দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও ফলাফল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলােচনা কর।

A fight for frecdom had begun, mighter than the earth had ever seen, for once Destiny had begun its course, the conviction dawned on even the broad masses that this time not the fate of Serbia or Austria was involved, but whether the CGerman nation was to be or not to be. Adolf Hitler (Mein kampf, 1943)

বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে আলােচিত ও দুঃখজনক ঘটনা হলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই যুদ্ধের স্থায়িত্ব ছিল ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। বিশ্ব যখন সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিক শােষণ থেকে মুক্ত হয়ে নতুনভাবে শান্তির শ্লোগান নিয়ে উনবিংশ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দীতে পদার্পণ করেছিল তখনই শান্তির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল নতুন সাম্রাজ্যবাদীদের উগ্র মানসিকতা আর যুদ্ধাংদেহী মনােভাব। জার্মানিসহ অন্য উগ্র- জাতীয়তাবাদী দেশগুলার মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দের কারণে বিশ্বযুদ্ধ নামে একটা নতুন মহাসমর বিশ্ববাসীকে নাড়া দিয়েছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা বিশ্বের বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষগুলাে বুঝতে পেরেছিল একটা আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন করতে না পারলে শান্তি আসবে না। সেই সংস্থা গঠিত হয়েছিল। কিন্তু লীগ অফ নেশনস বিশ্ববাসীর সেই আশা পূরণ করতে পারেনি। ১৯১৯ সালে ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত শক্তিুলােকে যেভাবে দমন করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তা পরবর্তীকাল সকল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়ী ব্রিটেন, ফ্রানস, পরাজিত জার্মানি, তুরস্ক যেন আর কোনাে দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না রাষ্ট্রকে আগের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর করে তুলেছিল পারে, সেজন্য তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল অনেক অন্যায়মূলক শর্ত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সারাবিশ্বে ব্যাপক্ভাবে অস্ত্র প্রতিযােগিতা লক্ষ করা গিয়েছিল। এর ফলে, সারাবিশ্বে এক ধরনের নৈরাজ্যবাদ লক্ষ করা যায় অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে তৎকালীন শক্তিশালী দেশগুলাে সারা বিশ্বকে তাদের বাজারে পরিণত করে রেখেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে আক্রমণাত্মক সাম্রাজ্যবাদীনীতি লক্ষ্য করা যায়।

১৯৩১ সালে জাপানের মাঞ্চুরিয়া দখল, ১৯৩৭ সালে ইতালির ইথিওপিয়া দখল, স্পেনের গৃহযুদ্ধ ইত্যাদি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে ওই সময় জটিল করে তুলেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত জার্মানজাতি তাদের পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে পারেনি। ইতালিতে মুসোলিনি কর্তৃক ফ্যাসিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সেখানে একটি যুদ্ধের মতাে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ অনুসন্ধান করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই ১৯১৯ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত যে সময়সীমা, সেই সময়সীমা নিয়ে আলােচনা করা প্রয়ােজন। কেননা ওই সময়সীমায় উল্লেখযােগ্য বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল, যা কি না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়।

প্রথমেই বলতে হয় দাওয়েস প্লান (The Dawes Plan) ও ইয়াং প্লানের (Young Plan) কথা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিপূরণের সমস্যার সমাধানের জন্য ১৯২৪ সালে দাওয়েসকে নিয়ে একটি কমিটি এবং ওই কমিটি ব্যর্থ হলে ১৯২৯ সালে জনৈক ইয়াংকে নিয়ে আরেকটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। ইয়ং পরিকল্পনায় জার্মানিকে ক্ষতিপূরণ দিতে (প্রায় ১০ কোটি পাউন্ড) বাধ্য করা হয়েছিল। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও অপরাপর বিজয়ী রাষ্ট্রের ন্যায় ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিল। যুদ্ধোত্তর ইউরােপে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বেশ কটি চুক্তি ও সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯২২ সালে অনুষ্ঠিত ওয়াশিংটন নৌ-সম্মেলনে জার্মানি ও তার মিত্রবাহিনীর নৌ বাহিনীর ক্ষমতা সীমিত করা হয়। অপরদিকে, ১৯৩১ সালের লন্ডন নৌ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও জাপানের মারণাস্ত্র সীমিত করার জন্য ছয়বছর মেয়াদি একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অন্যদিকে, ১৯২৫ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল লোকার্নো চুক্তিসমূহ (Locarno Treaties) (মােট ৭টি)। ওইসব চুক্তিতে জার্মানিকে লীগের স্থায়ী সদস্যের মর্যাদা, জার্মানিকে আলসেস-লোরেন ছেড়ে দেয়া, ফ্রান্সকে তার সম্প্রসারণনীতি পরিত্যাগ করা ও রাইনকে একটি 'বাফার অঞ্চল'-এ পরিণত করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল ১৯২৮ সালে প্যারিসে কেলগ-ব্রিয়ান্ড চুক্তি (Kellogg-Briand Pact) স্বাক্ষরিত হয়। তাতে "যুদ্ধকে জাতীয় নীতির প্রধান অঙ্গ" হিসেবে গণ্য না করার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৩৫ সালে নৌ-নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলেও, জাপান ওই সম্মেলন ত্যাগ করেছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে রাজতন্ত্রের অবসান ছিল একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। ১৯১৯ সালে স্থাপনকারী সােসাল ডেমােক্রেট পার্টির নেতা এবাটের নেতৃত্বে রাজতন্ত্রের অবসান হয় ও দেশটাকে সাধারণতন্ত্র হিসেবে ঘােষণা করা হয়। ভাইমার নামক স্থানে জার্মান প্রতিনিধিরা মিলিত হয়ে একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন (প্রাপ্তবয়ষ্কদের ভােটে ৭ বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন ও দুকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট)। ইতিহাসে এটা 'ভাইমার রিপাবলিক' হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এই ভাইমার সাধারণতন্ত্র টিকে থাকতে পারেনি মূলত উগ্র ডান ও উগ্র বামপন্থীদের মধ্য বিরােধ, স্থিতিশীলতার অভাব, বিত্তশালী শিল্পপতিদের অসহযােগিতা, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, পররাষ্ট্রীতির ক্ষেত্রে বিফলতা ইত্যাদি নানা কারণে। এই ব্যর্থতার মধ্য দিয়েই জার্মানিতে হিটলারের উত্থান ঘটে।

১৯৩৩ সালে জার্মান পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের নির্বাচনে ন্যাশনাল সােসালিস্ট পার্টি (নাৎসি পার্টি) ৬৪৭টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন পেয়েছিল। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ ভন প্যাপেনের পরিবর্তে হিটলারকে চ্যান্সেলর পদে নিয়োগ দেন (১৯৩৩)। হিন্ডেনবার্গের মৃত্যুর পর ১৯৩৪ সালে হিটলার নিজেকে প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘােষণা করেন। এভাবে একইসাথে তিনি প্রেসিডেন্ট ও চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন। ক্ষমতা দখল করে তিনি ভাইমার সংবিধান বাতিল করেন ও একনায়কতন্র প্রতিষ্ঠা করেন। হিটলার ১৯৩৫ সালে ভার্সাই চুক্তি ও লুকার্নো চুক্তিগুলোর শর্তাবলি মানতে অস্বীকৃতি জানান। একই সাথে তিনি সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করে পূর্ণমাত্রায় সমরাস্ত্র নির্মাণ উদ্যোগী হন। হিটলার রাইন অঞ্চল দখল করলে পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করে। হিটলার ক্ষমতাসীন হয়ে জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার সংযুক্তিকরণ সম্পন্ন করতে উদ্যোাগী হন। ওই সময় হিটলার স্পেনের গৃহযুদ্ধে ফ্রান্সকে সমর্থন করেন। ১৯৩৬ সালে জার্মানি জাপানের সাথে কমিনটার্ন বিরোধী একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ১৯৩৭ সালে ইতালি ওই চুক্তিতে যােগ দিলে জার্মানি, জাপান ও ইতালির মধ্যে রােম-বার্লিন টোকিও অক্ষচুক্তি সম্পাদিত হয়। এটি ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়াবিরােধী একটি চুক্তি। হিটলার চেকোশ্লাভাকিয়ার সাথে একটি চুক্তি করে চেকোশ্লাভাকিয়া রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করেন এবং লিথুনিয়ার কাছ থেকে মেমেল বন্দরটি বলপূর্বক আদায় করেন। একই সাথে তিনি পােল্যান্ডের ডানজিগ বন্দরটিও দখলে নেন। আর এভাবেই ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সুচনা করেন।

এই যুদ্ধ দীর্ঘ ছয়বছর স্থায়ী ছিল (১৯৩৯-৪৫)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও পৃথিবীর ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো দুভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। অক্ষশক্তির প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত মিত্রশক্তি। রাশিয়াও ছিল এই দলে। যুদ্ধে একের পর এক জার্মানির পরাজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে জার্মানি ও ইতালি মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। হিটলার আত্মহত্যা করেন, আর মুসােলিনিকে গ্রেফতার করে হত্যা করা হয়। অন্যদিকে, ১৯৪৫ সালের ২ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও রাশিয়া পটাসডাম সম্মেলনে জাপানকে আত্মসমপণ করতে বললে জাপান তা প্রত্যাখ্যান করে। পরে ৬ ও ৯ আগস্ট হিরােশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বােমাবর্ষণ করা হয়। ফলে ১৪ আগস্ট (১৯৪৫) জাপান শর্তহীনভাবে আত্মসম্পণ করে। এখানে একটা কথা বলা ভালাে আর তা হচ্ছে, জাপান কর্তৃক পার্ল হারবারে হামলা। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর হাওয়াই-এর ওয়াহু দ্বীপে অবস্থিত পাল হারবারে মার্কিন নৌ ও বিমান খাঁটিতে জাপান বিমান হামলা চালিয়ে তা ধ্বংস করে দেয়। জাপানি বিমান হামলায় মার্কিনীদের চোখ খুলে যায় মারণাস্ত্রের আঘাত হানায়। তারা পারমাণবিক বােমা তৈরির পরিকল্পনা হাতে নিল। ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে যুক্তরাষ্ট্র সাফল্যজনকভাবে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এর ঠিক তিন সপ্তাহ পর হিরােশিমায় পারমাণবিক বোমাবর্ষণ করা হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছিল আণবিক বােমার ভয়াবহতা। বিংশ শতাব্দীর এই ঘটনা পরবর্তী বিশ্বরাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেললেও, বৃহত শক্তিগুলাে কখনাে মারণাস্ত্র তৈরি, উৎপাদন ও পরীক্ষা থেকে পিছপা হয়নি। বিংশ শতাব্দী প্রত্যক্ষ করেছে ৮টি দেশের উত্থান, যারা নিজেদেরকে পারমাণবিক শক্তি হিসেবে ঘােষণা করেছে। নিরস্ত্রীকরণের ক্ষেত্রে কিছু কিছু অগ্রগতি হলেও (এনপিটি চুক্তি ও সিটিবিটি চুক্তি স্বাক্ষর), বৃহৎ শক্তিগুলোর ভূমিকা বরাবরই প্রশ্নের মধ্যে ছিল । পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার ও উৎপাদন বন্ধের ব্যাপারে তারা কখনাে আন্তরিক ছিল না। এমনকি জাতিসংঘও এ ব্যাপারে তেমন কোনাে বড় ভূমিকা পালন করতে পারেনি। বিংশ শতাব্দীতে এটা ছিল একটা বড় ব্যর্থতা যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেও সভ্যসমাজ মারণান্ত্র প্রতিযােগিতায় নিজেদেরকে নিয়াোজিত করেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণসমূহ নিম্নে আলােচনা করা হলো :

১. ভার্সাই চুক্তি

ভার্সাই চুক্তির ফলে জার্মানি তার যাবতীয় উপনিবেশ হাতছাড়া করল। শুধু তাই নয়, উপনিবেশে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ লগ্নি করা হয়েছিল, তাও বিফলে গেল। আর জার্মানি হারিয়েছিল কৃষিযােগ্য জমির শতকরা সাড়ে পনের ভাগ, উৎপাদন শিল্পের শতকরা দশ ভাগ, মজুত কয়লার দুই-পঞ্চমাংশ, খনিজ লােহার দুই-তৃতীয়াংশ। এছাড়া জার্মানির নৌ-বাহিনী, স্থলবাহিনী বিমানবাহিনীর উল্লেখযোগ্য অংশ হ্রাস করা হয়েছিল। এককথায় সব দিক থেকে জার্মানিকে দুর্বল করাই ছিল ভার্সাই চুক্তির অন্যতম লক্ষ্যে। সুতরাং এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল যে জার্মানি চুক্তির শর্ত মনেপ্রাণে স্বীকার করে নেবে না। কার্যক্ষেত্রে তাই ঘটল। চুক্তিতে স্বাক্ষর করার পরই জার্মানি তৈরি হতে থাকল পরবর্তী যুদ্ধর জন্য ।

২. দীর্ঘ যুদ্ধবিরতি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে শান্তি, নিরাপত্তা ও গণতন্ত্র বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো তখন দেখা গেল গণতন্ত্র, নিরাপত্তা ও শান্তি কোনােটাই নিরাপদ নয়। সেই জন্য দুই মহাযুদ্ধের মধ্যখানের সময়টাকে শান্তিপূর্ণ সময় না বলে দীর্ঘযুদ্ধবিরতি বলা হয় । গণতন্ত্র, শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সবাই আগ্রহী হয়ে পড়েছিল। আর এই আগ্রহ শেষ পর্যন্ত যুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল। গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্স ভেবেছিল গণতন্ত্র ও শান্তি সংকটের মুখে, আবার জার্মানি ভেবেছিল বৃহৎ শক্তির মুখে তার নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই।

৩. অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ

ভার্সাই জার্মানিকে নিঃস্ব করেছিল। চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর জার্মানির একমাত্র লক্ষ্য ছিল যে কোনো প্রকারে যুদ্ধপূর্ব অবস্থায় ফিরে যাওয়া। জাপান ও ইতালি মনে করেছিল যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সব রকম সুযােগ সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত, তাই অর্থনৈতিক পুনর্গঠনকে তারা অপরিহার্য বলে মনে করেছিল। সারা বিশ্বের উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে না পারলে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। এই মানসিকতার দ্বারা পরিচালিত হয়ে জার্মানি, জাপান ও ইতালি যুদ্ধের উন্মাদনায় মেত উঠেছিল।

৪. আন্তর্জাতিক নৈরাজ্য :

আন্তর্জাতিক নৈরাজ্যকে অনেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন। লীগ অফ নেশনস' যৌথ নিরাপত্তাব্যবস্থা সুনিশ্চি করতে ব্যর্থ হওয়ায় লীগের সদস্যবৃন্দ ও অন্যান্য রাষ্ট্র শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সনাতন পদ্ধতির আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল এবং এই পদ্ধতি হলাে জোট তৈরি করা। জাপানের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ অথবা ইতালির ইথিওপিয়া আক্রমণ কোনাে ক্ষেত্রেই লীগ যৌথ নিরাপত্তাকে কাজে লাগিয়ে আগ্রাসী শক্তিকে শাস্তি দিতে পারেনি। সেইজন্য লীগের কার্যকারিতা সম্বন্ধে সবার মনেই সন্দেহের উদ্রেক হয়েছিল। লীগের উপর এই সর্বব্যাপী অনাস্থা আন্তর্জাতিক নৈরাজ্যকে সুনিশ্চিত করে তুলেছিল। অনেকের মনে এই বিশ্বাস জন্মেছিল যে লীগের সফল হওয়া মানে যুদ্ধের সম্ভাবনা কমে যাওয়া, আর ব্যর্থতা মানে যুদ্ধ অনিবার্য।

৫. নিরন্ত্রীকরণে ব্যর্থতা :

লীগ অফ নেশনস-এর প্রবক্তাগণ মনে করেছিলেন শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে নিরস্ত্রীকরণ অবশ্যই প্রয়ােজন। কিন্ত্র এই সদিচ্ছাকে ফলপ্রসূ করতে হলে বৃহৎ শক্তিবর্গের যে পরিমাণ সহযোাগিতা ও লীগ কর্তৃপক্ষের দৃঢ়তা প্রয়ােজন তার কোনোটাই ছিল না। বৃহৎ শক্তিবর্গ অস্ত্র উৎপাদনের অশুভ প্রতিযােগিতায় নিজেদেরকে নিমজ্জিত করেছিল। অস্ত্র প্রতিযােগিতা বন্ধ না হওয়ায় তা যুদ্ধের জন্ম দিয়েছিল।

৬. উগ্রজাতীয়তাবাদ

হিটলারের ধারণা ছিল জার্মানজাতি পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র উৎকৃষ্ট ও শ্রেষ্টজাতি, অন্যরা নিকৃষ্ট। অতএব নিকৃষ্টের উপর শ্রেষ্ঠের কর্তৃত্ব থাকা খুবই স্বাভাবিক। জার্মানজাতি গােটা ইউরোপের উপর প্রাধান্য বিস্তার করবে এই স্বপ্নে হিটলার বিভাের ছিলেন। স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতে গিয়ে তিনি এক সর্বধ্বংসী যুদ্ধের ঝুঁকি নিয়েছিলেন।

৭. সর্বাত্মকবাদ :

হিটলার ও মুসােলিনি উভয়েই গণতন্ত্রকে একটা চ্যালেঞ্ছ হিসেবে নিয়েছিলেন, তাঁরা গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে সর্বাত্মকবাদ বা Totalitarianism-এর পথকে সর্বোৎকৃষ্ট পথ বলে মেনে নিয়েছিলেন। হিটলার ও মুসােলিনী মনে করতেন গণতান্ত্রিক উপায়ে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, দেশের দ্রুত বিকাশ সাধনের জন্য সর্বাত্মকবাদ ছাড়া উপায় নেই। হিটলার ও মুসােলিনি জঙ্গী জাতীয়তাবাদের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে গােটা ইউরোপের উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে উদ্যত হয়েছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে মানবসভ্যতা, বিশ্বশান্তি ও আন্তর্জাতিকবাদ ইত্যাদি একেবারে মূল্যহীন হয়ে পড়েছিল। জার্মানি, জাপান ও ইতালির কাছে নিজেদের সংকীর্ণ জাতীয়তাবােধ ছাড়া অন্য কোনাে মূল্যবােধ যথাযথ মর্যাদা পায়নি।

৮. অন্যান্য কারণ

এ ছাড়া লোকার্নো চুক্তি, ওয়াশিংটন নৌ-সম্মেলনসহ কেলগ- ব্রিয়ান্ড চুক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর বিশ্বরাজনীতিতে একটি সদূরপ্রসারী ফলাফল প্রত্যক্ষ করি। এই ফলাফল নিম্নে আলাচনা করা হলো:

১. পরস্পর বিরােধী দুই মতাদর্শের বিকাশ :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ দুভাগে ভাগ হয়ে যায়, পশ্চিম ইউরোেপ ও পূর্ব ইউরোপ । পশ্চিম ইউরোপে পুঁজিবাদ তথা সংসদীয় গণতন্ত্রের আরাে বিকাশ ঘটে, অন্যদিকে পূর্ব ইউরোপে সােভিয়েত ধাচের সমাজতন্ত্র বিকশিত হয়। এই দুই মতাদর্শকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে দুটি সামরিক জোট ন্যাটো ও ওয়ারশ।

২. জার্মানির বিভক্তি :

হিটলারের পতনের পর জার্মানি দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। ১৯৪৯ সালের ২৩ মে পশ্চিম জার্মানির আত্মপ্রকাশ ঘটে, আর পূর্ব জার্মানির জন্ম হয় ৭ অক্টোবর (১৯৪৯)। জার্মানিকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা হয়। নাৎসি দল নিষিদ্ধ হয় ও সকল প্রকার ঘৃণ্য আইন-কানুন বাতিল হয়। ডানজিগ পুনরায় পােল্যান্ডকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। নুরেনবার্গের আন্তর্জাতিক আদালতে জার্মান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়।

৩. বিশ্বরাজনীতিতে বৃহৎ শক্তি হিসেবে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের পতন :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন বিশ্বব্যাপী তার সাম্রাজ্য হারায়। ব্রিটেনের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে, বিশ্বের বাজারে বৃটিশ পণ্য রপ্তানি বন্ধ হয়। কৃষিক্ষেত্রেগুলাে অনাবাদী হয়ে পড়ে থাকে, অর্থনৈতিক সঙ্কটের সঙ্গে যুদ্ধ ফেরত সেনাদের ভাতা প্রদান ও পুনর্বাসনের সমস্যা দেখা দেয়। ব্রিটেনকে বাধ্য হয়ে তার স্থল ও নৌ-বহর হ্রাস করতে হয়। ব্রিটেনের সামরিকশক্তি খর্ব হয়। ফলে বিশ্বরাজনীতিতে তার প্রভাব কমতে থাকে। ফ্রান্সের অবস্থা ছিল ব্রিটেনের চাইতে বহুগুণ খারাপ । সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কম থাকায় তিনি স্থায়ী সরকার গঠনে আক্ষম হন। ১৯৪৬-১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ১৪ জন প্রধানমন্ত্রী একে একে ক্ষমতায় এসে চলে যেতে বাধ্য হন। এদিকে ফ্রাসের শিল্প ও অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা ও ধর্মঘটে ফ্রান্স ধ্বংসের পথে ধাবিত হয়। ফলে ধীরে ধীরে বিশ্বরাজনীতিতে ফ্রান্সের গুরুত্ব কমতে থাকে।

৪. বৃহৎ শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের আবির্ভাব :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ব্রিটেন ও ফ্রান্স ছিল বৃহৎ শক্তি। কিন্তু যুদ্ধের পরেই বিশ্বরাজনীতির চেহারা ও বৃহৎ শক্তির কাঠামাে দুইই ব্যাপকভাবে বদলে যায়। ব্রিটেন ও ফ্রান্স যুদ্ধে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে তাদের পক্ষে সামলে ওঠা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে তার প্রভাব বিস্তার করে বৃহৎ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর পশ্চাতে কারণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ ও সামরিক খাতে ব্যয় করার মতাে প্রচুর অর্থ। এই কারণে আমেরিকা তার প্রভাব বিস্তার করে।

৫. সােভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে শক্তি হিসেবে সােভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থানের পশ্চাতে মূল কারণ ছিল দেশটির বিপুল সামরিক শক্তি ও সম্পদের প্রাচুর্য।

5.স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা :

বিশ্বযুদ্ধের পরে গােটা বিশ্বে মেরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজ নিজ প্রভাব বলয় সৃষ্টি করে, দুই পরাশক্তি পারমাণবিক ও অন্যান্য বিধ্বংসী অস্ত্রের বিশাল ভাণ্ডার গড়ে তােলে। আক্রমণ করার বাসনা উভয়ের মনে দানা বাঁধে। কিন্তু বিধ্বংসী অস্ত্রের ভয়াবহতা সম্পর্কে দুই রাষ্ট্রই আতঙ্কবােধ করে। ফলে দেখা দেয় এক ধরনের 'যুদ্ধের, যা কিনা ইতিহাসে স্নাযুযুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। এ ক্ষেত্রে এই দুই পরাশক্তির মাঝে কোনাে যুদ্ধ হয়নি বটে। কিন্তু একাধিকবার যুদ্ধের মতাে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোও প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে এই স্নায়ুযুদ্ধ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।

৭. জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা

১৯৪১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে আগস্টে যুদ্ধ জাহাজে মিলিত হয়ে আটলান্টিক সনদপত্র স্বাক্ষর করেন। ওই সনদে একটি বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনের ইঙ্গিত দেয়া হয়। আটলান্টিক সনদে বলা হয় যে, ১. সনদে যােগদানকারী সকল দেশ সমান মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের অধিকারী হবে; ২. সকল প্রকার বিবাদ শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিষ্পত্তি হবে; এবং ৩. প্রতি দেশের জনগণ তাদের ইচ্ছামতাে শাসনতন্ত্র তৈরি করার অধিকার পাবে। ১৯৪২ সালে ২৬টি দেশ আটলান্টিক সনদের প্রতি আস্থাজ্ঞাপন করে। এই ২৬ জাতির সম্মেলনে সর্বপ্রথম জাতিসংঘ বা United Nations কথাটি ব্যবহার করা হয়। ১৯৪৩ সালে মস্কো সম্মেলনে ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন একটি ঘােষণাপত্র প্রকাশ করে। এই ঘােষণাপত্রের চতুর্থ অনুচ্ছেদে বলা হয় যে, "আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য ক্ষুদ্র ও বৃহৎ শান্তিপ্রিয় রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্বের ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রয়ােজনীয়তা চার শক্তি স্বীকার করছে।" ১৯৪৫ সালে সানফ্রান্সিসকো সম্মেলনে জাতিসংঘের সনদ গৃহীত হয়। ২৪ অক্টোবর, ১৯৪৫ জাতিসংঘ সনদ চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়।

৮. ফ্যাসিবাদের ধ্বংস :

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি জয়ী হওয়ায় ফ্যাসিবাদ চিরতরে বিলুপ্ত হয়।

মূল্যায়ন

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মূলে ছিলেন জার্মানির একনায়ক হিটলার। এছাড়া ইতালি, জাপান ও জার্মানির মতাে দেশ সারাবিশ্বে তাদের প্রাধান্য বিস্তার করতে বদ্ধপরিকর ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যা বিশ্বকে শুধু ক্ষতিগ্রস্তই করেনি, করেছিল বাকরুদ্ধ। মাত্র বিশ বছরের ব্যবধানে বিশ্বকে সম্মুখীন হতে হয়েছিল এক ভয়ঙ্কর জীবননাশী যুদ্ধের। যুদ্ধের প্রথম দিকে অক্ষশক্তি বিশ্বের বেশিরভাগ অংশ দখল করলেও শেষের দিকে একে একে পতন ঘটে জার্মানি, ইতালি ও জাপানের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক রাজনীতি মােড় নেয় নতুন দিকে। জন্ম নেয় দুই পরাশক্তি সােভিয়েত ইউনিয়ন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। বিশ্ব থেকে পতন ঘটে নাংসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের।

Next Post Previous Post