাকলেও তারা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রতি সর্বদা সচেতন ছিলেন। ভিন্ন গােত্রের প্রতি তারা চরম শত্রুভাবাপন্ন ছিল। গােত্রগুলাের মধ্যে সৌঁহার্দ্য ও সম্প্রীতি মোটেই ছিল না। কলহ বিবাদ নিরসনে বৈঠকের ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। শেখের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক জীবন ধারার ছােয়া থাকলেও শান্তি ও নিরাপত্তার লেশমাত্র ছিল না।

২. গােত্র-দ্বন্দ্ব :

গোত্র কলহের বিষবাষ্পে অন্ধাকার যুগে আরব জাতি কলুষিত ছিল। গােত্রের মানসম্মান রক্ষার্থে তারা রক্তপাত করতেও কুন্ঠাবােধ করত না। তৃণভুমি, পানির ঝর্ণা এবং গৃহপালিত পশু নিয়ে সাধারণত রক্তপাতের সূত্রপাত হত। কখনও কখনও তা এমন বিভীষিকার আকার ধারণ করত যে দিনের পর দিন এ যুদ্ধ চলতে থাকত। আরবিতে একে আরবের দিন (আইয়্যামুল আরব ) বলে অভিহিত করা হত। আরবের মধ্যে খুনের বদলা খুন, অথবা রক্ত বিনিময় প্রথা চালু ছিল। অন্ধকার যুগের অহেতুক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের নজীর আরব ইতিহাসে এক কলঙ্কময় অধ্যায়। তৎমন্ধ্যে বুয়াসের যুদ্ধ, ফিজার যুদ্ধ ইতিহাসে প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে। উট, ঘোড়দৌড়, পবিত্র মাসের অবমাননা, কুৎসা রটনা করা ইত্যাদি ছিল এ সকল যুদ্ধের মূল কারণ। বেদুইনগণ উত্তেজনাপূর্ণ কবিতা পাঠ করে যুন্ধের ময়দানে রক্ত প্রবাহে মেতে উঠত। এ সকল অন্যায় যুদ্বে জানমালের বিপুল ক্ষতি সাধিত হত। যুদ্ধপ্রিয় গোত্রগুলাের মধ্যে আউস, খাযরায, কুরাইশ, বানু বকর, বানু তাগলিব, আবস ও জুবিয়ান ছিল প্রধান।

প্রাক-ইসলামি যুগে আরবদের সামাজিক ও নৈতিক অবস্থা :

ইসলাম পূর্ব যুগে আরবদের সামাজিক জীবন অনাচার-পাপাচার, দুর্নীতি, কুসংস্কার, অরাজকতা, ঘৃণ্য আচার অনুষ্ঠান এবং নিন্দনীয় কার্যকলাপে পরিপূর্ণ হিল। আরবেরা মদ নারী ও যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত থাকত। হযরত মুহাম্মদ (স:) সমগ্র আরব দেশকে মূর্খতা, বর্বরতা ও প্রকৃতি পূজায় নিমজ্জিত দেখতে পান। তারা এত বেশি মদ্যপায়ী ছিল যে কোন গর্হিত কাজ করতে তারা দ্বিধাবােধ করত না।

কৌলিণ্য প্রথা :

তৎকালীন আরবের সমাজ বলতে শহরবাসী ও বেদুইনদের বুঝতে হবে। এ উভয় সমাজে বিয়েশাদী,আচার অনুষ্ঠান বিদ্যমান ছিল। তা ছাড়া রীতি- নীতি ও ধ্যান-ধারণায় উভয় সমাজ একই ধরনের ছিল। বংশগত কৌলিণ্য ও গােত্রগত মর্যাদা এত প্রকট ছিল যে, অহংকার, হিংসা-বিদ্বেশ, ঘৃণা সমাজের সর্বত্র বিরাজমান ছিল। বংশ মর্যাদা ও কৌলিণ্য প্রথা সংরক্ষণের জন্য কখনও বা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হত। প্রাকৃতিক কঠোরতার নিষ্পেষণে আরব সমাজে অরাজকতা, কুসংস্কার,নিন্দনীয় কার্যকলাপ ও ঘৃণাপ্রথা অপ্রতিহতভাবে বেড়ে চলছিল। পাপাচার, দুর্নীতি, মদ্যপান নারীগমনের আসক্তি তাদের পেয়ে বসেছিল। বস্তুত তাঁদের জীবনযাত্রা ছিল অভিশপ্ত ও কলুষিত। জনজীবন ছিল বর্বতার শিকার।

প্রাক-ইসলামি যুগে আরবে নারীর অবস্থান :

জাহেলী যুগে আরব সমাজে নারীর স্থান ছিল অতি নিকৃষ্ট। সামাজিক মর্যাদা বলতে তাদের কিছুই ছিল না। নারী ছিল ভােগ-বিলাসের সামগ্রী ও অস্থাবর সম্পত্তির মত। অবৈধ প্রণয়, অবাধ মেলামেশা ও একই নারীর বহু স্বামী গ্রহণ প্রথা ব্যাপক ছিল। ব্যভিচার এত জঘন্য আকার ধারণ করেছিল যে, স্বামীর অনুমতিক্রমে কিংবা স্বামীর নির্দেশে অথবা পুত্র সন্তানের আশায় নারীগণ বহু পুরুষের সান্নিধ্যে গমন করতো। বিষয়-সম্পত্তিতে নারীদের কোনা অধিকার ছিল না। গৃহপালিত পশুর মত ব্যবহার করা হত নারীদের প্রতি। নারীও যে মানুষ এ কথা তাদের স্মরণে আসত না।

প্রাক-ইসলামি যুগে আরবে দাস-দাসীর অবস্থা :

প্রাচীনকাল হতেই আরবে দাস-দাসী ক্রয়-বিক্রয় প্রথা প্রচলিত ছিল। দাস-দাসীদের জীবন ছিল অত্যন্ত দুর্বিষহ ও করুণ। মানবিক মর্যাদা ও ব্যক্তি স্বাধীনতা বলতে তাদের কিছুই ছিল না। হাটে বাজারে বিভিন্ন পণ্যদ্রব্যের মত দাস-দাসী ক্রয় বিক্রয় হতাে। প্রভুর বিনা অনুমতিতে দাস-দাসীগণ বিয়ে করতে পারত না। কিন্তু তাঁদের ছেলে-সন্তানের মালিক হত প্রভু। মূলত ভৃত্য ও ভূমিদাসদের আশা আকাঙ্ক্ষার ক্ষীণ আলােও পরিলক্ষিত হত না। নির্মম অত্যাচারে দাস-দাসীদের নিরাপত্তা দারুণভাবে বিঘ্নিত হত। দাস-দাসীদের মানুষ হিসেবে গণ্য করার কথা তারা বিস্মৃতি হয়ে গিয়েছিল।

জীবন্ত কন্যা সন্তানকে কবরস্থ করা :

প্রাক-ইসলামি আরবে জীবন্ত কন্যা শিশুকে কবরস্থ করার নিষ্ঠুর প্রথা প্রচলিত ছিল। দারিদ্রতার ভয়ে বিশেষ করে কন্যা সন্তানকে অভিশপ্ত, লজ্জাজনক ও অপয়া মনে করে জীবন্ত কবর দেওয়া হত। কন্যা সন্তান জন্মদানকারী মাতার ভাগ্যেও নেমে আসত কঠিন অত্যাচারের তীব্র কষাঘাত। এ ঘৃণ্য প্রথার উচ্ছেদ করে পবিত্র কুরআনে ঘােষণা করা হয়েছে "তােমরা দারিদ্রতার-ভয়ে সন্তানদেরকে হত্যা করাে না, বস্তুত আমিই তাদের জীবিকা সরবরাহ করে থাকি।"

অনাচার, ব্যভিচার ও নৈতিক অবনতি :

নৈতিক অবনতি, ব্যভিচার, অনাচার, লুটতরাজ, মদ্যপান, জুয়াখেলা-সুদ, নারীহরণ,ইত্যাদি অপকর্ম আরব সমাজে বিদ্যমান ছিল। সুদ আদায়ে অপারগ হলে সুদ গ্রহীতার স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের মালিক মহাজন ক্রীতদাস-দাসী রুপে হস্তগত করে হাটে-বাজারে বিক্রয় করে ফেলত। মােটকথা নারীহরণ, ঋণ প্রথা, কুসিদ প্রথা ও দাসত্ব প্রথার মতাে নানাবিধ পাপ কর্ম আরব সমাজকে জর্জরিত করে ফেলেছিল।

প্রাক-ইসলামি যুগে আরবদের ধর্মীয় অবস্থা :

জাহেলিয়া যুগে আরবদের ধর্মীয় অবস্থা অত্যন্ত শােচনীয় ও অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। আরবে তখন অধিকাংশ লােকই ছিল জড়বাদী পৌত্তলিক। তাদের ধর্ম ছিল পৌত্তলিকতা এবং বিশ্বাস ছিল আল্লাহর পরিবর্তে অদৃশ্য শক্তির কুহেলিকাপূর্ণ ভয়ভীতিতে।তারা বিভিন্ন জড়বস্তুর উপাসনা করত। চন্দ্র, সূর্য, তারকা এমনকি বৃক্ষ, প্রস্তরখন্ড, কূপ, গুহাকে পবিত্র মনে করে তার পৃজা করত। প্রকৃতি পূজা ছাড়াও তারা বিভিন্ন মূর্তির পূজা করত। মূর্তিগুলোর গঠন ও আকৃতি পূজারীদের ইচ্ছানুযায়ী তৈরি করা হতো পৌত্তলিক আরবদের প্রত্যক শহর বা অঞ্চলের নিজস্ব দেবীর মধ্যে অন্যতম ছিল আল-লাত, আল-মানাহ এবং আল-উজ্জা। আল-লাত ছিল তায়েফের অধিবাসিদের দেবী, যা চারকোণা এক পাথর। কালাে পাথরের তৈরি আল-মানাহ ভাগ্যের দেবী। এ দেবীর মন্দির ছিল মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী কুদায়েদ স্থানে। মদিনার আউস ও খাজরাজ গােত্রের লােকেরা এ দেবীর জন্য বলি দিত এবং দেবীকে সম্মান করত। নাখলা নামক স্থানে অবস্থিত মক্কাবাসীদের অতি প্রিয় দেবী আল-উজ্জাকে কুরাইশগণ খুব শ্রদ্ধা করতো। আরবদেশে বিভিন্ন গােত্রের দেবদেবীর পূজার জন্য মন্দির ছিল। এমনকি পবিত্র কাবা গৃহেও ৩৬০ টি দেবদেবীর মূর্তি ছিলকাবাঘরে রক্ষিত মূর্তিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মূর্তির বা দেবতার নাম ছিল হােবল। এটি মনুষ্যাকৃতি ছিল- এর পাশে ভাগ্য গণনার জন্য শর রাখা হতো।উপরিউক্ত দেব-দেবী ছাড়া আরবে আরও পাথরের দেব-দেবীর মূর্তি ছিল। এগুলাের কথা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে আরববাসীরা ধর্মীয় কুসংস্কার ও অনাচারে আচ্ছন্ন ছিল। তারা দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে পশু ও নরবলি দিত। মন্ত্রতন্ত্র, যাদুটোনা, ভুত, প্রেত ও ভবিষ্যৎ বাণীতে তারা বিশ্বাসী ছিল।

এ যুগে আরবে পৌত্তলিক ছাড়া অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকও কিছু ছিল। এদের মধ্যে ছিল ইহুদী, খ্রিস্টান ও হানাফী সম্প্রদায়ের লোক। ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের লােকেরা আসমানী কিতাবের অধিকারী ও একেশ্বরবাদী বলে দাবী করত। কিন্তু ইহুদীদের বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও নিয়ন্তা সম্বন্ধে সঠিক ধারণা ছিল না। তারা বিশৃংখলা ও বৈষম্য সৃষ্টিকারী ছিল। অপরপক্ষে খ্রিস্টানরা ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী ছিল। আরবে আর এক শ্রেনির বিশ্বাসী লােক ছিল। তারা পৌত্তলিকতার বিরােধী ছিল। এক সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা এবং পরলোক সম্বন্ধে তাদের ধারণা ছিল। তারা সৎ জীবন যাপন করত। ওয়ারাকা বিন নাওফেল, যায়েদ বিন আমর, আবু আনাস প্রমুখ এ সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। এ সম্প্রদায়ভুক্ত লােকের সংখ্যা এত অল্প ছিল যে তারা আরবদের উপরে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়নি।

প্রাক-ইসলামি যুগে আরবদের অর্থনৈতিক অবস্থা :

আরবের অধিকাংশ অঞ্চল মরুময় ও অনুর্বর। অনুর্বর মরুভূমি কৃষি কাজের উপযােগী ছিল না। ফলে খাদ্য দ্রব্যের উৎপাদন প্রয়ােজনের তুলনায় কম ছিল। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা অনুন্নত ছিল।ভৌগােলিক পরিবেশ এবং জীবিকার ভিত্তিতে ইসলাম পূর্ব যুপে আরববাসীদের কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। এ ভাগ গুলাে হল-
(১) কৃষিজীবি
(২) ব্যবসায়ী
(৩) সুদের কারবারী
(৪) কারিগর (৫)
মরুবাসী বেদুইন ইত্যাদি।

কৃষিজীবি :

আরবের তায়েফ, ইয়েমেন এবং মদিনা অঞ্চলের ভূমি কৃষির উপযােগী ছিল। এসব অঞ্চলের অধিবাসীরা কৃষিকাজ করত। বানু নাজির ও বানু কুরাইজা দুই ইহুদি গােত্র মদিনার শস্য শ্যামল অঞ্চলে কৃষিকাজে নিয়ােজিত ছিল। উর্বর তায়েফ ভূমিতে তরমুজ, খেজুর, ডুমুর, আঙ্গুর, জলপাই, ইক্ষু উৎপন্ন হত।

ব্যবসায়ী :

আঞ্চলিক বসবাসের ভিত্তিতে আরবগণ দুভাগে বিভক্ত ছিল। যথা- শহরবাসী আরব এবং মরুবাসী বেদুইন। শহরবাসী আরবের কিছু কিছু গোত্র ব্যবসায় বাণিজ্যে নিয়ােজিত থেকে জীবিকা অর্জন করত। মক্কাবাসী কুরাইশ সম্প্রদায় মিসর,সিরিয়া, পারস্য এবং ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য করে সম্পদশালী হয়। ইসলাম পূর্ব যুগে হযরত আবুবকর (রা, হযরত ওসমান (রা) এবং বিবি খাদিজা (রা) বিত্তশালী ব্যবসায়ী ছিলেন।

সুদের কারবার :

ইসলাম পূর্ব যুগে ধনী আরববাসী বিশেষ করে ইহুদি সম্প্রদায় সুদের ব্যবসা বা কারবারে নিয়ােজিত ছিল । দরিদ্র লােকেরা অধিক সুদে ইহূদি ও সুদের ব্যবাসায়ীদের নিকট থেকে ধার গ্রহণ করত। ফলে ঋণ গ্রহণকারীরা সর্বশান্ত হয়ে যেত। কোন কোন সময় ঋণ ও সুদ পরিশােধে ব্যর্থ হলে নিজের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, বিত্ত-সম্পত্তি সুদ-ব্যবসায়ীদের দখলে চলে যেত। পরবর্তীতে ইসলামে সুদ গ্রহণ নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়।

কারিগর সম্প্রদায় :

ইসলাম পূর্ব আরবে পৌত্তলিকতার ব্যাপকতার কারণে মূর্তি তৈরির জন্য এক প্রকার কারিগর শ্রেণির উদ্ভব হয়। এদের আর্থিক অবস্থা ও সামাজিক মর্যাদা ভালা ছিল।

মরুবাসী বেদুইন :

মরুবাসী বেদুইনদের জীবিকা নির্বাহের উপায় ছিল লুটতরাজ ও পশুপালন। জীবিকার তাগিদে এসব স্বভাবের বশবর্তী হয়ে তাঁরা ডাকাতি, রাহাজানী ও লুটতরাজ করত।

প্রাক-ইসলামি যুগে আরবদের সাংস্কৃতিক অবস্থা :

বর্তমান যুগের ন্যায় প্রাক-ইসলামি যুগে আরবে বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা ও সংস্কৃতি না থাকলেও আরবরা সাংস্কৃতিক জীবন হতে একেবারে বিচ্ছিন্ন ছিল না। তাদের ভাষা এত সমৃন্ধ ছিল যে, আধুনিক ইউরোপের উন্নত ভাষাগুলাের সাথে তুলনা করা যায়।

কবিতার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক চেতনা :

প্রাক-ইসলামি যুগে লিখন প্রণালির তেমন উন্নতি হয়নি বলে আরবগণ তাদের রচনার বিষয়বস্তু গুলাে মুখস্ত করে রাখত। তাঁদের স্মরণ শক্তি ছিল খুব প্রখর। তারা মুখে কবিতা পাঠ করে শুনাত। কবিতার মাধ্যমে তাদের সাহিত্য প্রতিভা প্রকাশ পেত। এ জন্যেই লােক-গাথা, জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে পরবর্তীকালে আরব জাতির ইতিহাস লিখিত হয়েছে। আরব সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন আরবি গীতিকাব্য অথবা কাসীদা সমসাময়িক কালের ইতিহাসে অতুলনীয়। ৫২২ হতে ৬২২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রচনার সাবলীল গতি ও স্বচ্ছ বাক্য বিন্যাসে বৈশিষ্ট্য থাকলেও এর বিষয়বস্তু রুচিসম্মত ছিল না। যুদ্ধের ঘটনা, বংশ গৌঁরব, বীরত্বপূর্ণ কাহিনী, যুদ্ধের বিবরণ, উটের বিস্ময়কর গুণাবলী ছাড়াও নারী, প্রেম, যৌন সম্পর্কিত বিষয়ের উপর গীতিকাব্য রচনা করা হত। ঐতিহাসিক হিট্রি বলেন, "কাব্য প্রীতিই ছিল বেদুঈনদের সাস্কৃতিক সম্পদ।" প্রাক-ইসলামি কাব্য সাহিত্যের প্রথম পর্যায়ে মিলযুক্ত গদ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। কুরআন শরীফে এ ছন্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কাব্য চর্চার রীতির মধ্যে উষ্ট্র চালকের ধনিময় সংগীত (হুদা) এবং জটিলতার ছন্দ অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু কাসীদা ছিল একমাত্র উৎকৃষ্ট কাব্যরীতি। বসুস যুদ্ধে তাঘলিব বীর মুহালহিল সর্বপ্রথম দীর্ঘ কবিতা রচনা করেন। জোরালাে আবেগময় সাবলীল ভাষা ও মৌলিক চিন্তা ধারায় এটি ছিল পুষ্ট।

উকাজের সাহিত্য মেলা কি ?

প্রাক-ইসলামি যুগে আরবদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের বাগ্বিতা। জিহ্বার অফুরন্ত বাচন শক্তির অধিকারী প্রাচীন আরবের কবিরা মক্কার অদূরে উকাজের বাৎসরিক মেলায় কবিতা পাঠের প্রতিযােগিতায় অংশগ্রহণ করতেন। উকাজের বাংসরিক সাহিত্য সম্মেলনে পঠিত সাতটি ঝুলন্ত কবিতাকে আস্-সাবাউল মুআল্লাকাত বলা হয়। হিট্রি উকাজের মেলাকে Academic francaise বলে অভিহিত করেন। তখনকার যুগের কবিদের মধ্যে যশস্বী ছিলেন উক্ত সাতটি ঝুলন্ত গীতি কাব্যের রচয়িতাগণ। সােনালী হরফে লিপিবদ্ধ এ সাতটি কাব্যের রচনা করেন আমর ইবনে কুলসুম, লাবিছ ইবন রাবিয়া, আনতারা ইবন শাদদাদ, ইমরুল কায়েস, তারাফা ইবনে আবদ, হারিস ইবনে হিলজা ও জুহাইর ইবন আবি সালমা। এদের মধ্যে অসাধারণ প্রতিভাশালী ছিলেন ইমরুল কায়েস। তিনি প্রাক-ইসলামি যুগের শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদা লাভ করেন। ইউরােপীয় সমালােচকগণও তার উৎকৃষ্ট শব্দ চয়ন, সাবলীল রচনাশৈলী,চমকপ্রদ স্বচ্ছ লহরীতে মুগ্ধ হয়ে তাকে আরবের শেক্সপীয়র বলে আখ্যায়িত করেন। আরবি ভাষায় এরুপ উন্নতি ও সমৃদ্বি সাধনে হিট্রি মন্তব্য করেন, ইসলামের জয় অনেকাংশে একটি ভাষার জয়, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে একটি ধর্মগ্রন্থের জয়।

সাহিত্য আসরের আয়ােজন :

তৎকালীন আরবে সাহিত্য চর্চায় আরবদের আগ্রহ ছিল সতস্বফূর্ত। অনেক সাহিত্যমােদী আরব নিয়মিত সাহিত্য আসরের আয়াজন করতেন। সাহিত্য আসরের উদ্যোক্তাদের মধ্যে তাকিব গােত্রের ইবনে সালাময়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। প্রতি সপ্তাহে তিনি একটি সাহিত্য আসরের আয়ােজন করতেন। আরবদের সাহিত্য প্রীতির কথার উল্লেখ করে ঐতিহাসিক হিট্রি বলেছেন, "পৃথিবীতে সম্ভবত অন্যকোনাে জাতি আরবদের ন্যায় সাহিত্য চর্চায় এতবেশি সতস্বফূর্ত আগ্রহ প্রকাশ করেনি এবং কথিত বা লিখিত শব্দ দ্বারা এত আবেগাচ্ছন্ন হয়নি"। এ সমন্ত সাহিত্য আসরে কবিতা পাঠ, সাহিত্য বিষয়ক আলােচনা ও সমালােচনা অনুষ্ঠিত হত।

কবিতার বিষয়বসতু :

প্রাক-ইসলামি যুগের সাহিত্যিকগণ তাদের গােত্র ও গােত্রীয় বীরদের বীরত্বপূর্ণ কাহিনী, যুন্ধের বিবরণ, উটের বিস্ময়কর গুণাবলী, বংশ গৌরব, অতিথি পরায়ণতা, নরনারীদের প্রেম, নারীর সৌন্দর্য, যুদ্ধ-বিগ্রহ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা করতেন। তাদের এ সকল কবিতা সুদুর অতীত কালের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি প্রাক-ইসলামি আরবদের বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলােকপাত করে।

Next Post Previous Post