ইতালিতে ফ্যাসিবাদ উত্থান-পতনের কারণ।
ইতালিতে ফ্যাসিবাদ উত্থান-পতনের কারণ সমূহ বিশ্লেষণ কর।
উত্তর : ভূমিকা : প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে ইতালির বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী বেনিটো মুসােলিনির নেতৃত্বে ইতালিতে ফ্যাসিবাদ নামক প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারার বিকাশ ঘটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালি মিত্রশক্তির পক্ষে জার্মানির বিরুদ্ধে অন্ত্রধারণ করেছিল। কিন্তু বিজয়ী মিত্রশক্তির অন্যতম অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও ইতালির যু্দ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্য সফল হয় নি। উপরন্তু ইতালি যুদ্ধজনিত নানা সমস্যায় জর্জারিত হয়ে পড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতালির বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সুযােগে মুসােলিনির নেতৃত্বে ইতালিতে ফ্যাসিবাদ নামক নতুন একটি রাজনৈতিক ভাবধারার উত্থান ঘটে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির সাথে ইতালির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ইতালিতে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটে।
ইতালিতে ফ্যাসিবাদ উত্থানের কারণ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতালির অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার পরিপ্রেক্ষিতে ইতালির রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও সুসংহত করার প্রয়ােজন থেকেই সেখানে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে। ইতালিতে ফ্যাসিবাদ উত্থানের কারণগুলো নিম্নে আলােচনা করা হলো :
অন্তর্নিহিত কারণ
ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের অন্তর্নিহিত কারণ ছিল দুটি—ইতালিবাসীর 'মজ্জাগত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ' এবং তাদের 'স্বভাবগত অস্থিরতা'। প্রধানত এ কারণে তারা কোনোকালেই প্রজাতান্ত্রিক এবং পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থায় অভ্যস্ত হতে পারে নি। ক্যাভুর ও গ্যারিবল্ডির সময় থেকে ইতালির এ বৈশিষ্ট্য হিল। এখানে রাজনীতি ছিল একটা খেলার প্রতিদ্বন্দ্বিতা মাত্র। এ খেলায় কতিপয় ব্যক্তি রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করে কয়েক বছরের জন্য ইতালির উপর একনায়কত্ববাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে সক্ষম হয়েছিল।
ইতালির আশা ভঙ্গ
১৯১৫ সালে ইতালি মিত্রপক্ষের সমর্থনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির বিপক্ষ যোগদান করেছিল মূলত রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি এবং উপনিবেশ লাভের আশায়। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভার্সাই সন্ধির দ্বারা ইতালির সে আশা পুরণ হয় নি। যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষতি স্বীকার করে ইতালি মিত্রশক্তিকে সহযােগিতা করেছিল। কিন্তু যুদ্ধের অবসানে ইতালি সে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়। ইতালির এ আশা ভঙ্গ ফ্যাসিবাদ উত্থানের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল।
ইতালির গণতন্ত্রের দুর্বলতা
ক্যাভুরের নেতৃত্বে ইতালির ঐক্য সাধনের পর ক্যাভুর যে উদারনৈতিক সংবিধান প্রবর্তন করেন তা প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক ছিল না। ভােটাধিকার প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকের ভিত্তিতে স্থাপিত না করে ক্যাভুরের নির্দেশে সম্পত্তির ভিত্তিতে স্থাপন করা হয়। এর ফলে সরকার গঠনে সাধারণ লােকের কোনাে ভূমিকা না থাকায় সরকার সম্পর্কে জনসাধারণ নিঃস্পৃহ থাকে।
অর্থনৈতিক সংকট
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতালির অর্থনৈতিক সংকট দেশবাসীকে বিক্ষুদ্ধ করে তালে। উৎপাদন ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলার ফলে উৎপাদন হ্রাস পায়, দ্রব্যমূল্যের দাম প্রায় দশগুণ বৃদ্ধি পায় । সাথে সাথে অর্থনৈতিক সংকট ইতালিবাসীকে অস্থির করে তোলে।
ঐক্যবদ্ধ ইতালির সমস্যা
উত্তর ইতালি শিল্পে অগ্রসর ও মােটামুটি সচ্ছল হলেও দক্ষিণ ইতালি ছিল অনগ্রসর। উভয় অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক সমতা আনার কোনো চেষ্টা না করায় কেন্দ্রীয় সরকারের উপর দক্ষিণের আস্থা নষ্ট হয়। ফ্যাসিস্ট নেতা মুসাোলিনি ইতালির জনগণের কাছে কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যনীতি তুলে ধরেন। এছাড়া দক্ষিণ ইতালির মাফিয়াচক্র ও ডাকাত দলের উপদ্রব, ম্যালেরিয়ার প্রকোপ প্রভৃতি সমস্যার প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার তেমন কর্ণপাত করে নি। এ বৈষম্যমূলক নীতি ইতালির উদারতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটায় এবং ফ্যাসিবাদের পথ প্রশস্ত করে।
ইতালির সামরিক দুর্বলতা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালির প্রায় ৬ মিলিয়ন বা ৬০ লক্ষ সৈন্য আংশগ্রহণ করে। এরমধ্যে প্রায় ৭০ হাজার সৈন্য নিহত হয়। এ ব্যাপক ক্ষতি ইতালিকে সামরিকভাবে দূর্বল করে দিয়েছিল।
ঔপনিবেশিক প্রশ্নে ব্যর্থতা
ইতালি আফ্রিকাস্থ জার্মান উপনিবেশ ও এশিয়াস্থ তুর্কি সাম্রাজ্যের একটি অংশ লাভের আশা পােষণ করেছিল। কিন্তু মিত্রপক্ষ জার্মান উপনিবেশ ও তুরস্ক সাম্রাজ্যের অঞ্চলসমূহ নিজেদের মধ্যে ম্যান্ডেট হিসেবে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিলেও সেক্ষেত্রে ইতালির সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। মিত্রশক্তির এ বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা ইতালির জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।
পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় কূটনীতি যে ধারায় প্রবাহিত হয় বিশেষ করে বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রশ্নে নিজস্ব স্বার্থরক্ষায় ব্রিটেন, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি যে দক্ষতার পরিচয় দেয় ইতালির পক্ষে তা কোনক্রমে সম্ভব হয় নি। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে নেতৃত্বের এ ব্যর্থতা ইতালিবাসীকে ক্ষু্ব্ধ করে তোলে।
বেকারত্ব বৃদ্ধি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে যুদ্ধ প্রত্যাগত সৈনিক, কারখানার শ্রমিক, চাকরিজীবী সকলেরই উপযুক্ত কর্মের অভাব দেশের বেকার সংখ্যা বৃদ্ধি করে। বেকারদের ক্ষোভ ও অসন্তোষ ইতালিতে ফ্যাসিবাদ উত্থানের ক্ষেত্র প্রশস্ত করে।
বিরােধী দলের নেতিবাচক নীতি
ইতালির রােমান ক্যাথলিক ও সমাজতন্ত্রী দলগুলাে যারা যুদ্ধে ইতালির যোগদানের বিপক্ষে ছিল তারা শাসক উদারপন্থি দলকে অপদস্ত করার চেষ্টা করে। ইতালীয় রাজনীতির এ নেতিবাচক চরিত্র গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দেয়। রাজনৈতিক দলগুলো জাতিকে বিপদ থেকে মুক্ত করা অপেক্ষা প্রতিপক্ষের সমালােচনায় মুখর হয়ে উঠে। রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে চলার এ সুযোগে মুসোলিনির পক্ষে তার আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে যাবতীয় কলাকৌশল প্রয়ােগ করা সহজসাধ্য হয়।
উদারপন্থিদের ব্যর্থতা
ইতালির উদারপন্থি সরকার দেশের সব সমস্যা উপেক্ষা করে টিকে থাকার চেষ্টা করে। অন্যদিকে ইতালির শিল্পপতি ও বুর্জোয়া শ্রেণী উদারপন্থি সরকারের উপর আস্থা হারিয়ে একটি শক্তিশালী সরকার দ্বারা তাদের কায়েমি স্বার্থরক্ষার চিন্তা করে। মুসােলিনির নেতৃত্বে গঠিত ফ্যাসিস্ট দলই একমাত্র ইতালিকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম বলে তারা মনে করে। উদারপন্থিদের ব্যর্থতা ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থান প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
ফ্যাসিস্ট দল গঠন
মিলানের 'ফ্যাসিও' নামক সংগঠনের আদলে মুসােলিনি ১৯১৯ সালে যুদ্ধ ফেরত বেকার সেনা ও বেকার যুবকদের নিয়ে ফ্যাসিস্ট দল গঠন করেন। একসময় মুসােলিনি ছিলেন সমাজতন্ত্রী দলের সদস্য এবং আভান্ত পত্রিকার সম্পাদক। ফ্যাসিস্ট দল গঠন করে তিনি দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল ও বামপন্থী ধ্বংসাত্মক শক্তির হাত থেকে ইতালিকে রক্ষা করার কথা বলেন। তিনি তার ফ্যাসিস্ট আন্দোলনকে 'দলবিহীন জাতীয় আন্দোলন বলে দাবি করেন'। তিনি কমিউনিস্টদের তীব্র বিরােধিতা করেন। ১৯১৯ সালেই তিনি এক গােপন বৈঠকের মাধ্যমে 'ফ্যাসিস্ট সংগ্রামী বাহিনী' গড়ে তোলেন। মুসোলিনি ধর্মঘট ও কর্মবিরতির ঘোর বিরোধী হওয়ায় বুর্জোয়া শ্রেণী ফ্যাসিস্ট দলকেই ত্রাণকর্তা বলে মনে করতে শুরু করে ।
ফ্যাসিস্টদের লক্ষ্য
এর লক্ষ্য ছিল পাঁচটি। যথা-
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইতালির সম্মান পুনরুদ্ধার করা,
ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে পুনর্গঠিত করা,
অস্ত্র কারখানাসমূহকে জাতীয়করণ করা,
একটি সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক পরিষদ গঠন করা,
সমস্ত রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণ।
ক্ষমতা দখল
১৯১৯ সালে ফ্যাসিস্ট দল গঠিত হলেও মাত্র এক বছরের মধ্যে ব্যাপকভাবে এদের উত্থান ঘটে । ফ্যাসিস্টরা কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাতে ও দাঙ্গায় সফলতা দেখিয়ে বুর্জোয়াদের সমর্থন পায়। ১৯২১ সালের নির্বাচনে মুসােলিনির দল মাত্র ৩১টি আসন (মতান্তরে ৩৫টি আসন) পায়। ফলে মুসােলিনি বল প্রয়ােগের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের সিদ্ধান্ত নেন। মুসোলিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব দাবি করে বলেন যে, "ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে বলপ্রয়ােগ দ্বারা ইতিহাসের গতি নির্ধারণ হতে দেখা যায়। ইতালিতে সে সময় এসে গেছে।" মুসােলিনির ডাকে হাজার হাজার ফ্যাসিস্ট রােম অবরােধ করে। নির্বাচিত বৈধ মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে। রাজা তৃতীয় ভিক্টর ইমানুয়েল মুসােলিনিকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। রাজা ভয়ে পদত্যাগ করলে মুসােলিনি রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা হয়ে উঠেন। পার্লামেন্ট সমস্ত ক্ষমতা তার হাতে ছেড়ে দেয়।
ফ্যাসিস্ট দলের পতন
রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা দখল করে মুসােলিনি সরকারি প্রশাসন ও অন্যান্য সর্বদপ্তরে 'ফ্যাসিকরণ নীতি' চালু করেন। সমাজতন্ত্রী দলকে চূর্ণ, ফ্যাসিস্ট ঝটিকা বাহিনী দ্বারা ফ্যাসিবাদ বিরোধী সমালােচকদের উপর অত্যাচার, গণতান্ত্রিক চেতনা বিরোধী কর্মকান্ড, সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্টনীতি গ্রহণ প্রভৃতির প্রেক্ষাপটে ইতালিতে মুসাোলিনি ও ফ্যাসিবাদের পতন ঘটে। ১৯৪১ সালে মুসালিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে জার্মানির পক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, যোগদান করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জার্মানির পরাজয় ও ১৯৪৫ সালে মিত্রশক্তি কর্তৃক ইতালি আক্রমণের মধ্য দিয়ে মুসোলিনি ও ফ্যাসিবাদের পতন ত্বরান্বিত হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ইতালির এক সংকটজনক পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে। ইতালির ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে পুনর্গঠন ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইতালির সম্মান বৃদ্ধির প্রয়াস নিলেও ফ্যাসিবাদীরা ইতালিতে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা কায়েম করে। উপরন্তু সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে ফ্যাসিস্ট মুসােলিনি ইতালিতে বৈদেশিক আক্রমণের ক্ষেত্র প্রশস্ত করেন। ফলে জনগণ তার প্রতি বিক্ষুন্ধ হয়ে তাকে হত্যা করে। মুসালিনির হত্যার মধ্য দিয়ে ইতালিতে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটে।