হিন্দু বিধবাবিবাহ আইনের প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব আলোচনা।
হিন্দু বিধবাবিবাহ আইনের প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব আলােচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : উনিশ শতকে বাঙালি হিন্দুসমাজে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আবির্ভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। তিনি তৎকালীন হিন্দুসমাজের সকল অব্যবস্থাপনাপূর্ণ সামাজিক কাঠামাে, সামাজিক কুসংস্কার ও নৈতিক অবক্ষয় নিরসনের মূলে কুঠারাঘাত করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বৃহত্তর সামাজিক সংস্কারের মধ্যে হিন্দু বিধবাবিবাহ আইন ছিল অন্যতম। সে সময় হিন্দুসমাজে বিধবাদের জীবন ছিল অত্যন্ত দুর্বিষহ। হিন্দু বিধবাদের দুরবস্থার কথা চিন্তা করে হিন্দুবিধবা বিবাহ আইনের প্রয়ােজনীয়তা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিশেষভাবে উপলব্ধি করেন।
হিন্দু বিধবাবিবাহ আইনের প্রেক্ষাপট
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী সামাজিক সংস্কার আন্দোলন হলো বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের আন্দোলন। কেননা হিন্দু বিধবাদের করুণ দশা ও অবর্ণনীয় কষ্ট-ক্লেশ বিদ্যাসাগরের মনে পীড়া দিত। সংস্কৃত কলেজে ছাত্রাবস্থায় বিদ্যাসাগর সমাজের অবক্ষয়, কুসংস্কার এবং মাতৃজাতির দুর্দশার কথা উপলব্ধি করেন । তিনি বিধবাবিবাহ সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াস চালান। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম ১৮৮৫ সালে "বিধবাবিবাহ এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব" নামক পুস্তক রচনার মাধ্যমে বিধবাবিবাহের সপক্ষে প্রচার কার্য শুরু করেন। এর ফলে রক্ষণশীল হিন্দুদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ দেখা দেয়। তবে বিধবাবিবাহের বিরোধী গোঁড়া ও রক্ষণশীল হিন্দুগণ বিদ্যাসাগরের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। যদিও বিদ্যাসাগর এতে মােটেই ভীত বা বিচলিত হন নি, তবে ইয়ংবেঙ্গল গােষ্ঠী ও প্রকৃত সংস্কারকামী কিছু নেতা বিদ্যাসাগরকে সমর্থন করেন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা থেকেও তাকে সমর্থন জানানো হয়। বিদ্যাসাগরের পূর্বে বিধবাবিবাহ সম্পর্কে অনেকে চেষ্টা করলেও সফল হয় নি। কিন্তু বিদ্যাসাগরের মতো যুক্তিবাদী দৃষ্টি এবং নিষ্ঠাভরে, নিঃস্বার্থভাবে নিছক আদর্শবাদ ও মানবতাবাদের জন্যে এর আগে কেউ বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের চেষ্টা করেন নি। তীব্র বিতর্কে বঙ্গ সমাজ আলোড়িত হতে থাকে। এ সময় বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহের সমর্থনে (১৮৫৫ সাল) তার দ্বিতীয় পু্স্তিকা প্রকাশ করেন।
ড. অমলেশ ত্রিপাঠীর মতে, "বিদ্যাসাগর সমাজের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করেন নি, সমাজের কুপ্রথার বিরুদ্ধে তিমি সংগ্রাম চালান।" ১৮৫৫ সালে বিধবাবিবাহ কে আইনসিদ্ধ করার জন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রায় এক হাজার স্বাক্ষরসহ সরকারের কাছে আবেদন পাঠান। অপরদিকে রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের নেতা রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে বহু ব্যক্তির স্বাক্ষরসহ বিধবাবিবাহ প্রচলন না করার জন্য আবেদনপত্র পেশ করা হয়। অবশেষে সরকার ১৮৫৬ সালে ১৫নং রেগুলেশন জারি করে হিন্দু বিধবাবিবাহ আইন বলে ঘোষণা করেন।
হিন্দু বিধবাবিবাহ আইনের গুরুত্ব :
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক সমাজসংস্কারমূলক কর্মকান্ডের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো হিন্দু বিধবাবিবাহের প্রচলন। নিম্নে হিন্দু বিধবাবিবাহ আইনের গুরুত্ব আলোচনা করা হলাে :
বাংলায় প্রথম হিন্দু বিধবাবিবাহের সূচনা :
উনিশ শতকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো যুক্তিবাদী এবং নিষ্ঠাভরে, নিঃস্বার্থভাবে ও মানবতাবাদের জন্য এর আগে কেউ বিধবাবিবাহের প্রবর্তনের চেষ্ঠা করেননি। তবে ১৮৫৬ সালে ৭ ডিসেম্বর হিন্দু বিধবাবিবাহ আইন পাসের পর বিদ্যাসাগরের তত্ত্বাবধানে বাংলায় সর্বপ্রথম বিধবাবিবাহের সূচনা হয়।
কালীমতী দেবী বিধবাবিবাহ সম্পন্ন :
১৮৫৬ সালে হিন্দু বিধবাবিবাহ আইনের ফলে বিদ্যাসাগর বিভিন্ন স্থানে বিধবাদের বিবাহ দিতে সক্ষম হন। তার পৃষ্ঠপােষকতায় সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র প্রথম কালীমতী দেবী নামে এক হিন্দু বিধবাকে বিবাহ করেন।
ভবসুন্দরী বিধবার বিবাহ সম্পন্ন :
১৮৭০ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পুত্র নারায়ণ চন্দ্রকে ভবসুন্দরী নামক এক বিধবার সাথে বিবাহ দেন। এ বিবাহ সম্পর্কে তিনি এক পত্রে লেখেন যে, "বিধবাবিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রথম সৎকর্ম। ইহজন্মে এটি অপেক্ষা অধিকতর কোনো সৎকর্ম করতে পারব, তার সম্ভাবনা নেই।"
বিধবাবিবাহকে সামাজিক রীতিতে পরিণত :
১৮৫৬ সালে হিন্দু বিধবাবিবাহ আইন পাস হওয়ার পূর্বে এ প্রথাটি সামাজিক রীতিনীতির সাথে ছিল সাংঘর্ষিক এবং বিপরীত। কিন্তু ১৮৫৬ সালে হিন্দু বিধবাবিবাহ আইন পাস হওয়ায় প্রথাটিকে সামাজিক রীতি বা সংস্কৃতিতে পরিণত করার লক্ষ্যে পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ব্যাপক পৃষ্ঠপাষকতা প্রদান করেন।
নারী মুক্তি আন্দোলনের পথ প্রশস্ত :
তৎকালীন হিন্দুসমাজে নারীদের সামাজিক সীমাবদ্ধতা এবং স্বাধীনতা ছিল খুবই সামান্য। কিন্তু ১৮৫৬ সালে বিধবাবিবাহ আইন প্রণীত হওয়ায় বাংলার নারীরা যথেষ্ট সম্মান ও মর্যাদা অর্জন করে। যার ফলে নারী মুক্তি আন্দোলনের একটি নতুন মাত্রা সৃজিত হয়, যা বাংলার নবজাগরণের ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজসংস্কারের ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সবচেয়ে আধুনিক প্রগতিশীলমূলক পদক্ষেপ হলাে হিন্দু বিধবাবিবাহ প্রবর্তন। তৎকালীন হিন্দুসমাজে বিধবাবিবাহকে আইনে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য তিনি নিরলস পরিশ্রম করেন। তবে বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলন সফল না হলেও এর ফলে হিন্দুসমাজে যে আবর্তের সৃষ্টি হয়, তার ফলে নারী মুক্তি আন্দোলনের যৌক্তিকতা স্বীকৃতি পায়, যা বাংলার নবজাগরণের ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।