পেরেস্ত্রোইকা ও গ্লাসনস্ত কি।

পেরেস্ত্রোইকা ও গ্লাসনস্ত বলতে কি বুঝায় বিস্তারিত আলোচনা কর।

পেরেস্ত্রোইকা

সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে মিখাইল গর্বাচেভের আগমনের পর (১৯৮৫) দেশ ও পার্টির সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে ব্যাপক সংস্কারমূলক কর্মসূচি "পেস্ত্রোইকা' হাতে নেয়া হয়েছিল। পেরেস্ত্রইকায় প্রধান যে বিষয়গুলাে হাতে নেয়া হয়েছিল তা হলাে: ১. অর্থনৈতিক সংস্কার; ২. সামাজিক অগ্রগণ্যতা; ৩. রাজনৈতিক গণতন্ত্রায়ন; ৪. পার্টির ভূমিকা সংশােধন; ৫. মতাদর্শ, ধর্ম ও সংস্কৃতির গুণবিন্যাস; ৬. অভ্যন্তরীণ ও জাতীয় সমস্যা সমাধান; ৭, পররাষ্ট ও প্রতিরক্ষা নীতিতে পরিবর্তন। উপর্যুক্ত বিষয়গুলাে সম্পর্কে ব্যাপক পুনর্গঠনের মাধ্যমে গরবাচেভ পূর্ব ইউরোপে এক নতুন ধারার সূচনা করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। তিনি তাঁর বহুল প্রচারিত 'পেরেস্ত্রোইকা -তে লিখেছেন- "বহুবার আমি ব্যাখ্যা করেছি যে পশ্চিমী স্বার্থবিরােধী কোনাে লক্ষ আমরা অনুসরণ করি না। আমরা জানি যে মার্কিন ও পশ্চিম ইউরােপীয় অর্থনীতির পক্ষে প্রধানত কাঁচামালের উৎস হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, ল্যাতিন আমেরিকা অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের এলাকা এবং এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকা কত গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্পর্কে ছেদ ঘটাবার কথা আমরা চিন্তাও করি না এবং ঐতিহাসিক কারণে সৃষ্ট পারস্পরিক অর্থনৈতিক স্বার্থের হানি ঘটাবার কোনাে অভিপ্রায় আমাদের নেই।" (পেরেস্ত্রোইকা ও নতুন ভাবনা : আমাদের দেশ ও সমগ্রবিশ্ব। মনীষা প্রকাশনী পৃ. ১২০)

গ্লাসনস্ত

সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়নে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পুনর্গঠনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তার জন্য রাজনৈতিক সংস্কার ও গণসমর্থন প্রয়ােজন ছিল । আর এজন্য গ্লাসনস্ত নীতি গ্রহণ করা হয়। গ্রাসনস্তের আওতায় রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থায় যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়েছিল তা হলো- ১. সকল পর্যায়ে নির্বাচিত পদে পর পর দুবারের বেশি কেউ নির্বাচিত হতে পারবে না; ২. কংগ্রেস অব পিপলস ডেপুটি হবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব এবং এর সদস্য সংখ্যা হবে ২২৫০; ৩. ডেপুটিদের মধ্যে থেকে একটি স্থায়ী কার্যনির্বাহী সুপ্রীম সােভিয়েত নির্বাচিত হবে; ৪, কংগ্রস অব পিপলস ডেপুটি গােপন ব্যালটে রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে। গরবাচেভের এই নীতি নানা কারণে বিতর্কিত ছিল। অভিযােগ আছে, ১৯৮৫ সালে গরবাচেভ ক্ষমতায় আসার পর তিনি পূর্ব ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক ঐক্য দৃঢ় না করে বরং পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপকে একীভূত করার জন্য ইউরোপের অভিন্ন বাসভূমির কথা বলেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন এর মাধ্যমে সমগ্র ইউরোপের ঐক্য ও সংহতি বাড়বে। কিন্তু প্রকারান্তরে তার এই নীতি পূর্ব ইউরোপের ঐক্যে চির ধরায়। গরবাচেভ পূর্ব ইউরােপ সম্পর্কে দীর্ঘদিনের গড়া সোভিয়েত নীতিকে পরিত্যাগ করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ মনে করতেন পূর্ব ইউরোপের সােভিয়েত প্রভাবাধীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুঁজিবাদী বিশ্ব কর্তৃক প্রভাবিত হলে সােভিয়েত ইউনিয়নের সেখানে হস্তক্ষেপের অধিকার রয়েছে। গরবাচেভ এই নীতি হতে সরে এসে নতুন নীতি ঘোষণা করেছিলেন । তাঁর এই উদারনীতির ফলে পােল্যান্ডে অ-কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও গরবাচেভ পােল্যান্ডের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেননি। এভাবে গরবাচেভের সংস্কারনীতির ফলে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলােতে সমাজতন্ত্র বিরােধী শক্তি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সুযােগ পায়। এদেরকে ইন্ধন দেয় পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্ব। আর এভাবেই সমাজতন্ত্রের পতনের আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়, ইউরােপের দেশগুলোতে একের পর এক সমাজতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটতে শুরু হয়। এই পতনের জন্য গরবাচেভের নীতি বা সাবেক সাভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্যবাদী নীতি কতটুকু দায়ী ছিল, তা হয়তাে আগামিতে বােঝা যাবে। তবে পূর্ব ইউরােপের সাধারণ মানুষেবর মনে সােভিয়েত ইউনিয়নের ব্যাপারে কিছুটা হলেও বিদ্বেষ মনােভাব ছিল। পূর্ব ইউরোপের বেশ কিছু দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় সােভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক হস্তক্ষেপের পর এই বিদ্বেষ মনােভাব তৈরি হয়েছিল।

Next Post Previous Post