ভার্সাই সন্ধির ফলাফল।
ভার্সাই সন্ধির ফলাফল আলােচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : জার্মানির সাথে সম্পাদিত ভার্সাই সন্ধি বিশ্বের কূটনৈতিক ইতিহাসে একটি উল্লেখযােগ্য ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯১৯ সালের ২৮ জুন ভার্সাই প্রাসাদে ভার্সাই সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। ভার্সাই সন্ধি ছিল ১৫টি অংশ ও ১৪৪টি ধারা সম্বলিত এক বিরাট দলিল। প্রকৃতপক্ষে ব্যাপকতা ও বিশালতার দিক থেকে বিচার করলে ভার্সাই সন্ধির অবস্থান ছিল ১৮১৫ সালে সম্পাদিত ভিয়েনা বন্দোবস্তের ঊর্ধ্বে । ভার্সাই সন্ধির মূল লক্ষ্য ছিল জার্মানিকে দুর্বল করে তোলা যাতে আগ্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে জার্মানি পুনরায় ইউরোপে শান্তি বিপন্ন করতে না পারে।
ভার্সাই সন্ধির ফলাফল
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, জার্মানির জন্য সামগ্রিকভাবে ভার্সাই চুক্তির ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। নিম্নে ভার্সাই সন্ধির ফলাফল আলোকপাত করা হলো :
১. জার্মানির সীমানা হ্রাস
ভার্সাই সন্ধির ফলে জার্মানির সীমানা হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। ভার্সাই সন্ধি অনুসারে জার্মানি ফ্রান্সের নিকট আলসাস ও লােরেন এবং বেলজিয়ামের নিকট ইউপেন ও ম্যালমেডি সমর্পণ করেন। কয়লা খনি সমৃদ্ধ সার এলাকা ১৫ বছরের জন্য ছেড়ে দিতে হয়। জার্মানির পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত পোসেন ও পশ্চিম প্রুশিয়া পোল্যান্ডকে দেওয়া হয়। ভার্সাই সন্ধির শর্ত অনুযায়ী জার্মানিকে তার সকল উপনিবেশ ত্যাগ করতে হয়। এভাবে প্রায় ২৫, ०০০ বর্গমাইল অঞ্চল জার্মানিকে পরিত্যাগ করতে হয়।
২. জাতিসংঘের ম্যান্ডেট ব্যবস্থার শাসন
ভার্সাই সন্ধি অনুসারে জার্মানিকে তার সমস্ত উপনিবেশ এবং অধিকৃত বৈদেশিক অঞ্চল সমর্পণ করতে হয়েছিল । প্রায় এক মিলিয়ন বর্গমাইলেরও অধিক অঞ্চল জার্মানি হস্তান্তর করে। মিত্রশক্তিগুলো এসকল অঞ্চল নিজেরা দখল করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট উইলসন এতে বাধ দেন। তার প্রস্তাব অনুযায়ী এসকল অঞ্চলে 'জাতিসংঘ ম্যান্ডেট ব্যবস্থার শাসন' প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩. জার্মানির সামরিক শক্তিহ্রাস
ভার্সাই সন্ধির উদ্দেশ্য ছিল সামরিক দিক থেকে জার্মানিকে স্থায়ীভাবে পঙ্গু করে ফেলা। তাই সেভাবেই ভার্সাই সন্ধি প্রণয়ন করা হয়েছিল । ভার্সাই সন্ধি অনুসারে জার্মানির সামরিক বাহিনীকে এক লক্ষের মধ্য সীমাবদ্ধ রাখা হয় এবং বাধ্যতামূলক সৈনিকবৃত্তি বন্ধ করা হয়। জার্মানিকে কোনো বিমানবাহিনী রাখার অনুমতি দেওয়া হয়নি। জার্মানির নৌবহরের সংখ্যা হ্রাস করা হয় এবং রাইন নদীর পূর্ব তীর হতে জার্মান সৈন্য অপসারিত করা হয়। ফলশ্রুতিতে জার্মানি সামরিক দিক থেকে কিছুদিনের জন্য-হলেও দুর্বল হয়ে পড়ে।
৪. ইউরােপে শক্তিশূন্যতা বৃদ্ধি
ভার্সাই সন্ধির ফলে ইউরোপে শক্তিশূন্যতা দেখা দেয়। একদিকে জার্মানিকে ছাটাই করে দুর্বল করে ফেলা হয় অপরদিকে হ্যাপসবার্গ ও জারের সাম্রাজ্য ভেঙে ফেলা হয়। এ রাজ্যগুলো ভেঙে যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য গড়া হয়, সেগুলাে আত্মরক্ষায় অক্ষম ছিল। ঐতিহাসিক এ. জি. পি. টেলর মনে করেন যে, শক্তিসাম্য রাজনীতি ইউরােপে শান্তি বজায় রাখতে সহায়ক হয়েছিল। শক্তিসাম্য ভেঙে পড়ার ফলেই ইউরোপ যুদ্ধের পথে ধাবিত হয়।
৫. ইউরােপের পুনর্গঠন
ভার্সাই সন্ধিতে জাতীয়তাবাদ ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার গৃহীত হয়। এ দুই নীতির উপর ভিত্তি করে ইউরোপের পুনর্গঠন করা হয়েছিল। এক জাতি এবং এক কৃষ্টি সম্বলিত জনগণকে পৃথক এবং স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অধিকার দেওয়ার নীতি গৃহীত হয়। এ নীতির প্রয়োগ করে অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যকে বিভক্ত করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি করা হয়েছিল। যেমন- চেকোশ্লোভাকিয়া ও যুগোশ্লাভিয়া। পােল অধিবাসিগণকে একত্রিত করে পোল্যান্ড রাষ্ট্র গঠন করা হয়।
৬. ভাইমার প্রজাতন্ত্রের জনপ্রিয়তা হ্রাস
ভার্সাই সন্ধি স্বাক্ষরের কারণে ভাইমার প্রজাতন্ত্রের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। পরাজিত জার্মানির পক্ষে ভার্সাই সন্ধি স্বাক্ষর দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। কিন্তু জার্মানির সাধারণ জনগণ তা মানতে রাজি ছিল না। তাদের চোখে ভার্সাই সন্ধি ছিল এক অতি নিষ্ঠুর রক্তাক্ত সন্ধি, যে সন্ধিতে প্রজাতন্ত্রী সরকার স্বাক্ষর দেয়।
৭. রুশ-জার্মান চুক্তি
ভার্সাই সন্ধি পরবর্তীতে রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি (১৯৩৯ সাল) সম্পাদন করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে জার্মানির ন্যায় রাশিয়াকেও উপেক্ষা করা হয়েছিল। রাশিয়ার সাথে কোনো আলােচনা না করে রুশ-পাোলিশ, রুশ-চেক ও রুশ-বাল্টিক সীমান্ত স্থির করায় রাশিয়া ভার্সাই সন্ধির বিরোধিতা করে। জার্মানির পরে ভার্সাই সন্ধির দ্বিতীয় প্রতিবাদী দেশ ছিল সােভিয়েত রাশিয়া। ১৯৩৯ সালে রুশ-জার্মান সহযােগিতায় ভার্সাই সন্ধি ভেঙে ফেলা হয়।
৮. ফ্যাসিবাদের উত্থান
ভার্সাই সন্ধির ফলে ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থান হয়। রাজ্যলাভের আশায় ইতালি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের পক্ষ অবলম্বন করেছিল। লন্ডনের গোপন সন্ধি অনুসারে ইতালি মিত্রপক্ষে যােগদান করেছিল। গােপন সন্ধি অনুসারে মিত্রপক্ষ ইতালিকে ট্রেন্টিনো, টাইরল, ট্রিয়েস্ট ও ডালমাশিয়া প্রদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। কিন্তু যুদ্ধান্তে ইতালি মিত্রপক্ষের নিকট হতে আশানুরূপ পুরস্কার লাভ করে নি। ডালমাশিয়া উপকলে ইতালির প্রাধান্য স্বীকৃতি পায় নি । উপনিবেশ সম্পর্কেও ইতালির আশা ভঙ্গ হয়। ভার্সাই সন্ধি বৈঠকে জার্মান উপনিবেশগুলো ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিলে এবং উত্তর আফ্রিকার ফরাসি উপনিবেশে স্থিতাবস্থা রক্ষা করা হলে ইতালির প্রতিনিধি কাউন্ট অর্ল্যান্ডো ভার্সাই সন্ধি বৈঠক ত্যাগ করেন। এর ফলে ইতালিতে উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, যা শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিস্ট শক্তিতে পরিণত হয়।
৯. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত
অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, ভার্সাই চুক্তিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহীত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে যুদ্ধে লিপ্ত অন্যান্য দেশের ন্যায় জার্মানিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু তদুপরি ক্ষতিপূরণের অজুহাতে জার্মানির নিকট হতে সাধ্যাতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়। জার্মানির শিল্পপ্রধান অঞ্চলগুলো ও সার এলাকার সমৃদ্ধ কয়লা খাঁনি অঞ্চল তার হস্তচ্যুত হয় এবং রাইন অঞ্চল বেসামরিকীকরণ হয়। ভার্সাই সন্ধি অনুসারে জার্মানি প্রায় পঁচিশ হাজার বর্গমাইল প্রায় সত্তর লক্ষ জনশক্তি ও শতকরা পনের ভাগের উপর কর্ষণযোগ্য ভূমি এবং শতকরা বারো ভাগ শিল্পকেন্দ্র হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে বিক্ষুব্ধ জার্মানির জনগণ প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য হিটলারের নেতৃত্বে তৎপর হয়ে উঠে। ই. এইচ. কার, জি. হার্ডি প্রমুখ ঐতিহাসিক মনে করেন, ভার্সাই চুক্তির কঠোরতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া রূপেই জার্মানিতে প্রতিশোধ স্পৃহা জাগ্রত হয় ও হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানি বলপূর্বক ভার্সাই চুক্তি সংশোধনের চেষ্টা করে এবং এর থেকেই যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯১৯ সালের ভার্সাই সন্ধি আধুনিক বিশ্বের কূটনৈতিক ইতিহাসে একটি যুগ সন্ধিক্ষণরূপে চিহ্নিত । সন্ধি রচনার সময় মিত্রশক্তি অহেতুক কঠোরতা দেখান এবং সন্ধি রক্ষার সময় অনাবশ্যক দুর্বলতা বা উদারতা দেখান। যদি জার্মানির উপর ন্যায্য আচরণ ও শর্তের ভিত্তিতে সন্ধি স্থাপন করা হতো তবে জার্মানি এ সন্ধি মানতে নৈতিক বাধ্যবাধকতা স্বীকার করতাে। বিশ বছরের মধ্যে এ সন্ধি এত সহজে ভেঙে পড়ত না।