চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব।
চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রেক্ষাপট ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর।
All kinds of arguments against the peasant movement must be speedily set right. The erroneous measures taken by the revolutionary authorities concerning the peasant movement must be spcedily changed. Only thus can any good be done for the future of the revolution.
Mao Zedong (Quoted in William T. De Bary ed. Source of Chinese Tradition, 1960)
পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায়, যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। বিপ্লবের মাধ্যমে নিষ্পেষিত জনগণ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিপ্লবের মাধ্যমে মুক্তিকামী, স্বাধীনচেতা জনগণ দেশের প্রচলিত স্বৈরাচারী, অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করেছে। এখানে অবশ্য একটি কথা বলা প্রয়োজন, জনগণের ভিতর মুক্তির আকাঙ্ক্ষা না থাকলে, জনগণ স্বতঃফূর্তভাবে অংশ না নিলে কোনাে বিপ্লবই সফল হতে পারে না। বিংশ শতাব্দীতে চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা। কৃষিভিত্তিক একটি সমাজেও যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে, চীনা বিপ্লব সেটা প্রমাণ করেছিল। সেইসাথে বিংশ শতাব্দী শেষ হবার আগেই সারা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছিল চীনা সমাজতন্ত্রের নয়ারূপ-সমাজতান্ত্রিক প্রতিটি বিপ্লবের ন্যায় চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বিশ্বব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে চীন হচ্ছে দ্বিতীয় রাষ্ট্র যেখানে রাশিয়ার পর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হলেও রাশিয়ায় যেভাবে সমাজতন্ত্র বিকশিত হয়েছে, চীনে সেভাবে হয়নি। কারণ সােভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে যে সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে কৃষকশ্রেণীর ভূমিকা ছিল বড়। চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলে পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটেছিল। এর পরিবর্তে সেখানে গড়ে উঠেছিল সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। চীনের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন মাও জে দং(মাও সে তুং)। মূলত, তাঁর দূরদর্শিতা ও সফল নেতৃত্বের কারণেই চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফলতা পেয়েছিল। পরবর্তীকালে আশির দশকে সেই সমাজতন্ত্রকে আরাে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন আরেক অবিসংবাদিত নেতা দেং জিয়াও পিং। চীনে বর্তমানে 'বাজার নির্ভর সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তার ভিত্তি রচনা করেছিলেন দেং জিয়াও পিং। বলতে বাধা নেই চীন এখন আর ধ্রুপদী মার্ক্সবাদ অনুসরণ করে না। মার্ক্সবাদ মাওবাদের সাথে বাজারনির্ভর অর্থনীতির কিছু কিছু উপাদান সংযোজিত হয়েছে। এটাই চীনা সমাজতন্ত্রের সৌন্দর্য।
চীনের ইতিহাস
সমাজতান্ত্রিক চীন বিশ্বের অন্যতম প্রধান সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। জাতিসংঘের ভেটো প্রদানকারী ৫টি দেশের মধ্যে চীন একটি। এর বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১২০ কোটির উপরে। চীনে ৫৬টি জাতি রয়েছে এবং দেশের শতকরা ৯৪ ভাগ লােক হান জাতির। অন্যান্য জাতিগুলোর মধ্যে রয়েছে- থাই, লি, লমু, তাতার, তিব্বতী, তােং, কাজাক, উজবেক প্রভৃতি। প্রাচীনকালে অন্যান্য দেশের মতাে চীনেও রাজতন্ত্র প্রচলিত ছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সিয়া রাজবংশই ছিল চীনের সর্বপ্রথম রাজবংশ (খ্রিস্টপূর্ব একবিংশ থেকে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তদশ শতাব্দী)। পর্যায়ক্রমে ছিল, হান, সুই, থাং, সােং, ওয়াং, আনশ, ইউয়ান, মিং, মাঞু রাজবংশ চীনে শাসনক্ষমতায় ছিল। (চিয়ান পােজান, শাও স্যুন চেং, হ হুয়া, চীনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, পেইচিং, চীন, ১৯৮৯)। মূলত, চীনের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর অর্থনীতি। ষোড়শ শতাব্দী থেকে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত অন্যান্য দেশের সাথে চীনের বাণিজ্যিক বা কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জের রাজত্বকালে ১৭৯৩ সালে লর্ড ম্যাকারটনি নামে একজন দূতকে চীনে পাঠানাে হয় ব্রিটেনের সাথে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য। কিন্তু তদানীন্তন চীন সম্রাট ছিং সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। ভারতবর্ষে কোম্পানির শাসনকাল শুরু হলে তারা চীনে আফিম ব্যবসা শুরু করে। ১৯৩৯-৪২ সময়সীমায় সংঘটিত ইঙ্গ-চীন যুদ্ধকে আফিমযুদ্ধ বা Opium War হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই সংঘর্ষের মূলে আফিম সমস্যা ছিল না, সমস্যা ছিল চীনা সাম্রাজ্যের সঙ্গে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থির করা। ওই যুদ্ধে চীন পরাস্ত হয় এবং ১৮৪২ সালে নানকিং সন্ধি (Treaty of Nanking) দ্বারা যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। ওই সন্ধি অনুযায়ী চীন হংকং বন্দর ইংল্যান্ডকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় ও অপর ৫টি বন্দরে ইউরোপীয় বণিকদের অবাধ বাণিজ্যাধিকার প্রদান করে। উনবিংশ শতাব্দীতে চীনের উল্লেখযােগ্য ঘটনাবলির মধ্যে রয়েছে তাইপিং বিদ্রোহ (১৮৫০) ও দ্বিতীয় চীন যুদ্ধ (১৮৫৬-৫৮)। ব্রিটেন ও ফ্রান্স যৌথভাবে ১৮৫৬ সালে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে ও যুদ্ধে পরাজিত হয়ে চীন সম্রাট তিয়েন সিয়েন সন্ধি (Treaties of Tientsin, 1958) চুক্তি করতে বাধ্য হন। ওই চুক্তিতে চীনকে ক্ষতিপূরণ ও ১৬টি বন্দর বিদেশি বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে বাধ্য করা হয়। বন্দরগুলােতে বিদেশিদের উদ্ধত আচরণ, অর্থনৈতিক শােষণ, খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের আচরণের প্রতিবাদে ১৯০০ সালে সংঘটিত হয় বক্সার বিদ্রোহ। বক্সার বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল ও চীনে বিদেশিদের প্রভুত্ব আরাে বেড়েছিল। উনবিংশ শতাব্দী শেষ হওয়ার আগে কোরিয়ার অধিকার নিয়ে চীন-জাপান যুদ্ধ (১৮৯৪-৯৫) ছিল আরেকটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। মূলত, ওই যুদ্ধে চীনের পরাজয়ের ফলে চীনের জনসাধারণের মাঝে রাজতন্ত্র বিরােধী চেতনা শক্তিশালী হয় ও সংস্কারের পক্ষে দাবি শক্তিশালী হয়। বিভিন্ন বিদেশি শক্তির সাথে চীনের যুদ্ধ এবং শােচনীয় পরাজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে চীনে বিপ্লবী ধারণার সূত্রপাত ঘটতে থাকে। পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা সঞ্চারিত হয় এবং তারা বুঝতে পারে রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কারণে চীন শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারছে না। এ কারণে তারা রাজতন্ত্রের অবসান এবং প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। বুদ্ধিজীবীদের এক অংশ ঔপনিবেশিক শক্তি উচ্ছেদ এবং চীনের মুক্তির জন্য সংঘবন্ধ হতে শুরু করে । তাদের নেতৃত্বে ছিলেন সুন চোং শান (সান ইয়াৎ সেন)। তিনি সংস্কার আন্দোলনের পরিবর্তে বিপ্লবী পন্থা অনুসরণ করে। গুপ্ত সমিতি গঠন করেন এবং বিদেশে বসবাসকারী চীনাদের কাছ থেকে অর্থসংগ্রহের পরিকল্পনা করেন। ১৯০৫ সালে আরাে বহু বিপ্লবীদের সাথে টোকিও শহরে একত্র হয়ে গঠন করে চোংকুও কেমিং থােং মেং হুই" বা চীনা বিপ্লবী সংঘ। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ডা. সুন চোং শান-এর এই আন্দোলনের প্রভাব ছিল ব্যাপক। তাঁর নীতি ছিল তিনটি, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও জনগণের জীবিকা। দলে দলে তরুণরা এই আন্দোলনে শরিক হয়। বাহ্যিত এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল চীনের মাথু রাজবংশের রাজা ছিং-এর পতন। বিপ্লবীরা ১৯১২ সালের জানুয়ারিতে অচিরেই নানচিং দখল করে ও ডা. সুন চাং সানকে সভাপতি বা প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘােষণা করে । এদিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরা মাঞ্চু রাজবংশ রক্ষার জন্য কিছু সাংবিধানিক সংস্কার ঘােষণা করে এবং ইউয়ান সি খাই নামের একজন সেনাপতির হাতে ক্ষমতা অর্পণ করেন। এভাবেই চীন বিভক্ত হয়ে যায়। দক্ষিণে সুন চোং শান ও উত্তরে ইউয়ান সি খাই-এর কর্তৃত্ব বজায় থাকে। পরবর্তীকালে ১৯১২ সালের ফ্রেবুয়ারিতে সমঝোতার ফলে সম্রাট স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগ করেন ও ইউয়ান সি খাই সাধারণতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সান ইয়াৎ সেন তার দলের নাম রাখেন কুয়ো মিং তাং(kuo Ming Tang) আর এভাবেই চীনের প্রায় ৩০০ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। অবসান ঘটে। চীন এই বিপ্লবকে বুর্জোয়া বিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। চীনা জনগণকে আরাে উদ্দীপিত করার ক্ষেত্রে এই বিপ্লব একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল। উল্লেখ্য যে, ডা. সুন চোং শানই ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছেন সান ইয়াৎ সেন হিসেবে।
কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূত্রপাত
১৯১৭ সালে রাশিয়া বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। চীন রাশিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্র হওয়ার কারণে কমিউনিজমের হাওয়া চীনের জনগণের মাঝে এসে পড়ে। তারা মার্কসীয় মতবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে মার্কসবাদী পাঠচক্র গঠন করেন। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন অধ্যাপক, লি তা চাও এবং ছেন তু সিউ এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ছাত্রদের মধ্যে মাও জে দংও মার্কসবাদী পাঠচক্রে যােগ দেন। সাংহাইয়ে ১৯১৮ সালে এবং পিকিংয়ে ১৯১৯ সালে এই রকম পাঠচক্র গঠিত হয়। সাংহাইয়ে ১৯২০ সালে কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গড়ে তােলা হয় এবং পিকিং ও ক্যান্টনে এরূপ গােষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। মাও জে দং ১৯২০ সালে হুনানে মার্কসবাদী পাঠচক্র ও 'সােস্যালিস্ট ইয়ুথ লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত, এভাবে চীনের জনগণের মধ্যে মার্কসবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। ১৯২১ সালের ১ জুলাই সাংহাইয়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে জন্মলাভ করে। এক্ষেত্রে কমিন্টর্ন নামে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা দুজন প্রতিনিধিকে চীনে প্রেরণ করে সংস্থাসমূহকে একত্র করেন এবং সাংহাইয়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের ক্ষেত্রে উদ্যোগী হন। ১৯২১ সালের ১ জুলাই সাংহাই-এ আনুষ্ঠানিকভাবে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে ১৩ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে মাও জে দং অন্যতম। ওই কংগ্রেসে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছেন তু সিউ-কে সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করা হয় এবং পার্টির সংবিধান রচিত হয়। প্রাথমিকভাবে সরাসরি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীকালে লেনিনের তত্ত্ব অনুসারে স্থির করা হয় যে, ঔপনিবেশিক অনগ্রসর সব দেশে শ্রমিকশ্রেণী সংগঠিত ও শক্তিশালী না হওয়া পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টিকে বুর্জোয়া গণতান্রিক শক্তির সঙ্গে সহযােগিতার ভিত্তিতে চলতে হবে। এরই ভিত্তিতে কমিউনিস্ট পার্টি ১৯২৩ সালে প্রথম যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রথম যুক্তফ্রন্ট
১৯২৩ সালের জুন মাসে কুয়াংচৌতে চীনা কমিউনিস্টে পার্টির তৃতীয় জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। ওই কংগ্রসে কুয়াে মিং তাং পার্টির সাথে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং বলা হয় পার্টির যুবলীগের সদস্যরা কুয়াে মিং তাং পার্টিতে যোগ দিয়ে পার্টির পক্ষে কাজ করতে পারবে। কমিউনিস্ট পার্টি সান ইয়াৎ সেনকে নতুনভাবে সরকার গঠন করতে বলে। অবশ্য পূর্বতন সােভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক সরকারও কুয়াে মিং তাং-এর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে সচেষ্ট হয়। ১৯২৫ সালের ১২ মার্চ সান ইয়াংসেনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে চিয়াং কাইশেক (চিয়াং চিয়েশি) কুয়াে মিং তাং-এর নেতৃত্ব লাভ করে। বিদেশি হস্তক্ষেপ এবং শ্রমিক গ্রেফতারের প্রতিবাদে সাংহাইয়ে ১৯২৫ সালের ২৯ মে শ্রমিকরা ধর্মঘট ডাকে এবং বিশাল মিছিল বের করে। মিছিলের উপর ব্রিটিশ পুলিশ কর্তৃক গুলির পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়ে ওঠে। ব্রিটিশ ও জাপানি পণ্যবর্জন' কর্মসূচি শুরু হয়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং কুয়াে মিং তাং-এর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় এবং যুক্তফ্রন্টের এই নেতৃত্বে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কিন্তু মিছিল ও ধর্মঘটের কারণে হংকংয়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। চিয়াং কাইশেকের নেতৃত্বে কুয়াে মিং তাং বাহিনী ১৯২৬ সালের জুলাই মাসে উত্তরাঞ্চলে সামরিক অভিযান শুরু করে এবং সেখানে সমরনায়কদের পতন ঘটে। এ সময় কুয়াে মিং তাং এর সাথে কমিউনিস্টদের দূরত্ব বৃদ্ধি পায় এবং যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায় । কমিউনিস্ট সাংহাইয়ে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন এবং বহু কমিউনিস্টকে হত্যা করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিত মাও জে দং কমিউনিস্ট পার্টিকে সুসংহত করার লক্ষ্যে লালফৌজকে আরাে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন। চিয়াং কাইশেকের কমিউনিস্ট নিধন কর্মসূচি প্রতিরােধের লক্ষ্যে মাও জে দং কৃষকভিত্তিক কৌশল অবলম্বন করেন। মূলত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রদের দ্বারা তিনি লালফৌজ গঠন করেন। বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে মাও জে দং ও অন্যান্য কমিউনিস্ট নেতা তাঁদের কিছুসংখ্যক যোদ্ধাদের নিয়ে চিয়াংসি প্রদেশে গমন করেন। সেখানে তাঁরা স্থানীয় কৃষকদের সহায়তায় ওই প্রদেশের অংশবিশেষকে Base Area-তে পরিণত করেন। কিন্তু ১৯৩০ ও ১৯৩৪ সালে চিয়াং কাইশেকের উন্নত সেনাবাহিনী ওই এলাকা থেকে কমিউনিস্টদের বিতাড়িত করে। ফলে ১৯৩৪ সালে মাও জে দংকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব থেকে অপসারণ করা হয় এবং মাও-এর গেরিলা যুদ্ধের কৌশল পরিহার করে কুয়াে মিং তাং বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধের আদেশ দেয়া হয়। ফলে উন্নততর কুয়ে মিং তাং বাহিনীর কাছে কমিউনিস্ট বাহিনী পরাজিত হয়। চৌ-এন-লাই এবং লি-লি সান এই সম্মুখযুদ্ধের পক্ষপাতি ছিলেন। এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তাঁরা তাঁদের ভুল বুঝতে পারেন এবং মাও জে দং-এর নীতি গ্রহণ করেন। সম্মুখযুদ্ধে কমিউনিস্টদের পরাজয়ের ফলে চিয়াং কাইশেক আবার কমিউনিস্ট নিধনে তৎপর হন। তিনি ১৯৩০ সালে চীনা কমিউনিস্টদের নিধনের উদ্দেশ্যে পর পর বহু আক্রমণ চালাতে থাকেন। এ সময় অর্থাৎ ১৯৩১ সালে জাপান মাঞ্চুরিয়া দখল করে নেয়। উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, উত্তর পূর্ব চীনের দুই মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার ভূমি এবং ৩০ মিলিয়ন অধিক লােকসম্পন্ন লিয়াওনিং, চিলিন ও হেইলােংচিয়াং প্রদেশ তিনটি জাপান দখল করে মাঞুচরিয়া নাম দিয়ে সেখানে একটি পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। চিয়াং কাইশেক এই বৈদেশিক আক্রমণের মুখে বিপর্যয়ের প্রাক্কালে দেশের কমিউনিস্টদের উপর উপর্যপুরি হামলা কিছুদিনের জন্য বন্ধ করতে বাধ্য হন। কমিউনিস্ট পার্টি চিয়াং কাইশেকের কাছে সহযোগিতার প্রস্তাব পাঠালে তিনি তা মেনে নেন। কিন্তু পরবর্তী বছরই তিনি কমিউনিস্ট নিধননীতি পুনরায় শুরু করেন এবং কমিউনিস্টদের জিয়াংজি অঞ্চল ত্যাগ করতে বাধ্য করেন। ওই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান, জার্মানি এবং ইতালির সহায়তা নিয়ে কুয়াে মিং তাং বাহিনী কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে পুনরায় অভিযান শুরু করে। কুয়ো মিং তাং বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৩৪ সালের অক্টোবর মাসের ১৬ তারিখ লাল ফৌজের মূলবাহিনী চিয়াংসি বিপ্লবী ঘাঁটি ছেড়ে শক্রবুহ্য ভেদ করে বিখ্যাত লং মার্চ শুরু করে। লং মার্চটি কুয়াং তােং, হুনান এবং কুয়াইসি অতিক্রম করে ১৯৩৫ সালের জানুয়ারি মাসে কুইচৌ এর জুন-ই নামক স্থানে পৌঁছে। এরপর বহু বাধা অতিক্রম করে লং মার্চটি ১৯৩৫ সালের অক্টোবর মাসে উত্তর সেনসীতে পৌঁছে। একই সঙ্গে ১৯৩৬ সালের অক্টোবর মাসে বিভিন্ন ফ্রন্ট থেকে লাল ফৌজের বাহিনী উত্তর সেনসীতে মূলবাহিনীর সাথে যােগ দিল। এ বিরাট যুদ্ধ নীতিই ইতিহাসে 'লং মার্চ নামে পরিচিত। হাজার মাইলব্যাপী এই লং মার্চে প্রায় ১ লক্ষ মানুষ অংশ নেয়। ১১টি প্রদেশের মধ্য দিয়ে এই লং মার্চ অগ্রসর হয় এবং এটা প্রথমে পশ্চিমদিকে ও পরে উত্তরদিকে পরিচালিত হয়। এই লং মার্চটি ৫টি পর্বতমালা এবং উমে-এর উচ্চ পাহাড় ও খাড়া পর্বতশৃঙ্গে আরােহণ করেছিল। তাঁরা উচিয়াং, চিনশা, তাতু নদীর মতাে প্রাকৃতিক বাধাকে জয় করেছিলেন। জনমনুষ্যহীন লাজি বিশাল জলাভূমির মধ্য দিয়ে যাত্রা করেছিলেন এবং বিপজ্জনক গিরিপথ ভেদ করেছিলেন। লং মার্চের এই সাফল্য বিপ্লবীদের আরো উদ্বুদ্ধ করেছিল ও চীনে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে তারা আরো একধাপ এগিয়ে গিয়েছিল। ১৯৩৫ সালের ৬ জানুয়ারি লালফৌজ সুনাই দখল করার পর সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং মাও জে দংকে পুনরায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়েছিল। ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বরে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে 'সােভিয়েত' বা মুক্তাঞ্চল স্থাপিত হয় এবং ইয়েনানকে এর রাজধানী করা হয়। পাশাপাশি উত্তর সেনসীতে কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। মাও জে দং গ্রামাঞ্চলের ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র বুর্জোয়াদের নিয়ে সম্মিলিত সরকার গঠন করেন, যাকে বলা হতাে জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব বা নয়াগণতন্ত্র। এ সরকারের কর্মকাণ্ড গ্রামাঞ্চলেই সীমাবন্ধ ছিল। ভূমিসংস্কার এবং কৃষকদের মাঝে জমি বণ্টন ছিল এদের মূলকাজ। এছাড়াও ওই সরকার হাসপাতাল, বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে এবং সশস্ত্রবাহিনী গঠন করে। ১৯৩৬ সালে চিয়াং কাইশেকের সাথে কমিউনিস্টদের দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। এর প্রেক্ষাপট আমাদের জানা দরকার। মাও জে দং মূলত জাপান সাম্রাজ্যের আগ্রাসনকে রুখে দেয়ার সংগ্রামে সহযোগিতা করার জন্যে চিয়াং কাইশেকের নিকট বার বার আবেদন করেছিলেন। চিয়াং কাইশেক এই আবেদনে সাড়া দেননি। তিনি জিয়ান থেকে কমিউনিস্টদের বিতাড়নের পরিকল্পনা করেন। চিয়াং কাইশেক কুয়ে মিং তাং বাহিনীর সৈন্যদের কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে প্ররােচিত করতে থাকেন। কিন্তু কুয়াে মিং তাং বাহিনীর অধিকাংশ সৈন্য ছিল মাঞ্চুরিয়ার অধিবাসী জাপানিদের বিতাড়ন সঙ্গত মনে করেন। এরূপ পরিস্থিতে চিয়াং কাইশেক তাঁর নিজের সৈন্যবাহিনীর হাতে আটক হন। তবে চৌ এন লাই-এর মধ্যস্থতায় তিনি মুক্ত হন। চিয়াং কাইশেক কমিউনিস্টদের সাথে যুক্তফ্রন্ট গঠনে রাজি হন এবং তাঁকে রাষ্ট্রপ্রধান করা হয়। কিন্তু চিয়াং কাইশেক দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টকে আন্তরিকভাবে মেনে নেননি। গ্রামাঞ্চলের কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতা ও প্রতিপত্তিকে চিয়াং কাইশেক সুদৃষ্টিতে দেখেননি। তাই চিয়াং কাইশেকের সৈন্যবাহিনীর সাথে কমিউনিস্টদের সংঘাত শুরু হয় এবং ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায়। এর ফলে গ্রামাঞ্চলে কমিউনিস্টদের কর্তৃত্ব এবং শহর অঞ্চলে চিয়াং কইশেকের বাহিনীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। ওই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে । ১৯৩৭ সালে জাপান চীনের মাঞ্চরিয়া প্রদেশ দখল করে। চীন থেকে জাপানিদের বিতাড়িত করার উদ্দেশ্যে মাও জে দং যুক্তফ্রন্ট গঠন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন চীনের জনগণের বিরুদ্ধে চীনাদের যুদ্ধ করা উচিত নয়, চীনের যুদ্ধ করতে হবে জাপানের বিরুদ্ধে। ১৯৩৭-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত মাও জে দং তাঁর লালফৌজদের নিয়ে জাপানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। জাপান ১৯৪৫ সালে আত্মসমর্পণ করে। কমিউনিস্টরা চীনের অনেক অঞ্চলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে । কিন্তু ভবিষ্যৎ কাঠামো নিয়ে কমিউনিস্ট এবং জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে মতিরােধ সৃষ্টি হলে চীনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪৫-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চীনে গৃহযুদ্ধ চলে। মাও জে দং গ্রামাঞ্চল নিয়ে শহর ঘেরাও করার নীতি প্রয়ােগ করেন। চিয়াং কাইশেক যদিও যুদ্ধের প্রথম দিকে কিছুটা সফল হন, কিন্তু স্বৈরাচারী মনােভাব ও প্রতিক্রিয়াশীল নীতির জন্য তাঁর পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। কমিউনিস্ট বাহিনীর সংঘবদ্ধ আক্রমণের মুখে কুয়াে মিং তাং বাহিনী বিপন্ন হয়ে ওঠে। তারা বিভিন্ন প্রদেশে পরাজয় বরণ করে একসময় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। ১৯৪৯ সালে চীনের মূল ভূ-খণ্ডে মাও জে দং-এর নেতৃতে কমিউনিস্টদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং চিয়াং কাইশেক রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি লি জোং রেনকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত করেন। চিয়াং কাইশেক এ সময় কমিউনিস্ট এবং কুয়াে মিং তাং-এর মধ্যে সমগ্র চীনকে ভাগাভাগি করার প্রস্তাব দেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং কুয়াে মিং তাং-এর রাজধানী নানচিং দখল করে। চিয়াং কাইশেক তাঁর বাহিনী নিয়ে ক্যান্টনে আশ্রয় নেন এবং পরে মার্কিন সহযােগিতায় ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে সাবেক ফরমোজা ও বর্তমানে তাইওয়ানে স্থায়ী আশ্রয়গ্রহণ করেন। মাও জে দং ওই বছর ১ অক্টোবর চীনকে গণপ্রজাতন্ত্রী হিসেবে ঘােষণা করেন এবং তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের চেয়ারম্যান পদ গ্রহণ করেন। চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কতকগুলাে সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয় ছিল। চীনা রাষ্ট্রের চরিত্র কী হবে, এ সম্পর্কে ১৯৪০ সালেই মাও জে দং একটি ধারণা দিয়েছিলেন। "নয়াগণতন্ত্র সম্পর্কে শীর্ষক এক প্রবন্ধে মাও জে দং উল্লেখ করেছিলেন, "এটা খুব স্পষ্ট যে চীনের বর্তমান সমাজের চরিত্র যেহেতু ঔপনিবেশিক, আধা ঔপনিবেশিক ও আধা সামন্ততান্ত্রিক, তাই চীনের বিপ্লবকে অবশ্যই দুইভাগে ভাগ করতে হবে । প্রথম পর্বের কাজ হলাে, সমাজের এই ঔপনিবেশিক, আধা ঐপনিবেশিক ও আধা সামন্ততান্ত্রিক রূপকে একটা স্বাধীন, গণতান্ত্রিক সমাজে পরিবর্তন করা, দ্বিতীয় পর্বের কাজ হলাে, বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা (Selected work of Mao Zedong, Foreign Languages Press, Beijing. 1975, Vol. II, P. 342) I এখানে আমাদের মধ্যে একটি বিভ্রান্তি থাকতে পারে চীনের তথাকথিত 'গণতান্ত্রিক সমাজ নিয়ে। আমরা পশ্চিমাবিশ্বে বহু দল, ব্যক্তি খাত, তথা বাজার অর্থনীতিনির্ভর যে গণতন্ত্র বিকশিত হতে দেখেছি, চীনে কিন্তু ১৯৪৯ সালের বিপ্লবের পর সে ধরনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মাও জে দংও এমনটি চাননি। তাদের ভাষায় "গণতন্ত্র হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টির একক নেতৃত্বে পরিচালিত একটি সমাজব্যবস্থা, সেখানে বহু দলের কোনাে অস্তিত্ব নেই। সেই সমাজব্যবস্থায় শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমজীবী মানুষের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। আর সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বলতে বােঝানাে হয়েছিল সকল ধরনের উৎপাদনব্যবস্থা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত হবে। আর এর মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদের অবসান ঘটবে। একই সাথে চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল বিশ্ব বিপ্লবেরই একটা অংশ। চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব মার্কসবাদ, লেনিনবাদ ও মাওবাদ দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। চীনা বিপ্লবের একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল, সেখানে কৃষকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ। মাও জে দং মনে করতেন চীনের সমাজব্যবস্থা যেহেতু কৃষিনির্ভর, সেহেতু কৃষকরাও শিল্প -কারখানার শােষিত মানুষদের মতাে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে পারেন। মার্কস যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কল্পনা করেছিলেন, সেখানে কৃষকদের ভূমিকা উহ্য ছিল। কল-কারখানার শ্রমিকদের ভূমিকাকে মার্কস দেখেছিলেন বড় করে। মাও জে দং মার্কসবাদকে চীনা সমাজের আলােকেই নতুন করে উপস্থাপন করেছিলেন।
চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তাৎপর্য
প্রতিটি বিপ্লবের ন্যায় চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবও বিশ্বব্যবস্থায় এক বিরাট পরিবর্তন সাধন করেছিল। মানবসমাজের বিবর্তনের ধারায় ওই বিপ্লব যথেষ্ট তাংপর্যবাহী। বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে সংঘটিত বিশ্বের সমস্ত ঘটনার মধ্যে চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। এই বিপ্লবের প্রভাব, প্রতিক্রিয়া কেবল চীনের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকেনি, এর দ্বারা অন্যান্য দেশের মুক্তি-আন্দোলনও প্রভাবিত হয়েছে। চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।
প্রথমত, সমাজতান্ত্রি বিপ্লব বিশ্বের ওই অঞ্চলের এক বিরাট সংখ্যক মানুষকে সাম্রাজ্যবাদী ও সামন্ততান্ত্রি শােষণ থেকে মুক্ত করেছিল।
দ্বিতীয়ত, চীনের সমাজতান্ত্রি বিপ্লব মার্কসবাদের প্রায়ােগিক মূল্য প্রমাণ করেছে মার্কসবাদ যে ইউরোপীয় দর্শন নয় এবং এর সার্বজনীন প্রয়োগে যােগ্যতা আছে, বিপ্লবের মধ্যে তা প্রমাণিত হয়েছিল। যদিও এখানে মাও নতুন কিছু উপাদান যুক্ত করেন।
তৃতীয়ত, চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব মার্কসবাদের সৃজনশীল ও প্রয়ােজনীয় গুরুত্বকে তুলে ধরেছিল। মার্কসবাদে সমাজ বিবর্তনের সাধারণ নিয়মের পাশাপাশি জাতীয় বৈশিষ্ট্যে উপর গুরুত্ব আরোপ করে। মাও জে দং এই নীতি অনুসরণ করেছিলেন। মূলত, মার্কসবাদের সৃজনশীল প্রয়োগ ও ব্যাখ্যার ফলেই চীনের বিপ্লব সাফল্য লাভ করেছিল।
চতুর্থত, এই বিপ্লবের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছিল কৃষকশ্রেণীর দ্বারা বিপ্লব সম্ভব। কৃষকশ্রেণীর কর্মকাও, দৃঢ় সংকল্প, দক্ষতা, রাজনৈতিক চেতনা সংগঠিত প্রয়াসই বিপ্লবের ক্ষত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এই বিপ্লব সেটাই প্রমাণ করেছিল।
পঞ্চমত, সর্বহারাশ্রেণীর রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে কেবল কমিউনিস্ট পার্টি যে শােষণভিত্তিক সমাজের অবসান ঘটাতে পারে, চীনের সমাজততান্ত্রিক বিপ্লব তা প্রমাণ করেছিল। কেননা চীনের গণবিপ্লব সফল হয়েছিল চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সার্থক নেতৃত্বের কারণেই।
চীনের গণবিপ্লব ও অক্টোবর বিপ্লবের মধ্যে তুলনামূলক আলােচনা
চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে এবং অক্টোবর বিপ্লবের প্রভাবেই চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। উভয় বিপ্লব পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটালেও এদের মধ্যে বেশ কিছু সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
সাদৃশ্য
- রাশিয়া ও চীন উভয় দেশেই কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছিল
- উভয় দেশের বিপ্লবের নেতৃত্ব সর্বহারাশ্রেণীর হাতে ছিল;
- উভয় বিপ্লবের ক্ষেত্রেই শ্রমিক-কৃষকের মৈত্রী বন্ধনকে মৌলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল;
- দুটি বিপ্লবেরই চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল "রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল এবং সর্বহারাশ্রেণীর শ্রেণীশাসন ও শােষণের অবসান এবং মার্কসীয় মতাদর্শ অনুসারে সমাজ প্রতিষ্ঠা ছিল দুটি বিপ্লবের চূড়ান্ত লক্ষ্য;
- উভয় বিপ্লবের মাধ্যমেই মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের বৈজ্ঞানিক ভিত্তির যথার্থতা প্রমাণিত হয়েছিল।
বৈসাদৃশ্য
- ভিন্ন ভিন্ন আর্থসামাজিক অবস্থায় বিপ্লব দুটি সংঘটিত হয়েছে। অক্টোবর বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ায় আর চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল ঔপনিবেশিক, আধা ঔপনিবেশিক ও আধা সামন্তান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে
- দুটি বিপ্লবের মধ্যে শ্রেণীবিন্যাস ও কৌশলগত পার্থক্য ছিল। অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু চীনে তা হয়নি। চীনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মাও জে দং-এর ধারণা অনুযায়ী নয়াগণতন্ত্র,
- দুটি বিপ্লবের প্রাথমিক লক্ষ্য ভিন্ন ছিল। অক্টোবর বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল- পুঁজিবাদের অবসান। অপরদিকে, চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল সম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রের অবসান;
- চীনের বিপ্লবে পাতি বুর্জোয়া ও জাতীয় বুর্জোয়ারাও সাহায্য করেছিল, কিন্তু রাশিয়ায় বুর্জোয়ারা বিরােধী ভূমিকা পালন করেছিল;
- অক্টোবর বিপ্লবের মূলকেন্দ্র ছিল শহর। তাই শহরেই প্রথম বিপ্লব ঘটেছিল এবং পরে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়। অপরদিকে চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কেন্দ্র ছিল গ্রাম। মাও জে দং গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও-এর নীতি অনুসরণ করেছিলেন;
- চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হবার পূর্বে গৃহযুদ্ধ বিরাজমান ছিল। কিন্তু রাশিয়াতে বিপ্লব শেষ হবার পর গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল ।
চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের উপর অক্টোবর বিপ্লবের প্রভাব
রাশিয়ার মহান অক্টোবর বিপ্লব বিশ্বের ইতিহাসে একটি নবযুগের সম্ভাবনা সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিল। চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের উপর এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। অনেকের মতে, অক্টোবর বিপ্লবের ধারাবাহিক ফল ছিল চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। আবার কারাে মতে, সবরকম গণবিপ্লবের সাধারণ পথের সন্ধান দিয়েছে ওই অক্টোবর বিপ্লব। ওই বিপ্লব রাশিয়ার সুদীর্ঘকালের স্বৈরাচারী জার শাসনের অবসান ঘটিয়েছে এবং প্রমাণ করেছিল সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী শক্তি পতনের উর্ধ্বে নয়। ওই বিপ্লব পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের উপনিবেশগুলোর শ্রমজীবী ও নিপীড়িত মানুষের মনে বিপ্লবী চেতনা উজ্জীবিত করেছিল এবং সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের বীজবপন করেছিল। মহান অক্টোবর বিপ্লবের সাফল্যের পরই দুনিয়ার সর্বত্র বিশেষত উপনিবেশগুলােতে মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়। অক্টোবর বিপ্লবের ঐতিহাসিক সাফল্য চীনের জনগণকে উজ্জীবিত করেছিল এ বিষয়ে কোনাে দ্বিমত নেই। প্রকৃতপক্ষে, অক্টোবর বিপ্লবের পরই চীনের মুক্তিকামী মানুষ মুক্তির সঠিক পথ খুঁজে পেয়েছিল এবং চীনের শ্রমিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়েছিল। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর তারা সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদ বিরােধী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে, যা চীনের জনগণকে চীনের বুদ্ধিজীবী গােষ্ঠী, যুব-ছাত্র সম্প্রদায় অক্টোবর বিপ্লবের মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর পৃথিবীর যে দেশেই নিপীড়িত মানুষ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে সামিল হয়েছে, সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন সব রকম সহযােগিতা করেছে। চীনের গণবিপ্লবের সব পর্যায়ে সােভিয়েত ইউনিয়ন সাহায্য করেছে।
বিপ্লব পরবর্তী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর চীনে ব্যাপক কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল ওইসব কর্মসূচি সমাজতন্ত্রকে আরাে শক্তিশালী করার জন্য নেয়া হলেও, কোনাে কোনাে কর্মসূ্চি পরবর্তীকালে যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করে। ওইসব কর্মসূচি নিয়ে আলােচনা করা যেতে পারে
১ শুদ্ধি অভিযান :
১৯৫৩ সালের পর মাও জে দং দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান চালান। দল যাতে দ্ধিধাবিভক্ত হতে না পারে এজন্য সমাজতন্ত্র বিরােধীদেরকে তিনি দল থেকে বের করে দেন। এরপর তিনি রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি, শিল্প, ভূমি ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য কার্যপ্রণালি ঘােষণা করেন। শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য তিনি শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান। দরিদ্র কৃষকদের তিনি শিক্ষার সুযােগ দেন এবং বিনাবেতনে শিক্ষা ও বিনামূল্যে বই বিতরণের ব্যবস্থা করেন।
২. শত ফুল ফুটতে দাও :
১৯৫৬ সালে মাও জে দং চীনে "শতফুল ফুটতে দাও" নীতি অনুসরণ করেন। অর্থাৎ তিনি রাষ্ট্রের বিভিন্নমুখী চিন্তাধারা প্রকাশে বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে স্বাধীনতা প্রদান করেন। তিনি সমাজতন্ত্র বিরােধী সকল বুদ্ধিজীবীদের নিকট থেকে কমিউনিস্ট পার্টির নীতির সমালােচনা আহ্বান করেন। তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, কমিউনিস্ট পার্টি নিজেকে সব সময় সঠিক বলে মনে করে না এবং সমালােচনা শুনতে আগ্রহী।
৩. Great Leap Forward Programme :
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য স্থায়ী বিপ্লব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মাও জে দং বিশ্বাস করতেন। স্থায়ী বিপ্লবের মধ্যে দেশে অথনৈতিক উন্নয়নের জন্য যে চেষ্টা করা হয় তা-ই Great Leap Forward নামে পরিচিত। যুদ্ধবিধ্বস্ত চীনকে অগ্রগতির দিকে নিয়ে যাওয়া-ই ছিল এই তত্ত্বের মূল উদ্দেশ্য। এর অন্যান্য উদ্দেশ্যগুলো ছিল- দেশকে অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিকে এগিয়ে দেয়া, ভূমি সংস্কারের মধ্য দিয়ে জনগণের অবস্থার উন্নয়ন ঘটানাে, কৃষিভিত্তিক চীনে শিল্পের প্রসার ঘটানাে, জমিগুলােকে ব্যক্তি মালিকানা থেকে সরকারি মালিকানায় নিয়ে যাওয়া ও কতকগুলাো কমিউনে ভাগ করা। Great Leap Fornward-এর ফলে সৃষ্ট অরাজকতা চীনের অর্থনীতিতে মারাত্বক বিপর্য় বয়ে আনে । ফলে সেই বিপর্যয় রােধ করার জন্য ডানপন্থীদের প্রভাব কমানাের জন্য মাও জে দং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা করেন।
৪. সাংস্কৃতিক বিপ্লব :
Great Leap Forward ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে চীনি কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে চরমপন্থি ও মধ্যপন্থিদের মধ্যে বড় রকমের মতবিরোধ দেখা দেয় এবং মাও জে দং পুনরায় সমালােচনার শিকার হন। ফলে তিনি ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন। এর পদক্ষেপ হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হতে তিনি তাঁর মতবিরােধীদের ও আমলাদের অপসারণ এবং জনগণের চিন্তাধারা ও মনােবলকে আরাে বিপ্লবীরূপে গড়ে তােলার জন্য ১৯৬৫ সালে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে এক আন্দালনের সূচনা করেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল- "রাষ্ট্র পর্যায়ের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সার্বিক উন্নতি সাধন করা।" ১৯৬৬ সালের মধ্যভাগে মাও জে দং কমিউনিস্ট পার্টির কট্টরপন্থিদের প্রতি তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করে সমগ্র চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্রবের ঢেউ ছড়িয়ে দেন। তিনি তাঁর অনুসারী ছাত্রদের নিয়ে 'রেডগার্ড নামে আধা সামরিক বাহিনী গঠন করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল- সংশােধনবাদ নির্মূল করা, চীনা জনগণের মধ্যে বুর্জোয়া চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ রোধ করা, চীনের সর্বস্তরে বিপ্লবীধারা অব্যাহত রাখা। বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে মাও জে দং-এর অনুসারীরা উগ্রপন্থার আশ্রয় নেন। বিপ্লবের নামে উর্ধ্বতন দলীয় ও সরকারি কর্মকর্তাদেরকে তাদের পদ থেকে অপসারণ করা হয়। এর মধ্যে চীনের রাষ্ট্রপ্রধান লিং সাউ চি-কে ১৯৬৮ সালে দলীয় ও রাষ্ট্রীয় সকল পদ থেকে অপসারণ করা হয়। মাও জে দং-এর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ফলে চীনে অরাজকতা সষ্টি হয়। এ কারণে মাও জে দং রেডগার্ডদের বাড়াবাড়ি দমনের জন্য ১৯৬৭ সালে সেনাবাহিনী আহ্বান করেছিলেন।
উপসংহার : চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্রব চীন তথা বিশ্বব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। চীনে সামন্তবাদী ও পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে চীনের শােষিত জনগণ তাদের অধিকার পেয়েছিল। ভূস্বামীদের অত্যাচার থেকে তারা মুক্তি পেয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদী শােষণ, উপনিবেশিক শােষণ এবং পুঁজিবাদের ধারক চিয়াং কাইশেকের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল চীনের জনগণ। মাও জে লং এর দূরদর্শী নেতৃত্ব ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের ফলেই চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব নিয়েও কথা থেকে যায়। চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ভারত, এমনকি সুদূর ল্যাতিন আমেরিকার পেরুতে বিপ্লবীদের "মাওবাদী বিপ্লবে উদ্ধুদ্ধ করলেও, সাংস্কৃতিক বিপ্লব খােদ চীনে এবং বহির্বিশ্বে চীনের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছিল। ওই সময় অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কারণে চীনের বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। যদিও এটা বলা হয়ে থাকে যে, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় পার্টির ভেতরে অতিবামদের একটা অংশ মাও জে দংকে ব্যবহার করে ক্ষমতা নিজেদের হাতে করায়ত্ত করতে চেয়েছিল। এদের উপর মাও জে দং-এর কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। মাও জে লং-এর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে চীনে তথাকথিত "চার কু-চক্রীর" জন্ম হয়েছিল। চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলেও কালের ধারাবাহিকতায় সেখানে কিছু কিছু সংস্কার সাধিত হয়। চীনের সমাজতন্ত্রের মূলনীতিগুলাে ঠিক রেখে সেখানে এক ধরনের বাজার অর্থনীতি গড়ে উঠেছে। ফলে চীনের জনগণ স্বাধীনভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ব্যক্তিগত শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারছেন। সমাজতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতি এ দুই-এর সমন্বয়ে চীন ধীরে ধীরে বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বলা হচ্ছে একুশ শতক হবে চীনের । আগামী বিশ থেকে ত্রিশ দশকের মধ্যে চীন অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। তবে আগামী দিনে চীনে কোন ধরনের সমাজব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়, সমাজতন্ত্র বর্তমান ধারা একইভাবে থাকবে, নাকি সেখানে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটবে এটা দেখার জন্য আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
সহায়ক গ্রন্থাবলি
Piter Callocoresi, "World Politics since' 1945, 4th Edition Longman New York 1982.
অরুণ কুমার সেন, সুশীল কুমার সেন, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, 'চীনের শাসন ব্যবস্থা, কলকাতা, ১৯৮২.
হরিপ্রসাদ চট্রোপাধ্যায়, চীনের ইতিহাস' কলকাতা, ১৯৯৩
চিয়ান পােজান, শাও স্যন চেং, হু হুয়া, চীনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস', বেইজিং, চীন ১৯৮৯।