চীনের গণবিপ্লব ও অক্টোবর বিপ্লবের মধ্যে তুলনামূলক আলােচনা।
চীনের গণবিপ্লব ও অক্টোবর বিপ্লবের মধ্যে একটি তুলনামূলক আলােচনা কর।
All kinds of arguments against the peasant movement must be speedily set right. The erroneous measures taken by the revolutionary authorities concerning the peasant movement must be spcedily changed. Only thus can any good be done for the future of the revolution.Mao Zedong (Quoted in William T. De Bary ed. Source of Chinese Tradition, 1960)
পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায়, যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। বিপ্লবের মাধ্যমে নিষ্পেষিত জনগণ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিপ্লবের মাধ্যমে মুক্তিকামী, স্বাধীনচেতা জনগণ দেশের প্রচলিত স্বৈরাচারী, অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করেছে। এখানে অবশ্য একটি কথা বলা প্রয়োজন, জনগণের ভিতর মুক্তির আকাঙ্ক্ষা না থাকলে, জনগণ স্বতঃফূর্তভাবে অংশ না নিলে কোনাে বিপ্লবই সফল হতে পারে না। বিংশ শতাব্দীতে চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা। কৃষিভিত্তিক একটি সমাজেও যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে, চীনা বিপ্লব সেটা প্রমাণ করেছিল। সেইসাথে বিংশ শতাব্দী শেষ হবার আগেই সারা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছিল চীনা সমাজতন্ত্রের নয়ারূপ-সমাজতান্ত্রিক প্রতিটি বিপ্লবের ন্যায় চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বিশ্বব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে চীন হচ্ছে দ্বিতীয় রাষ্ট্র যেখানে রাশিয়ার পর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হলেও রাশিয়ায় যেভাবে সমাজতন্ত্র বিকশিত হয়েছে, চীনে সেভাবে হয়নি। কারণ সােভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে যে সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে কৃষকশ্রেণীর ভূমিকা ছিল বড়। চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলে পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটেছিল। এর পরিবর্তে সেখানে গড়ে উঠেছিল সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। চীনের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন মাও জে দং(মাও সে তুং)। মূলত, তাঁর দূরদর্শিতা ও সফল নেতৃত্বের কারণেই চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফলতা পেয়েছিল। পরবর্তীকালে আশির দশকে সেই সমাজতন্ত্রকে আরাে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন আরেক অবিসংবাদিত নেতা দেং জিয়াও পিং। চীনে বর্তমানে 'বাজার নির্ভর সমাজতন্ত্র' বিনির্মাণের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তার ভিত্তি রচনা করেছিলেন দেং জিয়াও পিং। বলতে বাধা নেই চীন এখন আর ধ্রুপদী মার্ক্সবাদ অনুসরণ করে না। মার্ক্সবাদ মাওবাদের সাথে বাজারনির্ভর অর্থনীতির কিছু কিছু উপাদান সংযোজিত হয়েছে। এটাই চীনা সমাজতন্ত্রের সৌন্দর্য।
চীনের গণবিপ্লব ও অক্টোবর বিপ্লবের মধ্যে তুলনামূলক আলােচনা
চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে এবং অক্টোবর বিপ্লবের প্রভাবেই চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। উভয় বিপ্লব পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটালেও এদের মধ্যে বেশ কিছু সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
সাদৃশ্য
- ১. রাশিয়া ও চীন উভয় দেশেই কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছিল
- ২. উভয় দেশের বিপ্লবের নেতৃত্ব সর্বহারাশ্রেণীর হাতে ছিল;
- ৩. উভয় বিপ্লবের ক্ষেত্রেই শ্রমিক-কৃষকের মৈত্রী বন্ধনকে মৌলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল;
- ৪. দুটি বিপ্লবেরই চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল "রাষ্ট্র ক্ষমতা" দখল এবং সর্বহারাশ্রেণীর শ্রেণীশাসন ও শােষণের অবসান এবং মার্কসীয় মতাদর্শ অনুসারে সমাজ প্রতিষ্ঠা ছিল দুটি বিপ্লবের চূড়ান্ত লক্ষ্য;
- ৫. উভয় বিপ্লবের মাধ্যমেই মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের বৈজ্ঞানিক ভিত্তির যথার্থতা প্রমাণিত হয়েছিল।
বৈসাদৃশ্য
- ৬. ভিন্ন ভিন্ন আর্থসামাজিক অবস্থায় বিপ্লব দুটি সংঘটিত হয়েছে। অক্টোবর বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ায় আর চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল ঔপনিবেশিক, আধা ঔপনিবেশিক ও আধা সামন্তান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে
- ৭. দুটি বিপ্লবের মধ্যে শ্রেণীবিন্যাস ও কৌশলগত পার্থক্য ছিল। অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু চীনে তা হয়নি। চীনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মাও জে দং-এর ধারণা অনুযায়ী নয়াগণতন্ত্র,
- ৮. দুটি বিপ্লবের প্রাথমিক লক্ষ্য ভিন্ন ছিল। অক্টোবর বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল- পুঁজিবাদের অবসান। অপরদিকে, চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল সম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রের অবসান;
- ৯. চীনের বিপ্লবে পাতি বুর্জোয়া ও জাতীয় বুর্জোয়ারাও সাহায্য করেছিল, কিন্তু রাশিয়ায় বুর্জোয়ারা বিরােধী ভূমিকা পালন করেছিল;
- ১০. অক্টোবর বিপ্লবের মূলকেন্দ্র ছিল শহর। তাই শহরেই প্রথম বিপ্লব ঘটেছিল এবং পরে গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়। অপরদিকে চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কেন্দ্র ছিল গ্রাম। মাও জে দং গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও-এর নীতি অনুসরণ করেছিলেন;
- ১১. চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হবার পূর্বে গৃহযুদ্ধ বিরাজমান ছিল। কিন্তু রাশিয়াতে বিপ্লব শেষ হবার পর গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল ।
উপসংহার : চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্রব চীন তথা বিশ্বব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। চীনে সামন্তবাদী ও পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে চীনের শােষিত জনগণ তাদের অধিকার পেয়েছিল। ভূস্বামীদের অত্যাচার থেকে তারা মুক্তি পেয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদী শােষণ, উপনিবেশিক শােষণ এবং পুঁজিবাদের ধারক চিয়াং কাইশেকের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল চীনের জনগণ। মাও জে লং এর দূরদর্শী নেতৃত্ব ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের ফলেই চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব নিয়েও কথা থেকে যায়। চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ভারত, এমনকি সুদূর ল্যাতিন আমেরিকার পেরুতে বিপ্লবীদের "মাওবাদী বিপ্লব" উদ্ধুদ্ধ করলেও, "সাংস্কৃতিক বিপ্লব" খােদ চীনে এবং বহির্বিশ্বে চীনের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছিল। ওই সময় অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কারণে চীনের বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। যদিও এটা বলা হয়ে থাকে যে, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় পার্টির ভেতরে অতিবামদের একটা অংশ মাও জে দংকে ব্যবহার করে ক্ষমতা নিজেদের হাতে করায়ত্ত করতে চেয়েছিল। এদের উপর মাও জে দং-এর কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। মাও জে লং-এর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে চীনে তথাকথিত "চার কু-চক্রীর" জন্ম হয়েছিল। চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলেও কালের ধারাবাহিকতায় সেখানে কিছু কিছু সংস্কার সাধিত হয়। চীনের সমাজতন্ত্রের মূলনীতিগুলাে ঠিক রেখে সেখানে এক ধরনের বাজার অর্থনীতি গড়ে উঠেছে। ফলে চীনের জনগণ স্বাধীনভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ব্যক্তিগত শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারছেন। সমাজতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতি এ দুই-এর সমন্বয়ে চীন ধীরে ধীরে বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বলা হচ্ছে একুশ শতক হবে চীনের । আগামী বিশ থেকে ত্রিশ দশকের মধ্যে চীন অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। তবে আগামী দিনে চীনে কোন ধরনের সমাজব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়, সমাজতন্ত্র বর্তমান ধারা একইভাবে থাকবে, নাকি সেখানে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটবে এটা দেখার জন্য আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।