উইলিয়াম বেন্টিনঙ্কের অবদান বা সংস্কার সমূহ।

বাংলার ইতিহাসে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিনঙ্কের অবদান বা সংস্কার সমূহ আলোচনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : বাংলার ইতিহাসে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের অবদান ছিল অপরিসীম। বেন্টিঙ্ক ছিলেন একজন প্রজাহিতৈষী শাসক। হুইগ আদর্শে বিশ্বাসী বেন্টিঙ্ক মনে করতেন, বাংলার জনসাধারণের প্রতি ইংরেজ সরকারের নৈতিক কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে। এজন্য তিনি বাংলায় একটি সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এছাড়া তিনি সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধকরণ, ঠগি দমন, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন প্রভৃতি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের পরিচয় :

লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ভারতের গভর্নর জেনারেল ছিলেন। তার পুরাে নাম ছিল। লর্ড উইলিয়াম হেনরি ক্যাভেন্ডিস বেন্টিঙ্ক। তবে তিনি লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি ১৭৭৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের বাকিংহামশায়ারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম ক্যাভেন্ডিস বেন্টিঙ্ক ও ডরোথি বেন্টিঙ্কের দ্বিতীয় সন্তান। মাদ্রাজের গভর্নর হিসেবে ১৮০৩ সালে তিনি প্রথমে ভারতে আসেন এবং ১৮০৬ সালে ভেল্লোরে সিপাহিদের বিদ্রোহের কারণে ১৮০৭ সালে তাকে স্বদেশে ডেকে পাঠানাে হয়। প্রায় দু'দশক পর তাকে বাংলার গভর্নর জেনারেল হিসেবে নিয়ােগ দেওয়া হয় এবং তিনি ১৮২৮ সালে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৮৩৩ সালের সনদ আইন দ্বারা পরে তাকে ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে পুনরায় নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি ১৮২৮-১৮৩৫ সাল পর্যন্ত ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভারতবর্ষে লর্ড বেন্টিঙ্কের সাত বছরের স্বল্পকালীন শাসনকাল ছিল ঘটনাসমৃদ্ধ। একটি সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন, শাসনকার্যে ভারতীয়দের অংশগ্রহণ করার সুযোগ বৃদ্ধি, জনহিতকর সংস্কার যেমন- গঙ্গায় সন্তান ভাসিয়ে দেওয়া এবং সতীদাহ নিষিদ্ধকরণ, ঠগি দমন, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন প্রভৃতির জন্য বেন্টিনঙ্কের শাসনকাল ভারতের ইতিহাসে সমধিক প্রসিদ্ধ হয়ে আছে । এ সংস্কারগুলোর জন্য অনেকে বেন্টিঙ্ককে উদার শাসক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ১৮৩৫ সালে বেন্টিঙ্ক অবসর নেন এবং ১৮৩৯ সালের ১৭ জুন ৬৪ বছর বয়সে তার মুত্যু হয়।

বাংলার ইতিহাসে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের অবদান

বাংলার ইতিহাসে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের অবদান সম্পর্কে নিম্নে আলােচনা করা হলাে :

বাংলা প্রেসিডেন্সিকে বিভক্তকরণ :

লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সমগ্র বাংলা প্রেসিডেন্সিকে ২০টি ডিভিশনে ভাগ করেন। তিনি কয়েকটি জেলার সমন্বয়ে একটি ডিভিশন গঠন করে সেখানে কমিশনার নামে সৃষ্ট একজন নতুন কর্মকর্তাকে নিযুক্ত করেন। এ কমিশনারের দায়িত্ব ছিল জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, জজ ও পুলিশের কাজকর্ম তত্ত্বধান করা।

অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন :

লড বেন্টিঙ্ক বাংলা প্রদেশে ভূমি জরিপ ও রাজস্ব ব্যবস্থা দ্বারা অর্থনৈতক অবস্থার উন্নতি সাধন করেন। ইতিপূর্বে বাংলার যেসব জমি নিষ্কর দেখানো হয়েছিল, সেগুলাের উপর তিনি নতুন করে রাজস্ব নির্ধারণ করেন। এছাড়া তিনি মাদ্রাজে রায়তওয়ারি প্রথম প্রচলন ও আগ্রা অঞ্চলে ৩০ বছর মেয়াদি বন্দোবস্ত প্রথা চালু করে রাজস্ব বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করেন।

সতীদাহ প্রথার বিলোপ সাধন :

রাজা রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখ উদারপন্থী ব্যক্তিদের সহযােগিতায় লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর আইনের মাধ্যমে বাংলায় সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন। এর বিপক্ষে প্রাচীনপন্থিরা আপিল করলে বেন্টিঙ্ক কঠোরভাবে তা অগ্রাহ্য করেন।

ঠগি দমন :

লর্ড বেন্টিঙ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলাে ঠগিদের দমন করা। বেন্টিঙ্ক ঠগি দস্যুদের দমন করার জন্য একটি পৃথক প্রশাসনিক বিভাগ নামে একটি নতুন বিভাগ চালু করেন। এ বিভাগের প্রচেষ্টায় ১৮২৯-৩০ সালের মধ্যে ঠগি দস্যুদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে দমন করা হয়। ১৮৩১ থেকে ১৮৩৭ সাল পর্যন্ত ৩ হাজার ঠগিকে গ্রেফতার করা হয় । বেন্টিঙ্ক কঠোরতা অনুসরণ করে ঠগি দমনে সম্পূর্ণ সফল হন।

পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে উৎসাহ দান :

লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮৩৫ সালে বাংলায় ইংরেজি মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটানোর নীতি গ্রহণ করেন এবং সরকারি অর্থ শিক্ষার প্রসারের জন্য ব্যয় করার নীতি গ্রহণ করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের নৈতিক ও আদর্শপূত চরিত্রের স্ফুরণের জন্য প্রয়ােজন প্রগতিমূলক শিক্ষা। আর এ শিক্ষা একমাত্র পাশ্চাত্য তথা ইংরেজির মাধ্যমেই সম্ভব। আর এজন্য তিনি বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে উৎসাহ দান করে সমাজে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধনের চেষ্টা করেন।

সংবাদপত্রের অবাধ প্রসারের পথ উন্মুক্তকরণ :

সংবাদপত্রকে সমাজের দর্পণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সংবাদপত্রের মাধ্যমে জনসমাজের আশা-আকাঙ্কা ও দাবি-দাওয়া প্রতিফলিত হয় বেশি মাত্রায়। কিন্তু ভারতীয় জনসমাজের ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায়ের পথ রুদ্ধ করার জন্য পূর্ববর্তী গভর্নর জেনারেলরা সংবাদপত্রের উপর বিভিন্ন বিধি-নিষেধ আরােপ করে একপ্রকার সংবাদপত্রের কন্ঠ রােধ করেছিলেন। কিন্তু লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সংবাদপত্রের উপর থেকে বিধি-নিষেধ লাঘব করে সংবাদপত্রের অবাধ প্রসারের পথ উন্মুক্ত করেন।

গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন নিষিদ্ধকরণ :

তৎকালীন হিন্দুসমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকজন তাদের প্রথম সন্তানকে পুণ্যার্থে গঙ্গায় বিসর্জন দিতেন। বেন্টিঙ্ক এ অমানবিক প্রথা সম্পূর্ণরপে নিষিদ্ধ করেন। এমনকি নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান করেন। ফলে সমাজদেহ থেকে গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন প্রথা দূরীভূত হয়।

মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা :

লর্ড বেন্টিঙ্ক তার ভারতীয় প্রজাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য ১৮৩৫ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এর পর লর্ড বেন্টিঙ্কের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষা ও সভ্যতা বিস্তারের পথ উন্মুক্ত হয়। তাছাড়া ইংরেজ শাসকদের মধ্যে তিনিই এ উপমহাদেশে সংবাদপত্রের উপর জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেন।

বিচার ব্যবস্থার উন্নতি সাধন :

লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক দ্রুত বিচারকার্য সমাধানের জন্য ১৮২৯ সালে রাজস্ব ও বিচার বিভাগের কমিশনার নিযুক্ত করেন। কমিশনারদের অধীনে ম্যাজিস্ট্রেট অথবা বিচারকরা বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। তিনি ১৮৩২ সালে সর্বপ্রথম জুরি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন এবং ভারতীয়দের জুরির সদস্য নিযুক্ত করেন। এভাবে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিস্ক বিচারব্যবস্থার উন্নতি সাধনে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন।

উপসংহার :পরিশেষে বলা যায় যে, লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক বাংলার ইতিহাসে নানাবিধ অবদানের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। তার আগমন ভারত তথা বাংলার ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল। তিনি বাংলায় একটি সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ফলে বাংলা একটি উন্নত রাজ্যে পরিণত হয়।

Next Post Previous Post