ফ্যাসিবাদের মূলনীতি ও বৈশিষ্ট্য সমূহ।
ফ্যাসিবাদের মূলনীতিগুলো ব্যাখ্য কর। অথবা, ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যেসব মতবাদের উদ্ভব হয়েছে তার মধ্যে ফ্যাসিবাদ অন্যতম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকেই জাতীয়তাবাদ মানুষের মনে এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করে, যার ফলে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার যুক্তিবাদী মতাদর্শ বিকাশ লাভ করত পারে নি। এমনকি জাতীয়তাবাদের পক্ষে মানুষের মোহাচ্ছন্নতার দরুন কখনো কখনো উগ্র জাতীয়তাবাদ যুক্তিবাদী মতাদর্শণকে প্রতিহত করেছে। আর এ কারণেই সর্বাত্মক রাষ্ট্র ব্যবস্থার পথ প্রশস্ত হয়েছে, যার অন্যতম হলো ফ্যাসিবাদ।
ফ্যাসিবাদের মূলনীতি বা বৈশিষ্ট্য
নিম্নে ফ্যাসিবাদের মূলনীতি বা বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো :
পাশবিক শক্তি প্রতিষ্ঠা : মুসোলিনির ফ্যাসিবাদের মূলকথা হলাে পাশবিক শক্তি প্রতিষ্ঠা। ভীতি প্রদর্শন, দৈহিক বলপ্রয়ােগ ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার স্বীকৃত পদ্ধতিতে পরিণত হয়েছে। এ ব্যবস্থা যুক্তির পরিবর্তে বলপ্রয়ােগকে প্রশ্রয় দেয়।
মৌলিক অধিকার অস্বীকৃত : ফ্যাসিবাদ মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয় না। স্বাধীনতার বিরােধিতাই তার নীতি। ব্যক্তির প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে জাতীয় স্বার্থবিরোধীরূপে গণ্য করা হয়। ফ্যাসিবাদে ব্যক্তিত্বকে শাসকের পদতলে বিসর্জন দেওয়া হয়।
জনগণের ক্ষমতাকে স্বীকার না করা : সভ্যজগতে সম্মতিই শাসনের স্বীকৃত নীতি। ফ্যাসিবাদ জনসাধারণের সম্মতির উপর গুরুত্বারােপ করে না। জনসাধারণের সম্মতিকে আত্মসমর্পণের সমর্থক হিসেবে গণ্য করে। ফ্যাসিবাদ জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতাকে অস্বীকার করে।
উগ্র জাতীয়তাবাদ : ফ্যাসিবাদের মূলনীতি হলাে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিকাশ সাধন। সামরিকতাবাদ, পররাজ্য গ্রাস, আক্রমণমুখী নীতি এবং কার্যকলাপকেই এই সরকার জাতির মেরুদন্ডরূপে গণ্য করে। ফ্যাসিবাদ উগ্র জাতীয়তাবাদ বিকাশে জনসাধারণকে উৎসাহিত করে।
মানবিক গুণাবলির বিকাশে বাধা : ফ্যাসিবাদের মূলকথা হলো রাষ্ট্রই সব, ব্যক্তির কোনো ভূমিকা নেই। তাই ব্যক্তির মতামতের বিকাশ এখানে উৎসাহিত নয়। এখানে জনগণের মতামতকে দমন করা হয়।
একদলীয় রাষ্ট্র : ফ্যাসিবাদের মূল উদ্দেশ্য হলো একদলীয় রাষ্ট্র কায়েম করা। এখানে সকল প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর কঠোরভাবে দমন করা হয়। একমাত্র ফ্যাসিস্ট পার্টিই জনগণের বিবেক ও বুদ্ধির অভিভাবক । এ দলের মাধ্যমে এবং নেতৃত্বেই জাতির বিকাশ এবং অগ্রগতি সম্ভব বলে মনে করা হয়।
যুক্তিহীন তত্ত্ব : ফ্যাসিবাদের মূলনীতি হলো যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে তার অবস্থান গ্রহণ। যুক্তির পরিবর্তে প্রয়ােজনীয়তাই তার প্রধান বিবেচ্য বিষয়। ফ্যাসিবাদ যুক্তিবাদ এবং যুক্তিনিষ্ঠার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এ মতবাদ মানুষকে যুক্তিহীন জীব বলে গণ্য করে। আর এ কারণেই জনগণের নিকট আবেদন সৃষ্টিকারী বিভিন্ন প্রচার কৌশল অবলম্বনের জন্য ফ্যাসিস্টগণ উদ্যোগী হন।
নেতাই সর্বেসর্বা : ফ্যাসিবাদের মূলনীতি হলো এখানে নেতাই হলো সর্বেসর্বা। ফ্যাসিবাদের নেতা মুসােলিনিই ছিলেন অতিমানব, তিনি অভ্রান্ত। তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ নৈতিক কর্তব্য।
অর্থনৈতিক নীতি : ফ্যাসিবাদ ছিল পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় বিশ্বাসী। ফ্যাসিবাদ সমাজের অথনৈতিক ও সামাজিক জীবনের উপর চূড়ান্ত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ এবং যতদূর সম্ভব অর্থনৈতিক বিষয় ব্যক্তিগত উদ্যোগের হাতে ন্যস্ত করার নীতি গ্রহণ করেছিল । ফ্যাসিবাদীগণ উংপাদনের উপকরণের জাতীয়করণে বিশ্বাসী নন। ব্যক্তিগত পুঁজির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা সম্ভব বলে তাদের বিশ্বাস ছিল।
রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য : ফ্যাসিবাদের মূলকথা হলাে রাষ্ট্রের প্রতি চরম আনুগত্য প্রকাশই ব্যক্তির মুক্তির পথ। ফ্যাসিবাদে রাষ্ট্রকে গৌরবান্বিত করা হয়। ফ্যাসিবাদ ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের বেদিমূলে বলি দেয়।
আঞ্চলিকতা ও ধর্মীয় মতান্ধতা : ফ্যাসিবাদ আঞ্চলিকতা এবং ধর্মীয় মতান্ধতায় বিশ্বাসী। এটা জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী। বিভিন্ন আঞ্চলিক গোষ্ঠী গড়ে তােলা এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি মেনে চলা ফ্যাসিবাদের মূলকথা
সামগ্রিক জনজীবনের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা : ফ্যাসিবাদের মূলকথা হলাে রাষ্ট্রের সামগ্রিক জীবনের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। ফ্যাসিবাদ আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বায়ত্তশাসনের দাবির বিরুদ্ধে। একমাত্র প্রলেতারীয় ফ্যাসিবাদ ব্যতীত সকল ফ্যাসিবাদী ধারণাই মুষ্টিমেয় শোষকের বিলাস ও অবাধ শােষণে পরিণত হয়েছে।
জনগণের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নয় : ফ্যাসিবাদের মূলনীতি হলাে জনগণের স্বাধীনতাকে পদদলিত করে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকা। গণতান্ত্রিক সরকারকে ফ্যাসিস্টগণ অবান্তর বলে বর্ণনা করেন। ফ্যাসিবাদের মতে, স্বাধীনতা কোনাে অধিকার নয়, কর্তব্যমাত্র। রাষ্ট্রের ইচ্ছার প্রতি আনুগত্য থেকেই মানুষ স্বাধীন হতে পারে। এখানে জনগণের মতপ্রকাশ, চিন্তা ও সংগঠনকে স্বীকার করা হয় না।
উদারনৈতিক মতবাদ ও মূল্যবােধের বিরােধী : ফ্যাসিবাদ গণতন্ত্রের সকল নীতি, জনগণের সার্বভৌমিকতা, সর্বজনীন ভােটাধিকার, সাম্য, মৌলিক স্বাধীনতা, জনগণের সম্মতি, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণসহ উদারতাবাদের সকল নীতি ও মূল্যবোধের বিরােধী।
রাষ্ট্র সর্বেসর্বা : ফ্যাসিবাদের মূলনীতি হলাে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক অর্থাৎ রাষ্ট্রই এখানে প্রধান। মুসােলিনি বলেন,
Hence everything for the state, nothing against the state and nothing outside the state.
এ মতবাদে রাষ্ট্র সকলের ঊর্ধ্বে। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন প্রত্যেকের কর্তব্য। ফ্যাসিবাদে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণ সহ্য করা হয় না। কারণ এখানে রাষ্ট্রের ভূমিকাই সর্বেসর্বা।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে. বিশ শতকে উদ্ভুত ফ্যাসিবাদ একটি মারাত্মক এবং ধ্বংসাত্মাক রাজনৈতিক তত্ত্ব হিসেবে পরিগণিত। গণতন্ত্র, উদারনৈতিকতা, সমাজতন্ত্র, যুক্তিনিষ্ঠাসহ সকল বিষয়ের ধ্বংস সাধনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ আদিম বর্বর জীবনের সূচনা করেছিল এবং বিদ্বেষ ও হিংসার আগুনে সভ্যতাকে বিনাশ করেছিল। সুতরাং সভ্যতার ইতিহাসে ফ্যাসিবাদ ছিল এক দুঃস্বপ্নস্বরূপ।