লীগ অফ নেশনস এর আদ্যোপান্ত।

লীগ অফ নেশনস-এর উৎপত্তি, গঠনপ্রকৃতি ও বিলুপ্তির কারণ সমূহ আলোচনা কর। লীগ অফ নেশনস কেন ব্যর্থ হয়?

Unfortunately, the League faltered in the 1930s as several revisionist states pursued their radical goals by acts of aggression.
Conway W. Henderson (International Relation, Conflict and Cooperation at the Turn of the 21st Century, 1998)

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় একটি বিশ্বসংস্থা "লীগ অফ নেশনস"-এর জন্ম যেমনি ওই সময় বিশ্ববাসীকে আশার আলো দেখিয়েছিল, ঠিক তেমনি মাত্র কয়েকবছরের মধ্যে সংস্থাটির অবলুপ্তি বিশ্ববাসীকে নিমজ্জিত করেছিল হতাশার সাগরে। ১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, বিশ্ব পরিস্থিতিকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসে এটি ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এর ব্যাপকতা ও ধ্বংসযজ্ঞ সমগ্র বিশ্ববাসীকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। এমতাবস্থায় চিন্তাশীল ব্যক্তিরা ভাবতে থাকেন কিভাবে যুদ্ধের সম্ভাবনা বন্ধ করে আন্তর্জাতিক শান্তি স্থায়ী করা যায়। প্রকৃতপক্ষে দেখা যায় যে, বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বিবাদ ও বিরােধ বেধে যাওয়া যে কোনাে সময় সম্ভব ছিল, এই বিরােধের নিষ্পত্তির জন্য বল প্রয়ােগের পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ পন্থা গ্রহণর জন্যও চিন্তাভাবনা করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এই চিন্তাধারাকে প্রবল করে। পােপ পঞ্চদশ বেনেডিষ্ট ১৯১৭ সালে আর যুদ্ধ না করে আপােস ও আলোচনার দ্বারা আন্তর্জাতিক বিরোধ মেটাবার আহ্বান জানান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ১৯১৭ সালের ২ এপ্রিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোেপে শান্তি স্থাপনের জন্য তার ১৪ দফা নীতি ঘোষণা করেন। ওই চতুর্দশ নীতির ১৪নং ধারায় বলা হয়েছিল, "বৃহৎ ও ক্ষুদ্র সকল রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন করতে হবে।" উইলসন বলেছিলেন,

An evident principle runs through the whole programme I have outlined. It is the principle of justice to all people and nationalities and their right to live on equal terms of liberty and safety with one another, where they be strong or weak.

প্যারিস শান্তি সম্মেলনে (১৯১৯) উইলসনের প্রস্তাব উত্থাপিত হলে ১৯ সদস্যের এক কমিটিকে লীগ অফ নেশনসের গঠনতন্ত্র রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। উইলসন ওই সমিতির প্রধান ছিলেন। এই সমিতি লীগ অফ নেশনস গঠনের জন্য একটি খসড়া সংবিধান রচনা করে। প্যারিসের সম্মেলনে খসড়াটি অনুমােদিত হয় এবং ভার্সাই সন্ধির প্রথম খণ্ডে এই খসড়া গৃহীত হয়। এর ফলে লীগ অফ নেশনস গঠিত হয়; এখানে একটা কথা বলা প্রয়াজন যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লবের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সহযােগিতা সম্প্রসারিত হয়। এতে করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থারও আবির্ভাব হয়। বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে দ্বি-পাক্ষিক, বহুপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদিত হয়, এছাড়াও ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু সমিতি সেই সময়ে গঠিত হয়। আন্তর্জাতিক সংগঠনের পদ্ধতি এবং কৌশলগত দিক থেকে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও কমিশন যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। এগুলাের মধ্যে ১৮১৪ সালের ভিয়েনা চুক্তি, ১৮৭৪ সালের ইউনিভার্সেল পােস্টাল ইউনিয়ন প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। অতঃপর ১৮৯৯ সালের প্রথম হেগ সম্মেলন, এবং ১৯০৭ সালের দ্বিতীয় হেগ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তােলার উদ্যোগ গৃহীত হয়েছিল। ওই দুটো সম্মেলনেই যৌথ নিরাপত্তাব্যবস্থা এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরোধ মীমাংসার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। ১৯১৪ সালে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় তখন থেকেই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি আন্তর্জাতিক স্থায়ী সংগঠন প্রতিষ্ঠার দাবিতে ইউরােপ ও যুক্তরাষ্ট্রের কতিপয় নেতৃবৃন্দ দাবি উত্থাপন করেন। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ যুদ্ধের শুরুতেই শান্তি রক্ষাকল্পে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার পরিকল্পনা গ্রহণে সচেষ্ট হয়েছিলেন। আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রপতি ট্যাফটের (১৯০৯-১৯১৩) নেতৃত্বে ইতােমধ্যে "শান্তির জন্য লীগ" প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন (১৯১৩-১৯২১) এবং রুজভেল্টও (১৯০১-১৯০৯) এর সাথে সম্পৃত্ত ছিলেন। এদিকে ১৯১৭ সালে পােপ পঞ্চদশ বেনেডিক্ট সালিসির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিরােধ মীমাংসার জন্য একটি স্থায়ী কেন্দ্রীয় সংস্থা গঠনের দাবি জানিয়েছিলেন। ১৯১৯ সালের ২৮ এপ্রিল প্যারিস শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে ৩২টি দেশের প্রতিনিধিরা যােগদান করেন। আর এতে সভাপতিত্ব করেন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন। প্রতিনিধিবর্গ সর্বসম্মতিক্রমে একটি চুক্তির মুসাবিদা রচনা করেন। ১৯২০ সালের ১০ জানুয়ারি বিশ্বের সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসেবে "লীগ অফ নেশনস"-এর কাজ শুরু হয়। এই লীগ অফ নেশনসের প্রথম মহাসচিব নিযুক্ত হয়েছিলেন স্যার এ্যারিক ড্রম। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, যে প্রত্যাশা নিয়ে লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই প্রত্যাশা লীগ পূরণ করতে পারেনি। লীগের কাউন্সিলের আগ্রাসী রাষ্ট্র বা শক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা থাকলেও কোনো আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। ফলে লীগ অফ নেশনস অকার্যকর হয়ে পড়ে ও আপনা আপনি বিলুপ্ত হয়ে যায়।

লীগ অব নেশনস-এর গঠন

লীগ অব নেশনস-এর পরিচালনার জন্য পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশ নিয়ে একটি পরিষদ বা কাউন্সিল গঠিত হয়। ওই পরিষদে চারটি অস্থায়ী সদস্য থাকবে তাও স্থির হয়। পাঁচটি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র ছিল ব্রিটেন, আমেরিকা, ফ্রান্স, ইতালি ও জাপান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লীগ অফ নেশনস-এ যােগদান না করায় স্থায়ী সদস্য পদে মাত্র ৪টি দেশ থাকে। যে সব মিত্রশক্তি লীগ অফ নেশনস-এর চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল তারা হলাে এর প্রথম পর্যায়ের সদস্য। এই সংখ্যা ছিল ৪০। আর বিজিত শক্তিসমূহের মধ্য থেকে যারা পরবর্তীকালে লীগ অফ নেশনসে যােগ দিয়েছিল তারা হলাে দ্বিতীয় পর্যায়ের সদস্য। এই সংখ্যা ছিল ৫০-এর উপরে।

লীগ অফ নেশনস তিনটি প্রধান শাখা নিয়ে গঠিত হয়েছিল।

১. সাধারণ সভা (Assembly);
২. কাউন্সিল (Council);
৩. সচিবালয় (Secretariat).

সাধারণ সভা

সাধারণ সভা লীগ অফ নেশনস-এর সকল সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। এতে প্রত্যক সদস্য রাষ্ট্র তিনজন করে সদস্য প্রেরণ করত সদস্য রাষ্ট্রের একটি মাত্র ভেটো দেয়ার অধিকার স্বীকৃত ছিল। এতে একজন সভাপতি এবং আটজন সহ-সভাপতি নির্বাচিত হতেন।

সাধারণ সভার কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ৬টি স্থায়ী কমিটি ছিল। এগুলো হলাে,

১. সাংগঠনিক ও আইন সংক্রান্ত কমিটি;
২. প্রযুক্তি সংক্রান্ত কমিটি;
৩. আয়-ব্যয় সংক্রান্ত কমিটি;
৪. অস্ত্রশস্ত্র সংক্রান্ত কমিটি;
৫. সামাজিক ও সাধারণ বিষয়ক কমিটি ও
৬. রাজনীতি বিষয়ক কমিটি।
প্রতিটি কমিটির একজন নির্বাচিত সভাপতি ছিল।

সাধারণ সভার কার্যাবলী

সাধারণ সভার কার্যাবলি ছিল নিম্নরূপ..

১. লীগ অফ নেশনসের মহাসচিব নির্ধারণ করা;
২. লীগের বাংসরিক বাজেট আলােচনা করা;
৩. লীগ পরিষদের অস্থায়ী সদস্যদের নির্বাচন করা;
৪. আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের বিচারক নির্ধারণ করা;
৫. যে কোনাে রাজনৈতিক বিষয়ে সুপারিশ আকারে সিদ্ধান্ত প্রদান করা ও
৬. বিশ্বশান্তির জন্য অপরিহার্য যে কোনাে প্রশ্নে হস্তক্ষেপ করা।

লীগ অফ নশনস-এর কোনাে সাধারণ সভার সকল সদস্যদের সম্মতির প্রয়োজন ছিল। শুধু কোনো নতুন রাষ্ট্রের সদস্য পদ প্রদানের বেলায় দুই-তৃতীয়াংশের ভােটের প্রয়োজন হতাে। প্রতি বছর জেনেভায় সাধারণ সভার অধিবেশন বসত। লীগ অব নেশনস-এর সমগ্র কার্যকলাপের মধ্য সর্বমোট ২০টি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

কাউন্সিল

কাউন্সিল ছিল লীগ অফ নেশনস-এর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শাখা। লীগ চুক্তিপত্রের প্রণেতাগণ এ মনােভাব নিয়েই এটি গঠন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কনসার্ট অব ইউরােপের ধারণা তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। কাউন্সিলে ছিল দু ধরনের সদস্য, যথা: স্থায়ী ও অস্থায়ী। স্থায়ী সদস্য ছিল ৫, যথা ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালি ও জাপান । কাউন্সিলের অস্থায়ী সদস্য ছিল ৪ এবং তারা অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের মাধ্যমে নির্বাচিত হতাে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লীগ অফ নেশনস-এ যোগদান করতে অস্বীকৃতি জানালে এর সদস্য সংখ্যা ৮ এসে দাঁড়ায়। ১৯২৬ সালে জার্মানি এবং ১৯৩৪ সালে রাশিয়া কাউন্সিলের স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করে। এভাবে ১৯৩৬ সাল নাগাদ এর সদস্য সংখ্যা ১১-তে উন্নীত হয়। এই কাউন্সিলের অধিবেশন বছরে তিনবার বসত। এছাড়া প্রয়ােজনবােধে মধ্যে মধ্যে এর বিশেষ অধিবেশনও বসত।

কাউন্সিলের কার্যাবলী

লীগ চুক্তিপত্রে এই কাউন্সিলের ক্ষমতা ও কার্যাদি বর্ণনা করা হয়েছে। এর ক্ষমতা ও কার্যাবলি নিম্নে দেয়া হলাে..

১. বিশ্বশান্তি রক্ষার বিষয়াদি আলােচনা করা;
২. অস্ত্র উৎপাদন ও নিরস্ত্রীকরণ সম্পর্কে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা;
৩. বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সীমানা নির্ধারণ করা;
৪. সংখ্যালঘু সমস্যার যথাযথ মীমাংসা করা;
৫. সদস্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখন্ডতা রক্ষা করা;
৬., সকল প্রকার আগ্রাসন রহিত করা;
৭. চুক্তি ভঙ্গকারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা;
৮. লীগ সচিবালয়ের বিভিন্ন নিয়ােগ অনুমােদন করা;
৯, লীগের সাধারণ সভাকে বিভিন্ন সংবাদ ও তথ্য সরবরাহ করা;
১০. বিভিন্ন কমিশনের নানাবিধ সুপারিশ কার্যকর করা।

এ থেকে বােঝা যায় যে, এই কাউন্সিল ছিল যথেষ্ট দায়িত্ববান ও শক্তিশালী।

সচিবালয়

লীগ অফ নেশনস-এর তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ শাখা ছিল সচিবালয়। এটি লীগের মহাসচিবের অধীনে স্থাপন করা হয়েছিল। লীগ পরিষদের অনুমোদনক্রমে সচিবালয়ের কর্মচারী নিয়ােগের দায়িত্ব মহাসচিবের ওপর অর্পিত হয়। মহাসচিবের অধীনে কয়েকশত কর্মচারী, দুইজন ডেপুটি সেক্রেটারি, এবং দুইজন আন্ডার সেক্রেটারি কর্মরত ছিলেন।

সচিবালয়ের কার্যাবলী

সচিবালয়ের উপরে নিম্নেবর্ণিত দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পণ করা হয়। আর তা হলাে :

১. লীগের সাধারণ সভা ও কাউন্সিলের নির্দেশসমূহ কার্যকর করা;
২. লীগের প্রয়ােজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র সংরক্ষণ করা;
৩. লীগের সাধারণ সভা ও কাউন্সিলের কার্যসূচি প্রণয়ন করা;
৪. লীগের কার্যাবলি সম্পর্কে প্রতিবেদন রচনা করা;
৫. আন্তর্জাতিক সংযােগ রক্ষা করা;
৬. বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খবরাখবর সংগ্রহ করা এবং এ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রচারমূলক পুস্তিকা প্রকাশ করা;
৭. লীগের সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়াদি ও সমস্যা সম্পর্কে খােজখবর রাখা এবং সে সম্পর্কে প্রতিবেদন পেশ করা;
৮. নীতি নির্ধারণ করা;
৯. কোনাে বাদী ও বিবাদী পক্ষের অভিযােগ পরিষদের নিকট প্রেরিত হলে পরে মহাসচিব তার অনুসন্ধান ও বিবেচনার ব্যবস্থা করতন;
১০. একটি স্থায়ী যােগাযােগ ব্যবস্থা হিসেবে লীগের সংস্থাসমূহের মধ্যে সংযােগ রক্ষা করা।

বস্তুত, লীগ অফ নেশনস-এর সকল বিভাগই সচিবালয়ের উপর কোনো না কোনােভাবে নির্ভরশীল ছিল। প্রকৃতপক্ষে সচিবালয় লীগ অফ নেশনস-এর মধ্যমণিতে পরিণত হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক বিচারালয়

লীগ অফ নেশনস-এর চুক্তিপত্রে একটি স্থায়ী আন্তর্জাতিক বিচারালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল। চুক্তির ১৪নং ধারায় বর্ণনা করা হয়েছিল যে, "লীগ একটি স্থায়ী আন্তর্জাতিক বিচারালয় গঠনের পর তা অনুমোদনের জন্য সদস্য রাষ্ট্রসমূহের নিকট পেশ করবে।" ১৫ জন বিচারক নিয়ে ঐ বিচারালয় গঠিত হতো । তাদের কার্যকালের মেয়াদ ছিল ৯ বছর। বিচারপতিগণ সদস্য রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক নির্বাচিত হতেন। নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে এ বিচারালয় স্থাপিত হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের কার্যাবলি

আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের কার্যাবলি ও দায়িত্ব ছিল নিম্নরূপ...

১. আন্তর্জাতিক বিচারালয় আন্তর্জাতিক সমস্যাদির ক্ষেত্রে বিচারকার্য পরিচালনা করা;
২. আন্তর্জাতিক বিচারালয় আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহের ব্যাখ্যা প্রদান করা;
৩. আন্তর্জাতিক বিচারালয় আইনের ব্যাখ্যা করা;
৪. আন্তর্জাতিক বিচারালয় আন্তর্জাতিক সন্ধি ও চুক্তিসমূহ লংঘনের বিচার করতে পারবে এবং
৫. আন্তর্জাতিক বিচারালয় লীগের সাধারণ সভা অথবা পরিষদ কর্তৃক অনুরোধপ্রাপ্ত হয়ে যে কোনাে বিরােধ বা প্রশ্নে উপদেশ প্রদান করতে পারবে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা

লীগ চুক্তিপত্রে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কোনাে উল্লেখ না থাকলেও এর ২৩নং ধারায় নারী পুরুষ ও শিশুদের শ্রমদানের মানবিক পরিবেশ সৃষ্টি করার দায় দায়িত্ব এর ওপর বর্তায়। লীগের সকল সদস্যই আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সদস্য ছিল। তবে লীগের সদস্য ছাড়াও এই সংস্থার সদস্য হওয়া যেত। যেমন, ১৯২৬ সালের পূর্বে জার্মানি লীগের সদস্য না হয়েও এর সদস্য ছিল। প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্র থেকে চারজন জনপ্রতিনিধি এর অধিবেশনে যোগদান করতে পারতেন এদের মধ্যে একজন শ্রমিক, ২ জন মালিক এবং ২ জন সরকারের প্রতিনিধি ছিলেন সাধারণ বৈঠকে দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে যে কোনো সুপারিশ করা যেত। মাসে অন্তত একবার বৈঠক বসবে বলে স্থির করা হয়। পরিচালকমন্ডলিতে ৩২ জন সদস্য ছিল, তার মধ্যে ৮ জন শ্রমিক পক্ষের, ৮ জন মালিক পক্ষের এবং ১৬ জন সরকার পক্ষের পরিচালকমন্ডলির পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার দফতর পরিচালনার জন্য মহাপরিচালক নিযুক্ত হতেন।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কার্যাবলী

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কার্যাবলি ও দায়িত্ব ছিল নিম্নরূপ...

১. শ্রমিকদের জন্য শ্রমনীতি নির্ধারণ করা;
২. শ্রমিকদের জন্য কল্যাণকর আইনকানুন প্রণয়ন এবং প্রথা প্রবর্তনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা;
৩. সামাজিক ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করা;
৪. বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা এবং এ বিষয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও পুস্তক প্রকাশ করা;
৫. শ্রমিকদের বেতন ও ভাতাদি বৃদ্ধিকল্পে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা;
৬. শ্রম সংক্রান্ত আইনের বিষয়ে সব সময় বিভিন্ন প্রতিবেদন পেশ করা। এই আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কেন্দ্রীয় দপ্তর ও সচিবালয় জেনেভায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।

লীগ অফ নেশনস-এর ব্যর্থতার কারণ

লীগ অফ নেশনস-এর ব্যর্থতার কারণসমূহ নিম্নে আলােচনা করা হলাে:

বৃহৎ শক্তির অনুপস্থিতি :

মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন লীগ অফ নেশনস-এর প্রধান প্রেরণাদাতা ছিলেন। কিন্তু মার্কিন সিনেট ভার্সাই চুক্তি অনুমোদন না করায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লীগ অফ নেশনস-এ যােগ দিতে পারেনি। লীগের চুক্তিপত্র ভার্সাই সন্ধির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। সুতরাং ভার্সাই চুক্তি অনুমোদন না করার অর্থ হলাে লীগ অফ নেশনস-এ যোগদানের সম্ভাবনা বাতিল করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতি ছিল লীগ অফ নেশনস-এর ওপর প্রচণ্ড আঘাতস্বরূপ।

২. মতানৈক্য

বিজয়ী ও বিজিত রাষ্ট্রগুলাের মধ্যে মতানৈক্য এবং জার্মানিকে সর্বতােভাবে পঙ্গু করে রাখার চেষ্টা লীগের মতাে এক আন্তর্জাতিক সংস্থার সাফল্যের প্রধান অন্তরায় ছিল।

৩. জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য

জাতীয় স্বার্থের ধারণার দ্বারা তখন রাষ্ট্রগুলাে অতি মাত্রায় প্রভাবিত ছিল। ফলে লীগের প্রতি তাদের অখন্ড আনুগত্য জন্মায়নি। আন্তর্জাতিক স্বার্থের খাতিরে জাতীয় স্বার্থ ত্যাগ করার মনােবৃত্তি তখন কোনাে দেশেরই ছিল না। এই কারণে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলাে তাদের নিজেদের স্বার্থের খাতিরে লীগের নীতি ও শর্তকে উপেক্ষা করতে কোনো সময়ই দ্বিধাবোধ করেনি

৪. সামরিক বাহিনীর অনুপস্থিতি :

আন্তর্জাতিক শান্তি এবং যুদ্ধ প্রতিরােধের জন্য প্রয়ােজন ছিল আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনীর। লীগ আক্রমণ বন্ধের জন্য কেবল প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারত। সেই প্রস্তাব কার্যকর করার মতাে কোনাে সামরিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা তার ছিল না। এর ফলে আক্রমণকারী কর্তৃক নির্দেশ লংঘনের ক্ষেত্রে লীগের পক্ষে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রয়ােগ করা সম্ভব হতাে না।

৫. সদস্যপদ প্রত্যাহারের প্রবণতা :

লীগ অফ নেশনস সদস্যপদ প্রত্যাহারের সুযোগ রেখেছিল। ফলে এই সুযােগে সামান্যতম অজুহাতে বন্ধুদেশ তাদের সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। এতে সদস্য সংখ্যা ৬৬ থেকে কমে ৪৯ এ দাঁড়িয়েছিল । সদস্যপদ প্রত্যাহারের এই প্রবণতা লীগের পতনের পথ প্রশস্ত করে।

৬. সমরাস্ত্র হ্রাসের ব্যর্থতা :

লীগের সনদে অস্ত্র হ্রাসের বিষয় উল্লেখ ছিল। কিন্তু ওই সময় হিটলার ক্ষমতায় আসার পর জার্মানি নতুন করে নিজেকে অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। ইতালি এবং জাপানও তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে। লীগ এ ক্ষেত্রেও তার সাফল্য অর্জন করতে পারেনি।

৭. তােষণ নীতি :

প্রকৃতপক্ষে ব্রিটেন ও ফ্রান্স লীগের ওপর কর্তৃত্ব করত। কিন্তু এ দু দেশের জার্মানির প্রতি তােষণনীতির কারণে জার্মানির আক্রমণাত্মক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে লীগ কোনাে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এটাও লীগের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ ছিল।

লীগ অফ নেশনস-এর বিলুপ্তি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যেই একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন হিসেবে লীগ অফ নেশনস-এর জন্ম হয়েছিল। কিন্তু যে আশা নিয়ে আন্তর্জাতিক সংগঠন হিসেবে লীগ আফ নেশনস-এর জন্ম হয়েছিল, সে আশা পূরণে লীগ ব্যর্থ হয়েছিল। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বলা যায় বৃহৎ শক্তিগুলোর অনুপস্থিতি । এছাড়া ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ছিল লীগ অফ নেশনস-এর অন্যতম চালিকাশক্তি, অনেক ক্ষেত্রে এদের মন যুগিয়ে অন্যদের চলতে হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় জার্মানিতে যখন হিটলার ক্ষমতায় এলেন তখন জার্মানি পুনরায় নতুন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হতে থাকে। কিন্তু লীগ এর বিরুদ্ধে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। তাছাড়া লীগের গঠনতন্ত্র এবং কাজকর্মে বহু ক্রটি-বিচ্যুতি ছিল। লীগের সাধারণ সভার হাতে কার্যত কোনো ক্ষমতাই ছিল না। লীগের অনেক কর্মকান্ডের কারণে সােভিয়েত ইউনিয়ন লীগকে ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর ক্লাব বলে আখ্যায়িত করেছিল। প্রভৃতি নানা কারণে লীগ অফ নেশনস-এর বিলুপ্তি ঘটে।

উপসংহার : মূলত বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে লীগ অফ নেশনস-এর জন্ম হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন সমগ্র বিশ্বের মানুষ এর ভয়াবহতা সম্পর্কে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল, ঠিক তখনই চিন্তাশীল ব্যক্তিরা বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এর ফলে আন্তর্জাতিক সংগঠন হিসেবে লীগ অফ নেশনস আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু যে স্বপ্ন, প্রত্যাশা এবং উদ্যম নিয়ে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা বাস্তবায়ন করা লীগ অফ নেশনস-এর পক্ষে সম্ভব হয়নি। বিশ্ব থেকে যুদ্ধভীতি দূর করে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা লীগ অফ নেশনস-এর পক্ষে সম্ভব হয়নি। লীগ অফ নেশনসের সবচেয়ে বড় ঘাটতি ছিল এর নিজস্ব কোনাে বাহিনী ছিল না। এটা এককভাবে কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারত না। লীগ অফ নেশনস বিশ্বকে পুরােপুরি নিরস্ত্রীকরণ করতে সক্ষম হয়নি। এর বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে জার্মানি। লীগ অফ নেশনস-এর সদস্য রাষ্ট্র সংখ্যা আস্তে আস্তে কমতে থাকায় এটা কার্যক্ষেত্রে গুরুত্বহীন হয়ে পড়তে থাকে। এই লীগ অফ নেশনস-এর ব্যর্থতার পর মনে করা হয়েছিল পৃথিবীর বুকে আর কোনাে আন্তর্জাতিক সংগঠন হয়তো সফলতা লাভ করতে পারবে না। কিন্তু এর বিলুপ্তির মধ্য দিয়েই জাতিসংঘের আবির্ভাব ঘটে।

Next Post Previous Post