ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিনিয়োগ নীতি।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিনিয়োগ নীতি সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা :পূর্বাঞ্চলে একচেটিয়া বাণিজ্য করার জন্য ১৬০০ খিস্টাব্দে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রানী এলিজাবেথের নিকট হতে সনদ পায়। প্রায় একই সময়ে গঠিত হয় ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ড্যানিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ইংরেজরা কলিকাতায়, ফরাসিরা চন্দননগরে, ওলন্দাজরা শ্রীরামপুরে এবং ড্যানিশরা চঁচুড়ায় কুঠি স্থাপন করে বাণিজ্য চালিয়ে যায়।
কোম্পানির বিনিয়োগ কি?
মূলধন ও বাণিজ্যের পরিমাণের ক্ষেত্রে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডয়া কোম্পানি সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। এ কোম্পানি বাংলা থেকে প্রধানত সুতিবস্ত্র, রেশমসুতা, রেশমবস্ত্র ও কাঁচা রেশম ও সোড়া (লবণ মাটি) ইংল্যান্ডে নিয়ে যেতাে। ক্রয়কৃত দ্রব্য কোম্পানির বিনিয়োগ নামে পরিচিত।
বিনিয়োগ নীতি কি?
বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে উৎপাদিত এবং আড়ং-এ (বিক্রয় কেন্দ্র) আনা পণ্যদ্রব্য বাংলা ভাষা না জানা ও কলিকাতায় বসবাসরত কোম্পানির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পক্ষে সংগ্রহ করা অসম্ভব ছিল। তাই পণ্য ক্রয়ের জন্য কোম্পানিকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করতে হয়। এই নীতিকে বিনিয়োগ নীতি বলা হয়।
বিনা শুল্কে বাণিজ্য সুবিধা
বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিশেষ সুবিধা লাভ করেছিল। ১৬৫১ সালে কোম্পানি বার্ষিক তিন হাজার টাকা শুল্ক প্রদানের বিনিময়ে বাংলায় বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার পায়। বাংলার তৎকালীন সুবাদার শাহ সুজা প্রথমে এ সুবিধা প্রদান করেন। ১৭১৭ সালে মোগল সমাট ফররুখশিয়ার এক ফরমান দ্বারা কোম্পানিকে এ সুবিধা দ্বিতীয়বার দেন। এ ফরমানের বলে কোম্পানি বিনাশুল্কে বাংলায় ব্যবসা করে।
কোম্পানির প্রাথমিক বিনিয়োগ নীতি
কোম্পানি প্রথমে যে বিনিয়োগ নীতি গ্রহণ করে তাকে দাদনি ব্যবস্থা বলা হয়। দাদনি ব্যবস্থা ১৭৫৩ সাল পর্যন্ত চালু ছিল। কোম্পানি কলিকাতায় বসবাসরত ব্যবসায়ীদের সাথে চুক্তি করতো। এসব ব্যবসায়ীকে দাদনি ব্যবসায়ী বলা হতো। এদের মধ্যে গােপীনাথ শেঠ, রামকৃষ্ণ শেঠ, লক্ষ্মীকান্ত শেঠ ও শুভরাম বসাক অন্যতম। কোম্পানি এদের সাথে চুক্তি করতো। চুক্তিতে নির্দিষ্ট মূল্যে ও নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ দ্রব্য সরবরাহের শর্ত থাকতো। কোম্পানি দ্রব্য ক্রয়ের জন্য তাদেরক দাদন অথবা অগ্রিম অর্থ প্রদান করতো। এসব ব্যবসায়ীরা আবার অভ্যন্তরীণ বাজারের ব্যবসায়ীদেরকে দাদন দিতো। তৃতীয় পর্যায়ে তারা উৎপাদকদেরকে দাদন দিতো। দাদনি ব্যবস্থার মাধ্যমে বিনিয়োগের পরিমাণ সম্পর্কে পুরা তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, ১৭৪৮ সালে দাদনি ব্যবস্থায় বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩০ লক্ষ টাকা। ১৭৫১-৫২ সালে এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৪ লক্ষ টাকায় দাঁড়ায়। এক শতাব্দীর অধিককাল সময় দাদনি ব্যবস্থা চালু ছিল।
এজেন্সি ব্যবস্থার প্রচলন
১৭৫৩ সালে দাদনি ব্যবস্থার স্থলে এজেন্সি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় । এজেন্সি ব্যবস্থা চালুর পেছনে যেসব করণ দেখানাে হয় সেগুলি হলো (ক) ব্যবসায়ীদের আর্থিক অবস্থার অবনতি, (খ) চুক্তির শর্ত বাস্তবায়নের অসুবিধা ও (গ) ১৭৫২ সালে চুক্তি স্বাক্ষরকালে তাঁতীদের দুর্ব্যবহার। কিন্তু কোম্পানির অভ্যন্তরীণ কগজপত্র থেকে জানা যায় যে, কোম্পানি তাতীদেরকে বাজার দর থেকে শতকরা ২০ থেকে ৩০ টাকা কম দিতো। তাই তাঁতীরা ফরাসি ও অন্যান্য কোম্পানির সাথে ব্যবসা করতে বেশি আগ্রহী ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে তাঁতীদের ব্যবসা করার অনিচ্ছা এজেন্সি ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রধান কারণ ।
এজেন্সি ব্যবস্থার কাঠামো
এজেনসি ব্যবস্থার কাঠামাে নিম্নরূপ : প্রত্যেক আডং দেখাশুনা করার জন্য একজন বেতনভোগী ইংরেজ রেসিডেন্ট থাকতো। তার অধীনে থাকতা বেতনভােগী গােমস্তা। গােমস্তার অধীনে থাকতাে কিছু কর্মচারী, যেমন মোহরি, সেরেস্তাদার, যাচনদার, মুকিম, তাগিদদার, বরকন্দাজ, পিয়ন ইত্যাদি। এজেন্সি ব্যবস্থাতেও তাঁতীদেরকে দাদন দেয়ার প্রচলন ছিল। তাদের সাথে কোম্পানির চুক্তি হতো। তাঁতীদেরকে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বস্ত্র সরবরাহ করতে হতো। গােমস্তার দায়িত্ব ছিল দাদন দেয়া ও দ্রব্য সংগ্রহ করা। অন্যান্য কর্মচারীরা এ ব্যাপারে গোমস্তাকে সাহায্য করতা।
এজেন্সি ব্যবস্থার ত্রুটি
এজেন্সি ব্যবস্থার ত্রুটি ছিল। কোম্পানির এককালের কর্মকর্তা ইউলিয়ম বল্টস কোম্পানির কর্মচারীরা কিভাকে তাঁতীদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ করতাে তার একটি বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন যে, গােমস্তা তাঁতীদের দাদন দিতো। দরিদ্র হতভাগ্য তাঁতীদের স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতির কোন তােয়াক্কা তারা করতাে না। তাঁতীরা দাদন নিতে না চাইলে তাদের, কোমরে টাকা গুঁজে দিয়ে বেত্রাঘাত করা হতো। গুদামজাত করার পর যাচনদার দ্বারা মালামাল যাচাই করা হতাে। অনেক ক্ষেত্রে যাচনদার 'ক' শ্রেণীর পণ্য 'খ' শ্রেণীর পণ্যে পরিণত করতো। ফলে তাঁতীরা কম মূল্য পেতাে। পলাশী যুদ্ধের পর এজেন্সি ব্যবস্থা তাঁতীদের জন্য অরাে ক্ষতিকর হয়। কোম্পানির কর্মচারীরা তাঁতীদেরকে আগের মত বাজার দর থেকে শতকরা ২০ থেকে ৩০ টাকা কম দিতে থাকে। ফলে চুক্তিবদ্ধ হয়েও তাঁতীরা অন্যান্য কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা আরম্ভ করে। শাসক কোম্পানি আইন পাশ করে তাঁতীদের নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা করে। এ প্রক্রিয়ার ফলে তাঁতীরা স্বাধীনতা হারায়। এজেন্সি ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারিগণ ব্যক্তিগত ব্যবসায় লিপ্ত হয়। পলাশী যুদ্ধের পর তাদের ব্যবসার বিস্তৃতি ঘটে। তারা কোম্পানির দস্তকের অপব্যবহার করে বিনাশুল্কে ব্যবসা করে। অন্যদিকে বাঙালি ব্যবসায়ীদের শুল্ক দিতে হতাে। ইংরেজদের সাথে প্রতিযোগিতায় তারা পেরে উঠে না। ফলে তারা অভ্যন্তরীণ ব্যবসা থেকে উৎখাত হয়।
কোম্পানির বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অত্যাচার ও ব্যক্তিগত ব্যবসা অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও কোম্পানির বিনিয়ােগের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ১৭৫১-৫২ সালে বিনিয়ােগের পরিমাণ ছিল ৩৪ লক্ষ টাকা। ১৭৯৩ সালে এর পরিমাণ ১ কোটি টাকায় বৃদ্ধি পায়।
আড়ং কমিটি গঠন
কলিকাতা থেকে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্য কলিকাতা কাউন্সিল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন। কমিটি গঠন করে। প্রথমে কাউন্সিলের একজন সদস্যকে সভাপতি করে আড়ং কমিটি গঠন করা হয়। পরে আডং কমিটির স্থলে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ কমিটি গঠিত হয়। ১৭৭৪ সালে ১১ সদস্য বিশিষ্ট বোর্ড অব ট্রেড নামক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ কমিটি গঠন করা হয়। এদের মধ্যে ৭ জন কলিকাতায় থাকতেন আর ৪ জন প্রধান বিক্রয় কেন্দ্র অবস্থান করতেন। এ কমিটি শক্তিশালী কমিটি হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে।
অর্ধেক দাদনি অর্ধেক এজেন্সি ব্যবস্থার প্রচলন
এজেন্সি ব্যবস্থার ক্রটিসমূহ কোর্ট অব ডাইরেক্টরের জানা ছিল। তাই দাদনি ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া যায় বিনা সে সম্পর্কে তারা কোম্পানির কর্মকর্তাদের মতামত চান। এজেন্সি ব্যবস্থার বদৌলতে সুযােগ-সুবিধা ভােগ করায় কর্মকর্তারা এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। তথাপি কোর্ট অব ডাইরেক্টরস এজেন্সি ব্যবস্থার পাশাপাশি চুক্তি (দাদনি) ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এ চুক্তি দাদনি ব্যবসায়ীদের সাথে না করে কলিকাতার ব্যবসায়ী ও ফ্যাক্টরি প্রধানদের সাথে করা হয়। ১৭৭৮-৮৮ সালের বিনিয়োগ থেকে জানা যায় যে, এ সময়ে কোম্পানির বিনিয়োগ আংশিক দাদনি ও আংশিক এজেন্সি ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয় । ঢাকা, লক্ষ্মীপুর, শান্তিপুর ও পাটনা আড়ং এজেন্সি ব্যবস্থার অধীনে রাখা হয় এবং অন্যান্য আড়ংসমূহ দাদনি ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
দেওয়ানি প্রাপ্তির প্রভাব
পলাশী যুদ্ধ ও বিশেষ করে ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি প্রাপ্তি কোম্পানির বিনিয়োগের উপর প্রভাব ফেলে। এর আগে কোম্পানি ইংল্যান্ড থেকে রূপার বাট নিয়ে আসতো এবং নবাবের টাকশালে তা গলিয়ে টাকা টংকন করতো। কিন্তু এ সময়ের পর থেকে কোম্পানির মূলধন বাংলা থেকে সংগৃহীত হওয়ার ফলে কোম্পানি রূপার বাট আনা বন্ধ করে দেয়। কোম্পানি রাজস্ব পেতাে কিস্তিতে কিন্তু তাকে বিনিয়ােগ করতে হতো প্রতিদিন। তাই তার সাময়িক মূলধনের প্রয়োজন হয়। কোম্পানি কলিকাতার ব্যবসায়ীদের নিকট হতে স্বল্পমেয়াদী ঋণ নেয়।
দ্বৈত মুদ্রার প্রচলন
বাংলায় রূপার বাট না আনা ও নানা পথে সম্পদ নিঃসরণ হওয়ার কারণে বাংলায় অস্থায়ী মুদ্রা সংকট দেখা দেয়। সংকট দূরীকরণের নিমিত্তে কোম্পানি দ্বৈত মুদ্রার অর্থাৎ রৌপ্য মুদ্রার সাথে স্বর্ণ মুদ্রার প্রচলন করে। কিন্তু বাংলায় সোনার প্রাচুর্য্য না থাকায় দ্বৈত মুদ্রা ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়। কোম্পানির কর্মচারীরা বিনিয়ােগ বিলের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে টাকা পাঠাতাে। কোম্পানি বিনিয়োগ বিলের পরিমাণ হ্রাস করে দেয়। ফলে মুদ্রা সংকট দূরীভূত হয়।
কঠোর নীতি গ্রহণ
পলাশী রেশম সুতা প্রস্তুতকারকদের জন্য দুঃখ বয়ে আনে। দেশীয় সুতা উন্নতমানের না হওয়ায় কোম্পানি সুতা তৈরির জন্য ফিলিয়েচার (সুতা প্রস্তুত করার ফ্যাক্টরি) প্রতিষ্ঠা করে। সুতা প্রস্তুতকারকরা ফিলিয়েচারে কাজ করত অনিচ্ছুক ছিল, কারণ সেখানে স্বাধীনতা ছিল না। কোম্পানি আইন জারি করে যে, যেসব সুতা প্রস্ততকারক ফিলিয়েচারে কাজ করবে না তাদের আঙ্গুল কেটে দেয়া হবে।
কোম্পানির সমঝোতা চুক্তি
পলাশী যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসক ও বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে ফরাসি, ওলন্দাজ ও ড্যানিশ কোম্পানি ইংরেজ কোম্প্যনির সাথে প্রতিযোগিতায় না পেরে তারা ইংরেজ কোম্পানির নিকট দুইটি বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করে। প্রথমত, প্রস্তাব করা হয় যে, এক সঙ্গে পণ্য ক্রয় করে চার কোপানির মধ্যে ভাগ করে নেয়া হবে। দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয় যে, তাঁতীদের আঞ্চলিকভাবে ভাপ করে নেয়া হবে। শক্তিশালী ইংরেজ কোম্পানি উভয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
উপসংহার :পলাশী পরোক্ষভাবে বাংলায় কোম্পানির ব্যবসা বন্ধ করে ও বাংলার তাঁতশিল্লের অবনতি ঘটায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব আরম্ভ হয়। ইংল্যান্ডে শক্তিচালিত যন্ত্রের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে বস্ত্র তৈরি হয়। ম্যানচেষ্টার ও অন্যান্য বস্তু তৈরিকারক শহর কোর্ট অব ডাইরেক্টরসকে বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে বস্ত্র আমদানি করা বন্ধ করতে চাপ দেয় । কোর্ট কোম্পানির বস্ত্র ব্যবসা বন্ধ করে দেয়। ফলে তাঁতশিল্পের অবনতি ঘটে। তখন থেকে কোম্পানি অন্য ব্যবসায়, বিশেষ করে নীল ব্যবসায় নিয়ােজিত হয়।