ফ্যাসিবাদ ও সাম্যবাদের তুলনামূলক আলোচনা।
"ফ্যাসিবাদ ও সাম্যবাদ একই রােগের দুটি উপসর্গ ।" আলােচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : সমকালীন ইতিহাসে ইতালির ফ্যাসিবাদ এবং মার্কসীয় সাম্যবাদ দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইতালির মুসোলিনি কর্তৃক ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা পায়। এ ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রশাসনের উৎপত্তির প্রধান কারণ হলাে ইতালিতে একক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা তথা ঐক্য সংহতি ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে নিজের দলকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে অন্যান্য দলকে ধ্বংস করে ফ্যাসিবাদী আদর্শকে সমগ্র সমাজে বাস্তবায়ন করা। অপরদিকে আমরা সাম্যবাদী সমাজেও প্রত্যক্ষ করি যে, সমাজের শ্রেণীহীনতা প্রণয়ন করে একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। যেখানে থাকবে না কোনো শ্রেণীর বিভেদ, থাকবে না কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি। সাম্য ও ঐক্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে সমাজব্যবস্থা, যার প্রধান, কারণ হলাে সমাজের সকল ধনতান্ত্রিক শক্তিকে ধ্বংস করে একক সাম্যবাদী ধারণা প্রতিষ্ঠা করা। যার মূলে রয়েছে একক নীতিকে প্রতিষ্ঠা করা। এজন্য এ দুটিকে একই রোগের দুটি উপসর্গ বলা হয়।
ফ্যাসিবাদ ও সাম্যবাদ একই রােগের দুটি উপসর্গ এর ব্যাখ্যা :
নিম্নে ফ্যাসিবাদ ও সাম্যবাদী দর্শনের উৎপত্তি, প্রতিষ্ঠা ও বিষয়বস্তু আলোচনার মাধ্যমে তাদের সম্পর্ক নির্ণয় পূর্বক উক্তিটির যথার্থতা প্রতিপন্ন করা হলো :
ফ্যাসিবাদী দর্শনের উৎপত্তি
আমরা ফ্যাসিবাদী দর্শনের উৎপত্তির একটি প্রধান কারণ হিসেবে পাই মুসােলিনির একক ক্ষমতা তথা একক নীতি প্রতিষ্ঠা। ১৯১৯ সালে ফ্যাসিস্ট পার্টি গঠিত হয়। এ পার্টি গঠনের পরপরই ১৯২২ সালে ফ্যাসিস্ট পার্টি ইতালির কর্তৃত্ব গ্রহণ করে। ১৯২৪ সালে মুসােলিনি ইতালির ক্ষমতা দখল করেন। এ ফ্যাসিস্ট পার্টি গঠনের একটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মুসোলিনির একক ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠা করা। একক নীতিকে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমেই ফ্যাসিবাদী আদর্শ সুস্পষ্ট হয়।
ফ্যাসিবাদী দর্শন
ফ্যাসিবাদী দর্শন একটি বাস্তবতার উপর প্রতিষ্ঠিত। যদিও এ দর্শন হেগেলের ভাববাদ দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু এখানে ভাববাদ ব্যতীত ডারউইনের বিবর্তনবাদ, ঐতিহ্যবাদ কর্পোরেটিভ রাষ্ট্র ইত্যাদি সম্প্রদায় কর্তৃক প্রভাবিত মতবাদের উপস্থিতি বিদ্যমান রয়েছে। যেমন-
ভাববাদ
আমরা মুসোলিনির দর্শনে হেগেলীয় ভাববাদী আদর্শ গ্রহণের প্রবণতা প্রত্যক্ষ করে থাকি। হেগেলীয় ভাববাদের উপর ভিত্তি করেই তিনি সর্বাত্মক নীতি প্রতিষ্ঠা করেন, যার মাধ্যমে নীতি রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি বাস্তববাদী দর্শনের নীতিকে ঘোষণা করলেও মূলত ভাববাদী আদর্শকে তিনি গ্রহণ করেন।
বিবর্তনবাদ
ফ্যাসিবাদ সমাজে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং সমাজে টিকে থাকার প্রচেষ্টা হিসেবে ডারউইনের বিবর্তনবাদী নীতিকে অনুসরণ করে। যাকে আমরা সর্বাত্মক নীতির প্রতিষ্ঠাকল্পে স্বৈরতান্ত্রিক পন্থা হিসেবে অভিহিত করতে পারি।
ঐতিহ্যবাদ
মুসােলিনিকে ঐতিহ্যবাদী নীতি অনুসরণ করতে দেখা যায়। তিনি হেগেল প্রভাবিত নব্য ঐতিহ্যবাদবকে গ্রহণ করেন এবং ফ্যাসিবাদী আদর্শকে সুস্পষ্ট আকার প্রদানের প্রতি গুরুত্বারোপ করে জাতীয়তাবাদী ঐতিহ্যকে মানুষের সামনে তুলে ধরেন এবং জাতীয়তাবাদী ঐতিহ্যের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করেই তিনি সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্র দর্শন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন।
করপােরেট রাষ্ট্র
ফ্যাসিবাদী দর্শনের অপর একটি দিক হলাে করপোরেট রাষ্ট্রব্যবস্থা। এখানে রাষ্ট্রের প্রতিটি সংস্থাকে একটি সুনির্দিষ্ট নীতির মাধ্যমে কর্পোরেটে বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ করপোরেট রাষ্ট্রে প্রতিটি প্রধান পেশার জন্য শ্রমিকদের একটি সিন্ডিকেট থাকবে এবং মালিকদের একটি সিন্ডিকেট থাকবে। এ আঞ্চলিক সিন্ডিকেটগুলোকে একত্রিত করে গঠিত হবে শ্রমিকদের কতকগুলো জাতীয় ফেডারেশন এবং মালিকদের কতকগুলো জাতীয় ফেডারেশন। জাতীয় ফেডারেশনগুলো নির্দিষ্ট কোনো শিল্পে নিয়োজিত সকল শ্রমিক ও সকল মালিকদের বৈধ প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা বলে প্রতীয়মান। প্রতিটি প্রধান প্রধান শিল্প ইউনিটের এসব জাতীয় ফেডারেশনের সমন্বয়ে গঠিত হবে কতকগুলাে জাতীয় কনফেডারেশন বা করপােরেশন।
সাম্যবাদ
সাম্যবাদী ধারণা মূলত সমাজের সকল ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে, সকল অর্থনৈতিক বৈষম্যকে, সকল স্তরের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাকে রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় পরিচালনার নীতিকে গ্রহণ করে।
সাম্যবাদী দর্শনের উৎপত্তি
আমরা সাম্যবাদী দর্শন আদিকালের অর্থনীতির চিত্রে পাই। তখন মানুষের নিজস্ব সম্পত্তি বলে কিছুই ছিল না। মানুষ ছিল পশু শিকারি। কিন্তু বর্তমানের সাম্যবাদী ধারণা আদিকাল অপেক্ষা ভিন্নতর। আধুনিক সাম্যবাদী ধারণা পাই মার্কস, এঙ্গেলস ও লেনিনের দার্শনিক চিন্তায়।
সাম্যবাদী দর্শনের বক্তব্য
সাম্যবাদ হলাে সমতাসূচক মতবাদ, যেখানে ধনী-দরিদ্র কোনাে শ্রেণীভেদ নেই। নিজস্ব সম্পদ বলে কিছুই নেই। আমরা মার্কসের দর্শনের প্রধান একটি দিক পাই সমাজে সম্পত্তির মালিকানাহীন একটি ব্যবস্থা, যার নিয়ন্ত্রণে থাকবে সরকার। এ সরকার হবেন রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্বের আধিকারী।
প্লেটোর সাম্য
আমরা সাম্যবাদী দর্শন পাই প্লেটোর দর্শনে। তিনি রাষ্ট্রের সাম্যবাদী নীতিকে গ্রহণ করার সুপারিশ করেন এবং সমাজের তিনটি শ্রেণী কাঠামাে প্রকাশ করেন । শ্রমিক শ্রেণী হলো সর্বনিম্ন শ্রেণী, সৈনিক শ্রেণী হলো মধ্য শ্রেণী এবং সর্বোচ্চ শ্রেণী হচ্ছে শাসক শ্রেণী। তিনি মনে করেন যে, শ্রমিক শ্রেণী উৎপাদন করবে, সৈনিক শ্রেণী দেশ রক্ষা এবং শাসক শ্রেণী দেশের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হবেন। এখানে নিজস্ব বলে কিছু বর্তমান নেই। শাসক শ্রেণীই ক্ষমতার শ্রেষ্ঠ আসনে। তারা দেশে সর্বেসর্বা। শাসক শ্রেণী দেশের সকল সুযােগ-সুবিধা ভােগ করবে।
মার্কসের সাম্য
মার্কসের সমকালীন সাম্যবাদেও শাসক শ্রেণীর ক্ষমতাকে সর্বেসর্বা করা হয়েছে। এখানে শ্রমিক শ্রেণী কেবল উৎপাদন করবে। এখানের সমাজ কাঠামাে সাম্যের নীতি হলেও শ্রমিক শ্রেণীর উপর শাসক শ্রেণীর ক্ষমতা সর্বাত্মক নীতির মতো। এ আধুনিক সাম্যবাদী দর্শনে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে গ্রহণ করা হয়েছে দ্বান্দ্বিক জড়বাদী দর্শন, যার প্রধান অবলম্বন সমতা। মার্কসের সাম্যবাদ শ্রেণীসংগ্রাম ও বিপ্লবকে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার উপায় হিসেবে দেখে।
ফ্যাসিবাদ ও সাম্যবাদী দর্শনের মিল
ফ্যাসিবাদ ও সাম্যবাদের মধ্যে নিম্নোক্ত মিল লক্ষ করা যায় :
- ফ্যাসিবাদ সর্বাত্মকবাদী দর্শন। এখানে শাসক হলেন দেশের সর্বাত্মাক ক্ষমতা নির্ধারণকারী ব্যক্তিত্ব। আমরা এরূপ দর্শন পাই সাম্যবাদী দর্শনে। প্লেটো তার সমতা নীতিতে শাসক শ্রেণীকে সর্বময় নিয়ন্ত্রক বলেন। মার্কস যে সাম্যবাদ দেখান তাতেও সম্পত্তির নিয়ন্ত্রক ও মালিক সরকারকে নির্ণয় করেন এবং গণতান্ত্রিক পন্থাকে অস্বীকার করেন।
- ফ্যাসিবাদ উগ্রপন্থী অর্থনীতিকে সমর্থন করে যাতে মুক্তবাজার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকে, যা আমরা সাম্যবাদী দর্শনেও প্রত্যক্ষ করে থাকি।
- আমরা ফ্যাসিবাদী আদর্শে বিবর্তনবাদী সমাজব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করি, যার প্রধান অবলম্বন হচ্ছে সমাজে বিবর্তনবাদের মতোই টিকে থাকতে হবে। যার উপস্থিতি আমরা সাম্যবাদী দর্শনে প্রত্যক্ষ করি যেখানে স্বীকার করা হয় যে, সমাজে দরিদ্র শ্রেণীকে সংগ্রামের মাধ্যমে বেঁচে থাকতে হবে।
ফ্যাসিবাদ ও সাম্যবাদী দর্শনের অমিল
ফ্যাসিবাদ ও সাম্যবাদ দর্শনের মধ্যে অমিলগুলো নিম্নরূপ :
- সাম্যবাদী দর্শন সমতাসূচক নীতির উপর বিশ্বাসী । কিন্তু ফ্যাসিবাদী আদর্শ ভবিষ্যৎ উপাদান সম্পর্কে ব্যক্ত করে।
- সাম্যবাদী দর্শন আধুনিক সমাজে অনেকটা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত সমজ। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি সাম্যতার নীতিতে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ফ্যাসিবাদী দর্শনে তা নেই।
- সাম্যবাদ সমাজকে শ্রেণীহীন করতে গিয়ে শ্রমিক শ্রেণী ও শাসক শ্রেণীর মধ্যে সম্পর্ক শ্রমিক শ্রেণীর উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, যা আমরা ফ্যাসিবাদের মূলে নিম্ন শ্রেণী ও উচ্চ শ্রেণীর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রত্যক্ষ করি। সুতরাং এদিকে তাদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, ফ্যাসিবাদী আদর্শ আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজে একটি সর্বাত্মকবাদী দর্শন। অপরদিকে আমরা সাম্যবাদী দর্শনেও সরকারের ক্ষমতাকে গণতান্ত্রিক বিরোধী ধারায় পাই। এছাড়া এ দুটি তত্ত্বের কয়েকটি পার্থক্য থাকলেও আমরা সাম্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ উভয় মতবাদেই দল গঠনের মাধ্যমে ক্রমে সমাজের সর্বক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করার প্রয়াস পাই। এ অর্থে সাম্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ সর্বাত্মকবাদী দর্শন। আর সাম্যবাদ ও ফ্যাসিবাদী শাসক রাষ্ট্রের সকল প্রেণীর উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণ করেন। সুতরাং ফ্যাসিবাদ ও সাম্যবাদ একই রোগের দুটি উপসর্গ উক্তিটি যথার্থ।