সাধু ও চলিত ভাষার পার্থক্য ।

সাধু ও চলিত ভাষা রীতির পার্থক্য ও বৈশিষ্ট্য সমূহ আলোচনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : লেখ্য ভাষা হলো ভাষার লৈখিক রূপ । যে ভাষা কাগজে-কলমে লেখা হয় কিংবা সাহিত্যচর্চা, বই-পুস্তক, সংবাদমাধ্যমে ব্যবহৃত হয় তাই লেখ্য ভাষা। লেখ্য ভাষা মার্জিত, শুদ্ধ ও ব্যাকরণসিদ্ধ। লেখ্য ভাষার দুটি রীতি রয়েছে। সাধু ভাষারীতি ও প্রমিত লেখ্য বা চলিত ভাষারীতি।

সাধু ভাষারীতি

উনিশ শতকে বাংলার যে লিখিত রূপ গড়ে ওঠে তার নাম দেয়া হয় সাধু ভাষা। রাজা রামমােহন রায়ের মতে সাধু সমাজের লোকেরা যে ভাষা কহেন ও শুনেন সেই ভাষাই সাধু ভাষা।' অর্থাৎ বাংলা গদ্য সাহিত্যে ব্যবহৃত সংস্কৃত শব্দবহুল সুষ্ঠু, মার্জিত, সর্বজনবোধ্য অথচ নিয়মবদ্ধ ও কৃত্রিম ভাষারূপ হলো সাধুভাষা । যেমন : তখন তাহাকে জিজ্ঞাসাবাদ করিবার জন্য উকিলবাবু গাত্রোত্থান করিলেন।

সাধুভাষার বৈশিষ্ট্য

  1. সাধুভাষা গুরুগন্তীর ও তৎসম শব্দবহুল।
  2. সাধুভাষায় সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের পূর্ণরূপ ব্যবহৃত হয়।
  3. অসমাপিকা ক্রিয়ার পূর্ণরূপ ব্যবহৃত হয়।
  4. সাধুভাষায় অনুসর্গ পূর্ণরূপে ব্যবহৃত হয়।
  5. এ ভাষায় সন্ধি ও সমাসবদ্ধ শব্দের প্রাধান্য থাকে।
  6. সাধুভাষা মার্জিত ও সর্বজনবোধ্য কিন্তু বহুলাংশে কৃত্রিম।
  7. সাধুভাষা, বক্তৃতা, কথােপকথন ও সংলাপের অনুপযোগী।
  8. সাধুভাষা ব্যাকরণের নিয়ম পূর্ণাঙ্গভাবে অনুসরণ করে।
  9. সাধুভাষার পদবিন্যাস সুনিয়ন্ত্রিত ও সুনির্দিষ্ট।

প্রমিত লেখ্য বা চলিত ভাষারীতি

মানুষের মুখের কথার মার্জিত লিখিত রূপই হচ্ছে প্রমিত লেখ্য ভাষা। কলকাতা এবং ভাগীরথী তীরবর্তী অঞ্চলের জনগণের মুখের ভাষা শিক্ষিত বাঙালি সমাজ কর্তৃক গৃহীত হয়ে প্রমিত লেখ্য ভাষারীতির বিকাশ ঘটেছে।

প্যারীচাঁদ মিত্র, কালীপ্রসন্ন সিংহ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ সাহিত্যিকগণ সাধুভাষার বলয় থেকে বাংলা সাহিত্যের ভাষাকে প্রমিতকরণ করার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধেই বাংলা সাহিত্যে প্রমিত লেখ্যরীতির প্রচলন শুরু হয়। এ সময় প্রগতিশীল লেখক তৎসম শব্দবহুল সাধুভাষার গদ্যকে নিছক পণ্ডিতি গদ্য হিসেবে আখ্যায়িত করে জনসাধারণের মুখের ভাষা বা কথ্য ভাষা ব্যবহার করে গদ্য লেখা শুরু করেন। প্যারীচাদ মিত্রের 'আলালের ঘরের দুলাল -এর প্রথম প্রয়াস। তারপর কালীপ্রসন্ন সিংহের 'হুতােম প্যাচার নকশা' এ প্রয়াসকে আরও গতিশীল করে। এ দুটো রচনাতেই খাটি বাংলা কথ্য ভাষার ব্যবহার থাকায় সুধীমহলে এ ভাষা গৃহীত হয়নি। এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'চিঠিপত্র ও ডায়েরি'তে এ ভাষাকে গ্রহণ করায় সুধীমহলে সাড়া পড়ে যায়। ১৯১৪ সালে প্রমথ চৌধুরী "সবুজপত্র' পত্রিকার মাধ্যমে প্রমিত কথ্য ভাষাকে পুরােপুরি লেখ্য ভাষা হিসেবে মর্যাদার আসনে স্থান দেন। প্রমথ চৌধুরী লিখলেন,

শুধু মুখের কথাই জীবন্তু। যতদূর পারা যায়, যে ভাষায় কথা কই সে ভাষায় লিখতে পারলেই লেখা প্রাণ পায়।' তারপর থেকে ক্রমান্বয়ে প্রমিত ভাষা হয় সাহিত্য রচনার প্রধান ভাষা। বর্তমানে সাহিত্য পাঠ্যপস্তুক, সংবাদপত্র ছাড়াও সর্বক্ষেত্রে প্রমিত লেখ্য ভাষার একচেটিয়া প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়।

প্রমিত বা চলিত ভাষার বৈশিষ্ট্য

  1. চলিত ভাষা তদ্ভব, দেশি ও বিদশি শব্দবহুল।
  2. চলিত ভাষায় সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহৃত হয়।
  3. চলিত ভাষায় কতিপয় বিশেষ্য ও বিশেষণ পদেরও সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহৃত হয়।
  4. চলিত ভাষার অনুসর্গের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহৃত হয়।
  5. চলিত ভাষায় সন্ধি ও সমাসবদ্ধ শব্দগুলা ভেঙে সহজ করে ব্যবহার করা হয়।
  6. চলিত ভাষা সাবলীল, চঞ্চল ও পরিবর্তনশীল।
  7. চলিত ভাষা বক্তৃতা, কথোপকথন ও সংলাপের উপযোগী।

সাধু ও চলিত ভাষারীতির মধ্যে পার্থক্য

নং সাধুভাষা চলিত ভাষা
সাধু ভাষায় তৎসম শব্দের ব্যবহার বেশি। যেমন- পক্ষী, হস্তী, সৌষ্ঠব, কেদারা ইত্যাদি। চলিত ভাষায় তদ্ভব, দেশি, বিদেশি শব্দের ব্যবহার অধিক। যেমন : পাখি, হাতি, গঠন, চেয়ার ইত্যাদি।
সাধুভাষায় সমাজবদ্ধ শব্দ অধিক পরিমাণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন ; কাজলকালো, নববর্ষ, ভাবোদয় ইত্যাদি। চলিত ভাষায় সমাসবদ্ধ শব্দগুলােকে ভেঙে সহজ করে কিংবা তদ্ভব রূপে ব্যবহার করা হয়। যেমন: কাজলের ন্যায় কালোা, নতুন বছর, ভাবের উদয় ইত্যাদি।
সাধুভাষায় ক্রিয়াপদগুলো পূর্ণরূপে ব্যবহৃত হয়। যেমন খাইতেছিলাম, হাঁটিতেছি, করিয়াছি ইত্যাদি। চলিত ভাষায় ক্রিয়াপদগুলো সংক্ষিপ্তরূপে ব্যবহৃত হয়। যেমন ; যাচ্ছিলাম, হাঁটছি করেছি ইত্যাদি।
সাধু ভাষায় সর্বনামের পূর্ণরূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন; তাহাদিগকে, ইহাকে, কাহাকে ইত্যাদি। চলিত ভাষায় সর্বনামের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন ; তাদের, একে, কাকে ইত্যাদি।
সাধু ভাষায় অনুসর্গের পূর্ণাঙ্গ রূপ ব্যবহার করা হয়। যেমন : হইতে, অপেক্ষা, দ্বারা, নিমিত্ত। চলিত ভাষায় অনুসর্গের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহার করা হয়। যেমন ; হতে, চেয়ে, দিয়ে, জন্য ইত্যাদি।
সাধু ভাষা বক্তৃতা, কথােপকথন ও নাটকের সংলাপে অনুপযোগী চলিত ভাষা বক্তৃতা, কথােপকথন ও নাটকের সংলাপের উপযাগী।
সাধুভাষায় বহুভাষণ প্রশংসিত। চলিত ভাষায় মিতভাষণ সমাদৃত।
সাধুভাষা গুরুগম্ভীর, কৃত্রিম ও প্রাচীন নির্ভর। চলিত ভাষা চটুল, স্বাভাবিক ও যুগােপযোগী।

সাধু ও চলিত ভাষারীতির রূপান্তরের নমুনা

সাধুভাষা : মার্জারী কমলাকান্তকে চিনিত; সে যষ্টি দেখিয়া বিশেষ ভীত হওয়ার কোনো লক্ষণ প্রকাশ করিল না। কেবল আমার মুখপানে চাহিয়া হাই তুলিয়া, একটু সরিয়া বসিল। বলিল, "মেও!" প্রশ্ন বুঝিতে পারিয়া যষ্টি ত্যাগ করিয়া পুনরপি শয্যায় আসিয়া ইুঁকা লইলাম। তখন দিব্যকর্ণ প্রাপ্ত হইয়া, মার্জারের বক্তব্যসকল বুঝিতে পারিলাম।

[বিড়াল - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়]

চলিত ভাষা : মার্জারী কমলাকান্তকে চিনত; সে লাঠি দেখে বিশেষ ভীত হবার কোনো লক্ষণ প্রকাশ করল না। কেবল আমার মুখপানে চেয়ে হাই তুলে, একটু সরে বসল। বলল, "মেও!" প্রশ্ন বুঝতে পেরে লাঠি ত্যাগ করে আবার শয্যায় এসে হুঁকা নিলাম। তখন দিব্যকর্ণ প্রাপ্ত হয়ে, মার্জারের সব কথা বুঝতে পারলাম।

সাধুভাষা : আমি আর সহ্য করিতে না পারিয়া বলিলাম, "থাম! থাম মার্জারপণ্ডিতে! তােমার কথাগুলি ভারি সােশিয়ালিস্টিক! সমাজবিশৃঙ্খলার মূল! যদি যাহার যত ক্ষমতা, সে তত ধনসঞ্চয় করিতে না পায়, অথবা সঞ্চয় করিয়া চোরের জ্বালায় নির্বিঘ্নে ভোগ করিতে না পায়, তবে কেহ আর ধনসঞ্চয়ে যত্ন করিবে না। তাহাতে সমাজের ধনবৃদ্ধি হইবে না।"

[বিড়াল - বঙ্কিমচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়]

চলিত ভাষা : আমি আর সহ্য করতে না পেরে বললাম, "থাম! থাম মার্জারপণ্ডিত! তোমার কথাগুলাে খুবই সােশিয়ালিস্টিক! সমাজবিশৃঙ্খলার মূল! যদি যার যত ক্ষমতা সে তত ধনসঞ্চয় করতে না পারে, অথবা সঞ্চয় করে চোরের জ্বালায় নির্বিঘ্নে ভোগ করতে না পারে তবে কেউ আর ধনসঞ্চয়ে যত্ন করবে না । তাতে সমাজের ধনবৃদ্ধি হবে না।

সাধুভাষা : হরিশের কাছে শুনিয়াছি, মেয়েটিকে আমার ফটোগ্রাফ দেখানাে হইয়াছিল । পছন্দ করিয়াছে বৈকি। না করিবার তাে কোনো কারণ নাই। আমার মন বলে, সে ছবি তার কোনো একটি বাক্সের মধ্যে লুকানাে আছে। একলা ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া এক-একদিন নিরালা দুপুরবেলায় সে কি সেটি খুলিয়া দেখে না! যখন ঝুঁকিয়া পড়িয়া দেখে তখন ছবিটির উপরে কি তার মুখের দুই ধার দিয়া এলােচুল আসিয়া পড়ে না! হঠাৎ বাহিরে কারো পায়ের শব্দ পাইলে সে কি তাড়াতাড়ি তার সুগন্ধ আঁচলের মধ্যে ছবিটিকে লুকাইয়া ফেলে না!

[অপরিচিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

চলিত ভাষা : হরিশের কাছে শুনেছি, মেয়েটিকে আমার ফটোগ্রাফ দেখানাে হয়েছিল। পছন্দ করেছে বৈকি। না করার তো কোনো কারণ নেই। আমার মন বলে, সে ছবি তার কোনো একটি বাক্সের মধ্যে লুকানাে আছে। একলা ঘরে দরজা বন্ধ করে এক-একদিন নিরালা দুপুরবেলায় সে কি সেটি খুলে দেখে না! যখন ঝুঁকে পড়ে দেখে তখন ছবিটির উপরে কি তার মুখের দুই ধার দিয়ে এলোচুল এসে পড় না! হঠাৎ বাইরে কারো পায়ের শব্দ পেলে সে কি তাড়াতাড়ি তার সুগন্ধ আঁচলের মধ্যে ছবিটিকে লুকিয়ে ফেলে না!

সাধুভাষা : এবার সেই সুরটিকে চোখে দেখিলাম; তখনাে তাহাকে সুর বলিয়াই মনে হইল। মায়ের মুখের দিকে চাহিলাম; দেখিলাম তাঁর চোখে পলক পড়িতেছে না। মেয়েটির বয়স ষোলো কি সতেরো হইবে, কিন্তু নবযৌবন ইহার দেহে মনে কোথাও যেন একটুও ভার চাপাইয়া দেয় নাই। ইহার গতি সহজ, দীপ্তি নির্মল, সৌন্দর্যের শুচিতা অপূর্ব, ইহার কোনো জায়গায় কিছু জড়িমা নাই।

[অপরিচিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

চলিত ভাষা : এবার সেই সুরটিকে চোখে দেখলাম; তখনও তাকে সুর বলেই মনে হলো। মায়ের মুখের দিকে চাইলাম; দেখলাম তাঁর পলক পড়ছে না। মেয়েটির বয়স ষোলাে কি সতেরো হবে, কিন্তু নবযৌবন এর দেহে মনে কোথাও যেন একটুও ভার চাপিয়ে দেয়নি। এর গতি সহজ, দীপ্তি নির্মল, সৌন্দর্যের শুচিতা অপূর্ব, এর কোনো জায়গায় কিছু জড়িমা নেই।

চলিত ভাষা : আমরা পৌঁছে খবর পেলাম জাহাজ ছেড়ে চলে গেছে। এখন উপায়? কোথায় আমাদের নিয়ে যাবে? রাত একটায় আর একটা জাহাজ ছাড়বে। আমাদের নারায়ণগঞ্জ থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। ওপরওলাদের টেলিফোন করল এবং হুকুম নিল থানায় রাখতে। অমাদের পুলিশ ব্যারাকের একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো।

[বায়ান্নর দিনগুলো - শেখ মুজিবুর রহমান]

সাধু ভাষা : আমরা পৌঁছিয়াই খবর পাইলাম জাহাজ ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছে। এখন উপায়? কোথায় আমাদিগকে লইয়া যাইবে? রাত একটায় আর একটা জাহাজ ছাড়িবে। আমাদিগকে নারায়ণগঞ্জ থানায় লইয়া যাওয়া হইল। ওপরওয়ালাদের টেলিফোন করিল এবং হুকুম লইল থানাতেই রাখিতে। আমাদিগকে পুলিশ ব্যারাকের একটি ঘরে লইয়া যাওয়া হইল।

Next Post Previous Post