বাংলা সম্পর্কে চীনা পরিব্রাজক মা-হুয়ানের বিবরণ।
মা-হুয়ানের বিবরণের আলোকে বাংলার আর্থ-সামাজিক ও বাণিজ্যিক অবস্থার বিবরণ দাও।
অতি প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্য পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের মানুষকে কাছে টেনে এনেছে। এদের কেউ আসেন ব্যবসা বাণিজ্য করার জন্য আবার কেউ আসেন দূত পর্যটক হিসেবে। চৈনিক পরিব্রাজক মা-হুয়ান পর্যটক হিসেবে বাংলায় আসেন ১৪০৫-০৬ সালের দিকে। ফার্সি ভাষা জানা থাকায় তিনি খুব সহজেই এদেশের জনসাধারণের সাথে মিশে যেতে সক্ষম হয়। তিনি তার ভ্রমণ বিষয়ক "Ying Yai Shang Lan" নামক গ্রন্থে তৎকালীন বাংলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরে একটি বহু মূল্যবান ও তথ্যসমৃদ্ধ বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন।
বাংলায় মা-হুয়ানের আগমন
সুলতান গিয়াস উদ্দিন আযম শাহ বাংলার সাথে চীনের সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য দূত বিনিময় করেন। চীনা সম্রাট ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রসিদ্ধ পীঠস্থান এবং এখানকার অবস্থা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান আহরণের জন্য দূত প্রেরণ করতেন। গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের আমলে আনুমানিক ১৪০৫ সালে চীনা সম্রাট য়ুংলো চেংহো নামক ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি মিশন প্রেরণ করেন। চৈনিক পরিব্রাজক মা-হুয়ান এই দলটির সাথে এসেছিলেন দো-ভাষীরূপে । আরবী ও ফারসি ভাষা জানা থাকায় মা-হুয়ান এদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হন। বাংলা সম্পর্কে আহরিত জ্ঞান মা-হুয়ান তার "Ying Yai Shang Lan" নামক গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন। এই গ্রন্থের অনুবাদ করেন জর্জ ফিলিপ।(এই থেকে জানা যায় যে চেংহোর দল প্রথমে সুমাত্রা দ্বীপ হয়ে সাওশান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছেন । সেখান থেকে জাহাজকে উত্তর-পশ্চিম দিকে ঘুরিয়ে ২১ দিন পর চট্টগ্রামে পৌঁছে। এরপর ছোট নৌকা ব্যবহার করে ৫০০ লি নৌপথ পাড়ি দিয়ে সোনারগাঁও পৌঁছে। দক্ষিণ-পশ্চিমে ৩৫ টি পর্ব (stage) পাড়ি দিয়ে অবশেষে ১৯০৬ সালে তারা বাংলার রাজধানী গৌড়ে পৌঁছে।
দেশটি বিশাল ও ঘনবসতিপূর্ণ। ধন-সম্পত্তি এখানে প্রচুর। সুমাত্রা দ্বীপ থেকে যাত্রা করে নিকোবর দ্বীপ দেখা যায়। সেখান থেকে উত্তর-পশ্চিমে আরও কুড়ি দিন যাবার পর চাটিগাঁও (Che-ti-King) পৌছানো যায়। এখানে ছােট নৌকা নিতে হয়, আর এই নৌকা করে ৫০০ লির (২৫০ কিলোমিটার) কিছু বেশি দূরে সোনারগাঁও। (So-na-eal-King) হয়ে রাজধানী যেতে হয়। রাজধানী প্রাচীরে ঘেরা, তবে বাইরে শহরতলিও আছে। রাজার প্রাসাদ ও ছােট-বড় ওমরাহদের বাড়ি আর মন্দিরগুলো শহরের মধ্যে। এরা সবাই মুসলমান।
বাংলার নারী-পুরুষ সম্পর্ক :
এদেশের লোকদের চালচলন শুদ্ধ আর সৎ। মেয়ে- পুরুষ সবারই গায়ের রং কালাে; এদেশে শ্বেত বর্ণের লোক প্রায় নেই। সবাই চুল বেঁধে (বা কেটে) রাখে আর সাদা সুতি পাগড়ি পরে। গায়ে লম্বা গাউনের মতো পোশাক পরে। এই পোশাকের কলার গােল, আর এগুলো এমব্রয়ডারি করা পটি দিয় বাঁধা। পায়ে এরা চামড়ার চটি পরে।
বাংলার কর্মচারী ও ভাষা সম্পর্কে :
রাজা আর উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা মুসলমানি টুপি ও পােশাক পরেন। এঁরা খুব পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। সকলেরই ভাষা বাঙলা। ফার্সি বলেন এমন লােকও আছেন। সরকারি ভাষা ফার্সি।
বাংলার টাকা সম্পর্কে :
কেনাবেচায় এরা রূপার মুদ্রা ব্যবহার করে। এই মুদ্রার টংকা (Tangke) । এর ওজন ৩ ক্যান্ডারিন (candareen) ।এগুলোর ব্যাস তিন সেন্টিমিটার। মুদ্রার দুদিকেই লেখা থাকে। এগুলো দিয়ে এরা জিনিসের ওজন অনুসারে দাম ঠিক করে। এদের একরকম সামুদ্রিক ঝিনুকও আছে। তার নাম কড়ি।
আবহাওয়া :
আবহাওয়া সারা বছরই গ্রীষ্মকালের মতো গরম। এদেশে শাস্তি হলাে মােটা বাঁশ দিয়ে প্রহার, কিংবা নির্বাসন ।
বাংলার সৈন্যবাহিনী সম্পর্কে :
রাজকর্মচারীদের নিজস্ব সিল থাকে, আর একে অন্যকে এরা চিঠিপত্রে লিখে যোগাযোগ করে। সৈন্যদের মাহিনা ও রেশন দুইই দেয়া হয়। সৈন্যদলের অধ্যক্ষের নাম সিপাহসালার।
বাংলার মানুষদের জীবন-যাপন সম্পর্কে-:
এদেশে জ্যোতিষী, চিকিৎসক, দৈবজ্ঞ ও সমস্ত রকমের কুশল ও সুদক্ষ কারিগর আছে। কিছু লোক একরকম সাদা কালাে প্যাটার্ন দেয়া জামা পরে, স্কার্ফ (Scarf) দিয়ে বাঁধা। তাতে প্রবাল আর স্কটিকের পাড় বসান। কবজিতে এরা পুঁতির ব্রেসলেট পরে। ভােরের সময় আনন্দ দেয়ার জন্য ভালাে গাইয়ে আর নাচিয়েও আছে। একরকম মনোরঞ্জনকারী আছে যারা প্রতিদিনই ঠিক পাঁচটার সময় উচ্চপদস্থ কর্মচারী আর বড়লোকদের দরজার সামনে জড়াে হয়ে সানাই আর ঢােলক বাজায়, আর এমনিভাবে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। প্রাতঃরাশের সময় তারা বাড়ির ভেতর যায়, আর তখন তাদের মদ, খাবার আর টাকা দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। অনেক রকম কীড়া কৌশলাদি দেখায় সে রকম লোকও আছে।
বাংলার মাস :
বারো মাসে এদের এক বছর হয়, আর কোনো মূল মাস নেই।
বাংলার শস্য :
দেশি শস্য হলো, লাল জোয়ার, তিল, ডাল, আঠালাে জোয়ার (Glutinous millet) আর ধান। ধান বছরে দু'বার হয়। শাক-সবজির মধ্য আছে, আদা, সরষে, পেয়াজ, রসুন, শসা আর বেগুন । এরা নারকেল আর অন্য একটি গাছের ফল থেকে এক রকম আরক বানায়। তাছাড়া কাজং মদও বানায়। কাজং মদ ইন্দোনেশিয়াতে বহু প্রচলিত ছিল, তাবে বাঙালা বা আসামে এই মদের প্রচলনের কথা জানা নেই।এঁরা আমাদের মতো চা খাই না তার জাগায় এরা সুপারি খায়।
বাংলার পশু :
গৃহপালিত জন্তু,উট,খচ্চর,মহিষ,গরু,ছাগল (marine goat) মুরগি,পাতিহাস, শুয়োর, বড় হাস, কুকুর আর বেড়াল। এদের ফল হলো-কলা, কাঁঠাল, টক বেদানা, আখ, চিনি আর মধু।
বাংলার কাপড় সম্পর্কে :
বাংলায় আগত চীনা দূতগণ বিভিন্ন ধরনের মসলিনের বিবরণ দিয়েছেন । যেমন-
পি-পাে : অতি সূক্ষ্ম ও বিভিন্ন রঙের মিহিন ও উজ্জ্বল বস্ত্র, এর প্রস্থ ছিল ২ থেকে
৩ ফুট এবং দৈর্ঘ্য ছিল ৫৬ ইঞ্চি।
মান-চে-তি : ঠাসা বুনানো এবং হলদে রঙের; এর প্রস্থ ৪ ফুট ও দৈর্ঘ্য ৫০ ফুট ছিল ।
শেঙ্গ-না কিয়েহ (শাহ-না-পা-ফু) :৫ ফুট প্রস্থ ও ২০ ফুট দৈর্ঘ্যর বস্ত্র, চীনা লো-পু
(শিঙ্গ-লো) সঙ্গে এর সাদৃশ্য ছিল।
হিউ-পেই-তুঙ্গ-তা-লি (কেউ-পেই-লেই-তা-লি) : তিন ফুট প্রস্থের ও ৬০ ফুট দৈর্ঘ্যের মোটা কাপড় ।
শা-তা-ইউল : এটা ছিল দু'ধরনের। এর একটি ছিল প্রস্থে ৫ ইঞ্চি ও দৈর্ঘ্যে ৪০
ফুট এবং অন্যটি ছিল প্রস্থে ২-১/২ ফুট এবং দৈর্ঘ্যে ৪ ফুট; চীনা সান-সো-এর
সঙ্গে সাদৃশ্য।
মা-হেই-মা-লাই : এটা ছিল ৪ ফুট প্রস্থ ও ২০ ফুট বা ততাধিক দৈর্ঘ্যের মলমল কাপড় ; এর এক পার্শ্ব অর্ধ ইঞ্চি লম্বা আশঁ দিয়ে আবৃত ছীল; এবং এটা অনেকটা চীনা টু-লো-কিয়েহ-এর মতো ।
বাংলার কাগজ ও ঘরােয়া জিনিসপত্র :
এদের কাগজ সাদা, এগুলো এক রকম গাছের ছাল দিয়ে তৈরি,আর হরিণের চামড়ার মতো মসৃন আর চকচকে। ঘরােয়া জিনিসপত্রের মধ্যে আছে গলার কাজ করা ছোট ও বড় বাটি, ইস্পাতের বন্দুক (Steel guns) আর কাঁচি।