প্রাচীন বাংলার ইতিহাস

প্রাচীন বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনের উপাদান সমূহ কি?

তথ্যের স্বল্পতার কারণে মুসলিম-পূর্ব যুগের বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠন দুরূহ। এ অসুবিধা বেশি অনুভূত হয় প্রাচীনকালের ইতিহাস রচনায়। অর্থাৎ প্রাচীনতম কাল থেকে খ্রিষ্ঠীয় চার শতকে বাংলার গুপ্ত শাসন প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত। এ যুগের ইতিহাসের উপাদানের জন্য আমাদের নির্ভর করতে হয় বৈদিক, মহাকাব্যিক ও পৌরাণিক সাতিত্যের অপ্রতুল তথ্য এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদির ওপর। গুপ্তযুগ থেকে পরবর্তী সময়ে আমরা লিপি ও সাহিত্যাকারে লিখিত তথ্য পাই। এসব লিপি ও সাহিত্য-কর্মে রয়েছে বাংলা অঞ্চলের ইতিহাসের উপাদান।

সর্বপ্রাচীন যুগে বাংলায় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল বলে জানা যায়। যে অঞ্চলে যে জনগােষ্ঠী বাস করতাে সে অঞ্চলের সঙ্গে সেই বিশেষ জনগোষ্ঠীর নাম সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। এভাবে বঙ্গ, পুন্ড্র, রাঢ় ও গৌড় নামক প্রাচীন জনপদ সমূহ এ সব নামের অনার্য জনগোষ্ঠীর দ্বারা অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত হয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে মেঘনার ওপারে সমতট (কুমিল্লা-নোয়াখালী অঞ্চল) ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। এ জনপদের নাম পুরোপুরি বর্ণননাত্মক এবং জনগােষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা বর্জিত। চট্টগ্রাম ও তৎসন্নিহিত অঞ্চল হরিকেল নামে পরিচিত ছিল । পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য থেকে অনার্য জনগােষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে এ সকল জনপদের কথা জানা যায় ।

খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মধ্যভাগে প্রাচীন ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আর্য-প্রভাব অনুভূত হয়। উপমহাদেশের পূর্বপ্রান্তে পৌঁছাতে আর্যদের আরও বেশি সময় লাগে। তাই বাংলার অধিবাসীগণ আর্যায়নের স্রোতধারা বেশ দেরিতেই উপলব্ধি করে। খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ শতক থেকে পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে বাংলায় আর্যদের অনুপ্রবেশ ঘটে এবং সমগ্র বাংলাকে আর্যায়িত করতে তাদের প্রায় এক হাজার বছর লেগে যায়। উত্তর ভারতে এ দীর্ঘ যাত্রাকালে আর্য-প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই অনেকটাৎক্ষীণ হয়ে পড়েছিল। ততদিনে বাংলার অধিবাসীদের সংস্কৃতিতে অনার্য উপাদান দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় পায় এবং আর্য-প্রভাব সত্ত্বেও আর্য-পূর্ব জীবন বৈশিষ্ট্যের অনেক উপাদানই বজায় থাকে।

পাথরের তৈরি যন্ত্রপাতি ও হাতিয়ারই হচ্ছে মানব বসতির সর্বপ্রাচীন নিদর্শন । পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও বর্ধমান জেলায় প্রাগৈতিহাসিক যুগের পাথরের তৈরি যন্ত্রপাতি ও হাতিয়ার আবিষ্কৃত হয়েছে। এ হাতিয়ার ব্যবহারকারী জনগােষ্ঠী কখন প্রথম বাংলায় বসতি স্থাপন করেছিল তা যথার্থভাবে, এমনকি অনুমানেও নির্ধারণ করা কঠিন। এটা সম্ভবত ঘটেছিল দশ হাজার বছর (বা তারও) আগে। নিষাদ বা অস্ট্রিক কিংবা অস্ট্রো-এশীয় গোষ্ঠীর অনার্য লোকেরাই এতদঞ্চলের আদি বাসিন্দা। আজকের কোল, ভিল, সাঁওতাল, শবর, পুলিন্দ প্রভৃতি আদিম অধিবাসীরা তাদের প্রতিনিধিত্ব করছে । পরবর্তীকালে দ্রাবিড় ও তিব্বতি-বর্মি ভাষাভাষী আরও দুটি জাতি বাংলায় বসতি স্থাপন করে।

১৯৬০-এর দশকের প্রত্নতাত্ত্বিক আবিস্কার থেকে প্রমাণিত হয় যে, বাংলার কোথাও কোথাও খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের শুরুতে, সম্ভবত তারও আগে, অপেক্ষাকৃত অনেক উন্নত এক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। অজয় নদের উপত্যকায় বর্ধমান জেলার পাণ্ডু রাজার ঢিবি (বোলপুরের সন্নিকটে) এবং অজয়, কুনার ও কোপাই নদীর তীরবর্তী অন্যান্য প্রত্ন এলাকায় গ্রাপ্ত নিদর্শনাদি বাংলার প্রাগৈতিহাসিক যুগ সম্পর্কে নতুন ধারণার জন্ম দিয়েছে ।

পাণ্ড রাজার ঢিবি একটি বাণিজ্যিক শহরের ধ্বংসাবশেষ । ভারতের অভ্যন্তরীণ অঞ্চলের সঙ্গে শুধু নয়, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহের সঙ্গেও এর বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। বৈদিক সাহিত্য থেকে সুস্পষ্টভাবে জানা যায় যে, আর্যরা বাংলার আদি অধিবাসীদের বর্বর মনে করতো । কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে যে উন্নত বস্তুগত সংস্কৃতির সন্ধান পাওয়া গেছে তা নিঃসন্দেহে আর্য-মনােভাবের অসারতা প্রমাণ করে। অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে আর্য-বসতি স্থাপন গতীরভাবে ব্যংলার সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে। ক্রমান্বয়ে আর্যায়ন প্রক্রিয়া এতদঞ্চলের পরবর্তী ইতিহাসের মূল প্রতিপাদ্য। খ্রিষ্ঠীয় চার শতক থেকে বাংলার ইতিহাস আমাদের নিকট মোটামুটি স্পষ্টভাবেই প্রতিভাত হয় । রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই এ ইতিহাস আর্য-প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার ইতিহাস।

গ্রীক ও ল্যাটিন উৎস থেকে (খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টীয় ১ম শতাব্দী) গঙ্গারিডাই (ল্যাটিন) নামক পূর্ব ভারতের একটি শক্তিশালী রাজ্যের কথা জানা যায়। এ রাজ্য সামরিক দিক থেকে খুবই শক্তিশালী ছিল। পণ্ডিতগণ বাংলার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে গঙ্গার (ভাগীরথী ও পদ্মা) মােহনার কাছে গঙ্গারিডাই-র অবস্থান নির্দেশ করেন।

বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়-এর ধ্বংসাবশেষ প্রাচীন পণ্ড্রনগর হিসেবে চিহ্নিত । খনন কাজের ফলে এখানে ব্রাহ্মী হরফে লেখা একটি খোদিত লিপি পাওয়া গেছে। এ লিপি বাংলার অংশ বিশেষের ওপর মৌর্য শাসনের (খ্রিষ্টপূর্ব তিন শতক) প্রমাণ বহন করে। বাংলায় প্রাপ্ত প্রাচীনতম এ লিপি দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, পুণ্ড্রনগর বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ের সাথে অভিন্ন। বাংলার প্রাচীনতম নগরজীবনের নিদর্শন হচ্ছে এ পুণ্ড্রনগর । প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে প্রাচীনকাল থেকে খ্রিষ্টীয় বার শতক পর্যন্ত এ শহরটির অস্তিত্ব ছিল।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে (খ্রিষ্টপূর্ব তিন শতক)উল্লেখ আছে যে, বঙ্গের (দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা) মিহি সূতিবস্ত্র গুরুত্বপূর্ণ পণ্য হিসেবে সারা ভারতে রপ্তানি হতো। গ্রীক ও ল্যাটিন লেখকগণও (মােটামুটি একই সময়ের) এর উল্লেখ করেছেন । সুতরাং একথা জোর দিয়েই বলা যায় যে, বাংলায় মিহি বস্ত্র তৈরির ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার এ পণ্যটিই ষোড়শ ও সতের শতকে বাংলার মসলিন এবং আরও সুনির্দিষ্ট করে ঢাকাই মসলিন হিসেবে বিশ্বজোড়া খ্যাতিলাভ করে । এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ্য যে, পাোড়ামাটির ফলক তৈরিও বাংলার একটি প্রাচীন শৈল্পিক ঐতিহ্য । খনন কাজের ফলে পাণ্ডু রাজার ডিবিতে প্রাপ্ত পােড়ামাটির ফলকসমূহ বাংলার এ শিল্পের প্রাচীনত্বের প্রমাণ দেয়।

Next Post Previous Post