দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা অবসানের কারণ

লর্ড ক্লাইভ কর্তৃক প্রবর্তিত দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা অবসানের কারণ কি ছিল আলোচনা কর।

যে সকল কারণ ও ঘটনাপ্রবাহ দ্বৈতশাসন ব্যবস্থার অবসান কে ত্বরান্বিত করেছিল সেগুলো সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. কোম্পানির দায়িত্বহীন ক্ষমতা :

১৭৬৫ থেকে ১৭৭২ সাল পর্যন্ত আপাতদৃষ্টিতে বাংলার ক্রীড়নক নবাবের শাসন ক্ষমতা বাজায় রাখা হলেও সার্বভৌম ক্ষমতা কোম্পানির হাতেই নিবদ্ধ থাকে। দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ছিল নবাবের কিন্তু অর্থ ও সেনা ভিন্ন এই দায়িত্ব নিজামতের পক্ষ পালন করা সম্ভব ছিল না এবং এ জন্য তাকে কোম্পানির উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল করে রাখা হয়। শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে নবাবকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও ক্ষমতা দেওয়া হয় নি। অন্যদিকে কোম্পানি লাভ করে দায়িত্বহীন ক্ষমতা। এভাবে কোম্পানির দায়িত্বহীন ক্ষমতার ফলে কোম্পানির রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি হলেও প্রশাসনিক জটিলতা বৃদ্ধি পায় যা দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা অবসানকে ত্বরান্বিত করে।

২. কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা ও অত্যাচার :

কোম্পানির কর্মচারী ও গোমস্তাদের লুন্ঠন নীতির ফলে জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থা শােচনীয় হয়ে পড়ে। এ সম্পর্কে রেজা খান কলকাতার সিলেক্ট কমিটিকে জানান যে, কোম্পানির কর্মচারী ও গােমস্তারা বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উপর একচেটিয়া ব্যবসা স্থাপন করেছে, তারা জোরপূর্বক স্বল্পমূল্যে দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করে অধিক মূল্যে বিক্রয় করে, রায়তদেরকে তারা নানাবিধ দ্রব্যাদি সরবরাহ করতে বাধ্য করে, প্রথানুসারে শুল্ক দিতে অস্বীকার করে, দেশীয় ব্যবসায়ীদেরকে উৎপীড়ন করে। এমতাবস্থায় কোম্পানির কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় কোম্পানির কর্মচারী গােমস্তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য ও অত্যাচারের কারণে দেশের ও কোম্পানির অর্থনৈতিক অবস্থা ধীরে ধীরে নাজুক হয়ে পড়ে।


৩. রাজস্ব নীতি সম্পর্কে অজ্ঞাতা :

বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব কোম্পানির উপর অর্পিত হওয়ায় রাতারাতি কোম্পানির ফ্যাক্টর ও বণিকরা প্রশাসকে পরিণত হয়। এসব নতুন প্রশাসকের এদেশীয় রাজস্ব নীতি সম্পর্কে কোনো ধ্যানধারণা ছিল না বললেই চলে। তারা ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধ্যানধারণা এদেশের ক্ষেত্রে প্রয়াগ করে এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যার অবসান ঘটাতে কোম্পানির কর্তৃপক্ষকে দ্বৈতশাসন রহিত করতে হয়।

৫. রাজস্বের হার ক্রমাগত বৃদ্ধি :

পলাশির পর থেকে দেশীয় রাজনীতি ও অর্থনীতিতে কোম্পানির হস্তক্ষেপের ফলে দেশের সম্পদ হ্রাস পেতে থাকে। কিন্তু রাজস্বের হার প্রত্যক বছর বৃদ্ধি পেতে থাকে। যেমন- ১৭৬৯ সালে রেজা খান অভিযোগ করেন যে, আলীবর্দী খার আমলে পুর্ণিয়া জেলার বাৎসরিক রাজস্ব যেখানে মাত্র ৪ লাখ টাকা ছিল সেখানে তা বৃদ্ধি পয়ে ১৭৬৯ সালেই ২৫ লাখ টাকায় উন্নীত হয়। আবার দিনাজপুর জেলার রাজস্ব আদায় ১২ লক্ষ টাকা হতে বৃদ্ধি পেয়ে ১৭ লক্ষ টাকায় উন্নীত হয়। এভাবে প্রত্যেক বছর রাজস্বের হার বৃদ্ধির ফলে রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষেত্রে চরম অসুবিধার সৃষ্টি হয়।


৬. রাজস্ব আদায়ে কঠোরতা :

রাজস্বের হার বৃদ্ধির সাথে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে জনগণের উপর কঠোরতা নেমে আসে। কোম্পানির কর্মচারী ও আমিলদের অত্যাচারে অসংখ্য রায়ত রাজস্ব পরিশোধ করতে না পরে জায়গা-জমি পরিত্যাগ করে অন্যত্র পলায়ন করতে বাধ্য হয়। আবার অনেকে পেশা পরিবর্তন করে। এমনকি দুর্ভিক্ষের সময় যেখানে বাংলার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক মারা যায় সেই সময়ও রাজস্ব আদায়ের কঠোরতা ও রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ প্রায় অপরিবর্তিত থাকে। ১৭৬৫-৭০ সালে গড়ে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল ১,৩৬,৯৯,৫৩৮ টাকা। এ থেকে কোম্পানির কর্মচারীদের ঘৃণ্য, অমানবিক ও বর্বরোচিত মনোবৃত্তির পরিচয় পাওয়া যায়। এর ফলে জনমনে চরম অসন্তোষ ঘনীভূত হয়ে উঠে।


৭. কোম্পানির কর্মচারীদের দুর্নীতি :

দ্বৈত শাসনব্যবস্থার সুবাদে কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোম্পানির অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় করে। ফলে বাংলার রাজনৈতিক,প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক অবস্থায় এক নিদারুণ বিপর্যয় নেমে আসে। এমতাবস্থায় কোম্পানির ইংল্যান্ডস্থ কর্তৃপক্ষর নিকট কোম্পানির কর্মচারীরা অর্থ সাহায্য প্রার্থনা করলে কোম্পানি বাহাদুরের টনক নড়ে। ফলে তদন্তসাপেক্ষে কোম্পানির কর্মচারীদের দুর্নীতি, কুশাসন এবং এতদজনিত জনগণের মনে চরম অসন্তোষ লক্ষ করে দ্বৈত শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটানোর প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

পরিশেষে বলা যায় যে, দ্বৈতশাসন ছিল লর্ড ক্লাইভ প্রবর্তিত একটি কুশাসন ব্যবস্থা। এর জাঁতাকলে পড়ে যখন বাংলার জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্থা চরমে উঠে এবং কোম্পানির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দেয় তখন কোম্পানির ডাইরেক্টর সভার নির্দেশ অনুসারে নবনিযুক্ত গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭২ সালে দ্বৈতশাসনের অবসান ঘটান। এর ফলে কোম্পানির শাসনব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি সুযােগ সৃষ্টি হয়।

Next Post Previous Post