স্নায়ুযুদ্ধ-সংজ্ঞ, বৈশিষ্ট্য, কারণ, উৎস ও বিকাশ।
স্নাযুযুদ্ধ বা ঠাণ্ডা লড়াই কি? স্নায়ু যুদ্ধের কারণ, বৈশিষ্ট্য, উৎস ও বিকাশ আলোচনা কর।
In the aftermath of the Second World War, there began a massive reorganization of the world...we are living through an era of the most extensive and intensivc political change in human history..our gencration is living through a genuine global political awakening.Zbigniew Brzezinski, I1979
[Any United States President] must embrace both deterrence and coexistence, both containment and an effort to relax tensions.Henry A. Kissinger, 1982
আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইতিহাসে "ঠান্ডা লড়াই" বা 'Cold war' একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযু্দ্ধোত্তর বিশ্বরাজনীতির চালিকাশক্তি ছিল এই 'ঠান্ডা লড়াই'। আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতি-প্রকৃতি, বিশ্বের দুই পরাশক্তির মধ্যকার দ্বন্দ্ব ইত্যাদি সবকিছুই এই ঠান্ডা লড়াইকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। মূলত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্ব-রাজনীতি ও ঠান্ডা লড়াই অনেকটা সমার্থক হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রগুলাের মধ্যে সম্পর্কের উত্থান-পতন, উত্তেজনা ও দ্বন্দ্ব সব কিছুর মূলে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে দায়ী ছিল ঠান্ডা লড়াই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে যুগপৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়নের "পরাশক্তি" বা "Super Power" হিসেবে আবির্ভাব ঘটে। উভয়ের মধ্যকার উত্তেজনার সময়কে "ঠান্ডা লড়াই" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই দুই পরাশক্তি সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়ে স্বীয় কুটনৈতিক তথা অর্থনৈতিক, সামরিক ও প্রচারণা শক্তির মাধ্যমে ক্ষমতা, প্রভাব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে এবং পৃথিবীকে দুটি পরস্পর বিরােধী শিবিরে বিভক্ত করে ফেলে। বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র এভাবে দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে একটি যুদ্ধোদ্যম অবস্থার সৃষ্টি করে।
বিশ্বের এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতির গুরুত্ব সম্পর্কে অধ্যাপক Mcbllan, Olson এবং Sonderman লিখেছিলেন,
The tension, which has been labelled 'Cold War' is a cardinal fact of international life in the mid 20" century and thus must affect any analysis of contemporary international.
এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় যে, ঠান্ডা লড়াই মূলত একটি "মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ" বা "PSychological War" যা দুটি বিরােধী মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ধৃত। এ দ্বন্দ্বের অর্থ ছিল সরাসরি প্রথাগত যুদ্ধে অবতীর্ণ না হয়ে একে অপরকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক কলা-কৌশলতভাবে পরাভূত করা। এ ঠাণ্ডা লড়াইয়ের দুই প্রতিপক্ষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়ন তাদের স্বীয় প্রভাববলয় বা "Sphare of Influence" বাড়ানাের প্রতিযােগিতায় নিয়ােজিত থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, যা চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে নব্বই-দশকের গােড়ার দিক পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
ঠাণ্ডা লড়াই : অর্থ ও প্রকৃতি
ইংরেজি 'cold war' শব্দের বাংলায় বিভিন্ন প্রতিশব্দ রয়েছে। এগুলাে হচ্ছে- 'ঠাণ্ডা লড়াই', 'স্নায়ুযুদ্ধ', শীতল যুদ্ধ, 'প্রচার যুদ্ধ (Propaganda war) ইত্যাদি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে দুটি পরস্পর বিরােধী রাষ্ট্র-জোট প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ না হয়ে পরস্পরের প্রতি যে যুদ্ধভাব বিরাজ করছিল বা সংগ্রামে লিপ্ত ছিল তাকেই 'ঠাণ্ডা লড়াই' বলে অভিহিত করা হয়। এভাবে 'যুদ্ধও নয়, শান্তিও নয়' সাধারণত এ ধরনের সম্পর্ককে বলা হয় 'Cold war Relationship' । কাজেই ঠাণ্ডা লড়াই ছিল দুই জোটের মধ্যে এমন একটি যুদ্ধোন্মাদ সম্পর্ক, যে সম্পর্ক যুদ্ধ সৃষ্টি করেনি, কিন্তু যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছিল।
উল্লেখ্য যে, ঠাণ্ডা লাড়াইয়ের ইঙ্গিত আমরা পাই উইনস্টন চার্চিলের ১৯৪৬ সালের ৫ মার্চ ওয়েস্ট-মিনিস্টার কলেজের এক বক্তৃতার মাধ্যমে। অবশ্য চার্চিল সরাসরি 'Cold war' কথাটি ব্যবহার করেননি। কিন্তু তিনি বলতে চেয়েছিলেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে মৈত্রীর বন্ধন স্থাপিত হয়েছিল তা অবলুপ্ত হতে চলেছে। তার পরিবর্তে সৃষ্টি হয়েছে সন্দেহ, হিংসা ও অবিশ্বাস। চার্চিল ছাড়া অন্য একজন Cold war শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি হলেন বার্নাড বারুচ, যিনি মূলত একজন আমেরিকান ব্যবসায়ী ছিলেন। পরে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তিনি বলেছিলেন,
Let us not be deceived today we are in the midst of the Cold War.
তবে আমেরিকার ওয়াল্টার লিপম্যান-এই 'Cold War' শব্দটি সংবাদপত্রে প্রথম ব্যবহার করেন। এ শব্দের মাধ্যমে তিনি আমেরিকা ও সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সম্পর্ক বােঝাতে চেয়েছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে বেশ সন্দেহ ও ভীতি।
cold war বা ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সংজ্ঞা
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ঠাণ্ডা লড়াইকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এ লড়াইকে পরাশক্তিবর্গের মধ্যে পরােক্ষ লড়াই বা 'Indirect war' বলে অভিহিত করা হয়েছিল। একে আবার পরস্পর বিরোধী রাষ্ট্রের মধ্যে প্রকৃত লড়াইয়ের পরিবর্তে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অনেকে ঠাণ্ডা লড়াই বলতে পরাশক্তিগুলোর মাঝে পরস্পর বিরােধী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকে নির্দেশ করে । এই প্রসঙ্গে International world book of Encyclopedia-এর উদ্ধৃতি প্রণিধানযােগ্য। এতে বলা হয়....
Cold War is the struggle for power and influence between the Comnunist nations and the western allies led by the United States.
ঠাণ্ডা লড়াইয়ের বৈশিষ্ট্য
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এই 'ঠাণ্ডা লড়াই-কে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। এই ঠাণ্ডা লড়াইয়ের কতকগুলো বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। যেমন:
১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই ও যুদ্ধের মূল কথা। আর ঠাণ্ডা লড়াইয়ের রাজনীতিকে "Bipolar Politics" বা দ্বিপক্ষীয় রাজনীতিও বলা হয়;
২. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়ন উভয়েই বিভিন্ন রাষ্ট্রের উপর প্রভাব বিস্তার করতে এবং তাদের সাহায্য ও সহযাগিতা লাভ করতে বিশেষভাবে সচেষ্ট হয়;
৩. উভয় পক্ষই স্নায়ু যুদ্ধ' সম্বন্ধে তাদের নীতিকে রাজনৈতিক মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একদিকে গণতন্ত্র ও ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে 'ঠাণ্ডা লড়াই' পরিচালনা করে। অপরদিকে, সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদ বিরােধিতার নামে ঠাণ্ডা লড়াই পরিচালনা করে । তার ফলে এটি অনেক পরিমাণে ঠাণ্ডা লড়াই-এর রূপ ধারণ করে এবং উভয় পক্ষই প্রচারণার উপর বেশ গুরুত্ব আরােপ করে;
৪. ঠাণ্ডা লড়াইয়ে দুপক্ষই যথাসম্ভব সামরিক প্রস্তুতি বাড়ানোর সত্ত্বেও প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বিরত থাকে। এ লড়াইকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অঞ্চলে দুপক্ষের বন্ধু রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হলেও উভয় পক্ষই যুদ্ধকে সেই অঞ্চলে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য চেষ্টা করে;
৫. ঠাণ্ডা লড়াই মূলত সামরিক ও জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যুতে অধিক গুরুত্ব প্রদান করে যা পূর্ব ও পশ্চিম এ দুটি বিবাদমান শিবিরে বিভক্ত করে।এই প্রসঙ্গে Kengly এবং witkopt-এর মন্তব্য প্রণিধানযােগ্য। তাঁদের মতে,
The East- West conflict is essentially a struggle among those at the top of the international hierarchy for preeminent status, with each side seeking to protect its own position while gaining advantage in its relations with, and often at the expense of the other.
এভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক পরস্পর বিরোধী হয়ে ওঠে এবং ঠাণ্ডা লড়াই' পূর্ণউদ্যমে অব্যাহত থাকে। সমগ্র বিশ্ব এক অনভিপ্রেত যুদ্ধের চাপে ভীত ও সন্ত্রস্ত হয় পড়ে।
ঠাণ্ডা লড়াইয়ের কারণ
ঠাণ্ডা লড়াইয়ের প্রধান কারণগুলো ছিল নিম্নরূপ :
প্রথমত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপের যেসব অঞ্চলে বিভিন্ন মিত্রশক্তি প্রবেশ করে তারা সেখানে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে নিজেদের আধিপত্য স্থাপন করার চেষ্টা করে। সােভিয়েত ইউনিয়ন এর সদ্ব্যহার করতে সচেষ্ট হয়। অপরদিকে, যুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলাে দুর্বল হয়ে পড়ায় তাদের মধ্যে সােভিয়েত ভীতি বিশেষভাবে সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম ইউরোপের সাথে চুক্তি স্থাপন করে সােভিয়েত বিরােধী এক জোট সৃষ্টি করে।
দ্বিতীয়ত, আদর্শগত সংঘাতও ঠাণ্ডা লড়াইয়ের জন্ম দেয় আমেরিকা তথা পশ্চিমা বিশ্বের ধনবাদী আদর্শ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক আদর্শের দ্বন্দ্ব এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এ সম্পর্কে Prof. y.K. Malhora-এর মন্তব্য প্রণিধানযাগ্য। তিনি বলেন,
The United States foreign policy became deadly against communism. lis actions highly competitive and confrontationist toward the Soviet Union. This interpretation thus sees the cold war as fuelled by historic antagonism between diametrically opposed systems of belief.
তৃতীয়ত, প্রযুক্তিগত উন্নতির সাথে সাথে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ক্ষেত্রে এই প্রতিযােগিতা পরিলক্ষিত হয়, অস্ত্রসজ্জার ক্ষেত্রেও এটা দেখা যায়।
চতুর্থত, পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস এই মনস্তাক্ত্বিক কারণের জন্যও ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, আণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণে সাোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকান মনোভাব উভয়ের মধ্যে এক ধরনের সন্দেহ সৃষ্টি করেছিল
পঞ্চমত, তৃতীয় বিশ্বের স্বাধীন জাতিগুলাে নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তার খাতিরে বৃহৎ শক্তিবর্গের ছত্রছায়ায় থাকতে চেয়েছিল। এই নেতৃত্ব লাভের জন্য আমেরিকা ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে প্রতিযােগিতা শুরু হয় এবং ঠাণ্ডা লড়াই দেখা দেয়।
ঠাণ্ডা লড়াইয়ের উৎস ও বিকাশ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি হয়েছিল ঠাণ্ডা লড়াইয়ের দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের সূত্রপাতের মধ্য দিয়ে। এ দুটি উপাদান ছিল যথাক্রমে রুশ-মার্কিন দ্বন্দ্ব এবং পরমাণু অস্ত্রের প্রসার। এ প্রসঙ্গে Peter Calvocoressi লিখেছেন,
The Second World War ended with an act which contained the two central elements in the cold war the advent of nuclear weapons and Russo-American rivalry.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে দুটো পরাশক্তির মাঝে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের উৎস অনুসন্ধান করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সনাতন বৃহৎশক্তিগুলোর মধ্যে নাৎসি জার্মানি ও জাপানের পরাজয় এবং ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্রচুর ক্ষতি ও ধ্বংসসাধন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়নকে পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে সাহায্য করে। সামরিকভাবে তাদের কোনাে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না, কিন্তু স্বার্থ ছিল বিশ্বব্যাপী। যদিও তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একত্রে যুদ্ধ করেছে তবু তাদের মধ্য প্রকৃত কোনো মিল বা বন্ধন ছিল না। উল্লেখ্য যে, হিটলারের আক্রমণই তাদেরকে একটি অসাধারণ মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ করেছিল। কিন্তু এ সময়ও তাদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সন্দেহ পরিলক্ষিত হয়। তবে যুদ্ধ চলাকালীন এ সম্পর্ক ভেঙে যায়নি, কারণ অক্ষ শক্তিসমূহের (Axis Powers) বিশেষত হিটেলারের বিরুদ্ধে তাদের সাধারণ ভীতি ও বিপদই তাদেরক ঐক্যবদ্ধ করে রেখেছিল । হিটলারের পতনের সাথে সাথে তাদের মৈত্রী বন্ধনে ফাটল সৃষ্টি হয় এবং পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস শেষ পর্যন্ত ঠাণ্ডা লড়াইয়ে পরিণত হয়েছিল। অধ্যাপক V.K. Malhotra-এর মতে,
The hope of the optimists that unity and co-operation among the erstwhile warring nations would become a permanent feature after the war, was belived. The world was divided into two distinct political entities and thus cold war and bipolarization became an accomplished fact.
কেউ কেউ ঐতিহাসিকভাবে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের কারণ অনুসন্ধান করেছেন। অধিকাংশ পণ্ডিতদের মতে, ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাসে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে কমিউনিস্টদের ক্ষমতায় আসার মধ্যেই ঠাণ্ড লড়াইয়ের বীজ নিহিত ছিল। কারণ পুঁজিবাদী শক্তি রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে ভীত হয়ে পড়ে এবং পুঁজিবাদী বিশ্ব চ্যালেঞ্ছের সম্মুখীন হয়। এ মত অনুযায়ী ঠাণ্ডা লড়াই ছিল মূলত সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মধ্যে আদর্শের দ্বন্দ্ব। অনেকে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের মূল খুঁজতে গিয়ে বলেন যে, ১৮৭০ সালে জার্মানি ও ইতালির একীকরণের ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে 'শক্তি সাম্যের' (Balance of power) পরিবর্তন ঘটে এবং এ দুটো নতুন বৃহৎ শক্তির "আগ্রাসী মনােভাব" বৃহৎশক্তিবর্গের মধ্যে এক ধরনের দ্বন্দ্বের সূচনা করে যা পরবর্তীকালে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের রূপ পরিগ্রহের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করেছিল। কেউ কেউ বলেন, ১৯৪১ সালের ১৪ আগস্টে আটলান্টিক সনদের বা'The Atlantic Charter' ঘােষণার মধ্যেই এর বীজ নিহিত ছিল। ওই সময় রুশ নেতা জোসেফ স্ট্যালিনকে বাদ দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ভবিষ্যৎ বিশ্বব্যবস্থাকে গড়ে তােলার জন্য যে ঘােষণাবলি বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপিত করেছিলেন, তাতে রুশ নেতা কিছুটা রুষ্ট হয়েছিলেন বলে মনে হয়। কারণ তিনি পশ্চিমা নেতৃবৃন্দকে যে আগে থেকেই সন্দেহের চোখে দেখতেন তাঁকে বাদ দেয়ায় তাঁর সে সন্দেহ অনেকটা ঘনীভূত হয়েছিল। স্বভাবতই তিনি মনে করেছিলেন যে, পশ্চিমা শক্তিবর্গ কোনাে সময়ই সােভিয়েত ব্যবস্থাকে গ্রহণ করতে পারেনি এবং তার ধ্বংসসাধনের জন্য ছিল সর্বদা সচেষ্ট। তাঁর এ ধরনের চিন্তা-ভাবনাই তাদের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহকে বৃদ্ধি করে, যা পরবর্তীকালে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের পথকে প্রশস্ত করে। আবার অনেকের মতে, ঠাণ্ডা লড়াইয়ের প্রকৃত উদ্ভব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন রাশিয়া কর্তৃক তিনটি বাল্টিক প্রজাতন্ত্র লিথুনিয়া, লাটভিয়া এবং এস্তোনিয়ায় যে সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং যুদ্ধ শেষে তা নিজস্ব প্রজাতন্ত্রে অধিভুক্ত করেছিল, তা থেকে পূর্ব ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে বিরােধ গড়ে উঠে। আর এ থেকে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সূচনা হয়েছিল। বিশেষ করে রাশিয়া এ তিনটি প্রজাতন্ত্রকে নিজস্ব ভু-খণ্ডের সাথে অধিভুক্ত করে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামাে প্রতিষ্ঠা করেছিল যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে। এছাড়া ১৯৪৯ সালে প্রতিবেশী চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পূর্ব এশিয়াতে সমাজতন্ত্রের প্রসারকে গতিশীল করে। উভয় দেশ চীন ও রাশিয়া বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্র প্রসারের জোর প্রয়াস অব্যাহত রাখে। সােভিয়েত ইউনিয়ন মনে করত যে যুদ্ধোত্তর পৃথিবী মস্কোর নিয়ন্ত্রণাধীনে ক্ষমতা বৃদ্ধির এক অপূর্ব সুযােগ এনে দিয়েছে। ১৯৪৫ সালে নাৎসিবাদের পতনের পর মধ্য ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র বলে বিবেচিত দুটো নগরী- বার্লিন ও ভিয়েনা দখলের জন্য রাশিয়ার লালবাহিনীর ক্ষিপ্রগতিতে ধাবিত হবার মধ্যেই স্টালিনের আগ্রাসী মনােভাব পরিস্ফুট হয়। সুতরাং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই নাৎসিদের পরাজয় ও ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের ক্ষমতা অনেকটা নিঃশেষিত হবার ফলে বিশ্বব্যাপী যে শক্তি শূন্যতা বা 'Power vacuum' সৃষ্টি হয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজস্ব শক্তি দিয়ে তা পূরণে সচেষ্ট হয়। পক্ষান্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী সােভিয়েত আগ্রাসন রুখতে ছিল বদ্ধপরিকর। এভাবে দুই পরাশক্তির মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সূত্রপাত হয় । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিম ইউরােপীয় মিত্র দেশগুলাে সমাজতন্ত্রের এ আকস্মিক প্রসারে অত্যন্ত সংশয় বােধ করে। তারা সমাজতন্ত্রের সম্ভাব্য প্রসার প্রতিরােধ করতে রুশ ও চীনের বিরুদ্ধে "ধারক নীতি" বা "Policy of Containment" গ্রহণ করে। এ নীতির মূললক্ষ্য ছিল সমাজতন্ত্রের প্রসার রোধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।