ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শিক্ষানীতি।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শিক্ষানীতি সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : কোম্পানি শাসনের তত্ত্বাবধানে পাশ্চাত্য ধরনের স্কুল প্রতিষ্ঠা, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশ প্রভৃতির ভিতর দিয়ে উনিশ শতকে বাংলায় শিক্ষা বিস্তার আরম্ভ হয়। এ পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিতরাই বাংলায় নবজাগরণের সূচনা ঘটিয়েছিল যা পরবর্তী সময়ে নিজ অধিকারবোধের জন্ম দিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের উন্মেষ ঘাটায়।
ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গৃহীত শিক্ষানীতি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রাথমিক শিক্ষানীতি
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রাথমিক অবস্থায় জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হবে এ অজুহাতে ইংরেজ শিক্ষা প্রবর্তনে অনীহা প্রকাশ করে। তবে আঠারাে শতকের শেষদিকে ব্রিটেনে স্যার চার্লস গ্রান্টের নেতৃত্বে ভারতবর্ষে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে এক আন্দোলনের সূচনা হয়।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নতুন শিক্ষা নীতি
প্রাচ্যবাদী গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস এদেশীয় বিদ্যাচর্চার অবনতি রোধ এবং ইংরেজ ও এদেশবাসীর মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৭৮০ সালে কলকাতায় আরবি ভাষার জন্য একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। রেসিডেন্ট জোনাথন ডানকান ১৭৯২ সালে বারানসিতে সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করেন। ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
মিশনারিদের শিক্ষা কার্যক্রম
১৭৯৩ সালের চার্টার আইনে খ্রিস্টান মিশনারিগণ ভারতে আসার অনুমতির জন্য শর্ত সংযুক্তির আবেদন করেন। বহু বিতর্কের পর ১৮১৩ সালের নবায়নকৃত চার্টারে মিশনারিরা ভারতে আসার অনুমতি লাভ করেন। ১৮১৩ সালে খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা এদেশে এলে বসবাসের অনুমতি এবং এদেশে ইউরোপীয় ধারার শিক্ষা বিস্তারের জন্য বার্ষিক এক লক্ষ টাকা ব্যয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে ১৮২৩ সালে শিক্ষাপ্রণালি স্থির ও বরাদ্দকৃত ব্যয়ের জন্য General Committee of Public Instruction নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির সুপারিশক্রমে ১৮২৬ সালে হিন্দু কলেজে একং ১৮২৯ সালে কলকাতা মাদ্রাসায় ইংরেজি ক্লাস চালু করা হয়।
শিক্ষা বিষয়ে বিতর্ক
লর্ড বেন্টিঙ্ক শিক্ষা পদ্ধতির বিষয়ে ঘােষণা দিলেও শিক্ষা কমিটির সদস্যদের মধ্যে পূর্ব থেকেই মতভেদ ছিল। ১৮৩৫ সালে গভর্নর জেনারেলের আইনসভার সকল সদস্য ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্বের উপর সুদীর্ঘ বক্তব্য পেশ করেন। ফলে পুনরায় ১৮৩৫ সালের ৭ মার্চ সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়।
উডের ডেসপাস ১৮৫৪
শিক্ষা কাউন্সিলের সভাপতি স্যার চার্লস উড শিক্ষার ক্ষেত্রে কতকগুলো নীতি প্রবর্তন করেন।এগুলো "উডের ডেসপ্যাস" নামে পরিচিত। এতে বলা হয়….
- (ক) শিক্ষার জন্য একটা পৃথক শাসন বিভাগের (Separate Department of the Administration for Education) সৃষ্টি
- (খ) কলকাতা, বােম্বাই ও মাদ্রাজ শহরে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা।
- (গ) সকল শ্রেণীর বিদ্যালয়ের শিক্ষকের শিক্ষার জন্য নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপন।
- (ঘ) বর্তমানে যে সকল সরকারি স্কুল ও কলেজ আছে তার পরিচালনার সুব্যবস্থা ও প্রয়োজনে সেগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি।
- (ঙ) নতুন নতুন মাধ্যমিক স্কুলের প্রতিষ্ঠা।
- (চ) প্রাথমিক শিক্ষার জন্য যে সকল পাঠশালা আছে সেগুলোর উন্নতি সাধন।
- (ছ) বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি, অর্থ দানের ব্যবস্থা।
- (জ) সাধারণ লোকের জীবিকা উপার্জনের উপযোগী কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা
- (ঝ) মেধাবী ছাত্ররা যাতে ক্রমশ উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে পারে সেজন্য বৃত্তি দানের ব্যবস্থা।
- (ঞ) উচ্চশিক্ষা ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে এবং প্রাথমিক ও নিম্নশ্রেণীর শিক্ষা বাংলা ভাষার মাধ্যমে দেওয়ার সিদ্ধান্ত।
- (ট) স্ত্রী শিক্ষার উন্নতির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা ও সরকারি সাহায্য দান।
- ঠ) সকল প্রকার সরকারি চাকরিতেই অশিক্ষিত অপেক্ষা শিক্ষিতদের অধিকতর দাবি প্রতিষ্ঠা
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা ছিল মুসলমানদের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যহীন এবং ধর্মীয় ভাবধারার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। তাই মুসলমানরা ইংরেজ তথা পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহনে অনাগ্রহ দেখায়। ফলে কোম্পানির গৃহীত শিক্ষানীতিতে হিন্দুরা বেশ লাভবান হলেও মুসলমানরা বাস্তবিকই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।