বাংলায় প্রাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার।

বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার সম্পর্কে আলােচনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : বাংলায় ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে শাসনকার্যে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি কর্মচারী নিয়োগের প্রয়োজন ও খ্রিস্টধর্ম প্রচারার্থে মিশনারিদের পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটানাের প্রয়াসের মধ্য দিয়ে বাংলায় সর্বপ্রথম পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার শুরু হয়। পরবর্তীতে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের অনুপ্রেরণা ও সর্বোপরি ইংরেজ কর্তৃপক্ষের সহযােগিতার মধ্য দিয়ে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ও বিকাশ ঘটে।

বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার

বিভিন্ন কারণের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে। এ পর্যায়সমূহ নিম্নরূপ..

সরকারি কর্মচারী নিয়োগের প্রয়ােজনীযতা

১৭৭৪ সালে কলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হলে বিচার সংক্রান্ত কাজের জন্য দো-ভাষী, করণিক ও নকলনবিসের প্রয়োজন দেখা দেয়। আর এ প্রয়ােজনে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে পাশ্চাত্য তথা ইংরেজি শিক্ষার প্রয়ােজন বেশি মাত্রায় অনুভূত হয়। এ প্রসঙ্গে ইংরেজি শিক্ষাপ্রাপ্ত রামনারায়ণ মিশ্র নামক সুপ্রিম কোর্টের জনৈক করণিকের কথা প্রণিধানযোগ্য যিনি সর্বপ্রথম একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে বাঙালি যুবকদের ইংরেজি ভাষা শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন।

মিশনারী শিক্ষার প্রভাব

খ্রিস্টধর্ম প্রচারক বা মিশনারিদের ধর্মপ্রচারের প্রচেষ্টা থেকে বাংলায় ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটে। তারা নিজেরা বাংলা শিক্ষা করে বাঙালিদেরকে ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করেন। উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যান, উইলিয়াম ওয়ার্ড, ডেভিড হেয়ার প্রমুখ মিশনারির প্রচেষ্টায় শ্রীরামপুর ও যশোর, দিনাজপুর ও কলকাতায় বিভিন্ন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষাবিস্তারের চেষ্টা চালানো হয়। তাদের চেষ্টায় ক্রমে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটতে থাকে।

মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর অনুপ্রেরণা

পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই বাংলা, ইংরেজি ও পাশ্চাত্য ভাবধারা প্রসারের ও বাঙলিদেরকে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রতি অনুরাগী করে তােলার চেষ্টা করেন। এ প্রসঙ্গে রাজা রামমােহন রায়, বৈদ্যনাথ মুখােপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ বাঙালি মনীষীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।

ইংরেজ কর্তৃপক্ষর সহযোগিতা ও সরকারি নীতি

১৮১৩ সালে শিক্ষা বিস্তারের জন্য ব্রিটিশ সরকার বার্ষিক এক লক্ষ টাকা বরাদ্দের কথা বলে এবং ১৮২৩ সালে শিক্ষাপ্রণালি স্থির করার জন্য একটি কমিটি গঠন করে। ১৮৩৫ সালে উক্ত কমিটি পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করে। ইতিপুর্বে ১৮২৬ সালে মুর্শিদাবাদে ইংরেজি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও ১৮২৯ সালে কলকাতা মাদ্রাসায় ইংরেজি ক্লাস শুরু হলে ক্রমেই ইংরেজি শিক্ষার অগ্রগতি সাধিত হয়। এ অগ্রগতি ও পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের নীতিমালা গহীত হওয়ায় ১৮৫৪ সালে ইংল্যান্ডে বাের্ড-অব-কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উড (Charles Wood) বাংলা তথা ভারতে ইংরেজির মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করে সরকারি নীতিমালা ঘােষণা করেন। এরপর থেকেই বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা দ্রুত প্রসার লাভ করে।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ছিল সময়ের চাহিদা ও বুদ্ধিদীপ্ত মননশীলদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফসল। এক্ষেত্রে খ্রিস্টান মিশনারি, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি মনীষী ও সরকারি কর্তৃপক্ষের গৃহীত নীতিমালা প্রভৃতির সমন্বিত যােগসাজশে বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে।

Next Post Previous Post