সমাজবিজ্ঞানের পরিধি বা বিষয়বস্তু বা আলোচ্য বিষয়

সমাজবিজ্ঞানের পরিধি বা বিষয়বস্তু বা আলোচ্য বিষয় আলোচনা কর।

পৃথিবীতে মানব সভ্যতার ইতিহাস প্রাচীনকালের হলেও সামাজিক বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের ইতিহাস খুব বেশিদিনের নয় । অথচ এই অল্প সময়েই বিভিন্ন তাত্ত্বিক ও মনীষী সমাজবিজ্ঞানের আলোচনাকে করেছেন পরিপুষ্ট ও প্রাণবন্ত । তাদের সুদক্ষ কলমের আঁচড়ে সমাজবিজ্ঞান হয়েছে সমৃদ্ধ ।

সমাজবিজ্ঞানের পরিধি বা বিষয়বস্তু বা আলোচ্য বিষয় :

মানুষের জীবন ব্যবস্থা দিনদিন পরিবর্তিত হচ্ছে বলে সমাজবিজ্ঞানের পরিধি বা পরিসর ক্রমশ ব্যাপক থেকে ব্যাপক হচ্ছে । নিম্নে সমাজবিজ্ঞানের পরিধি বা বিষয়বস্তু বা আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হল :

সমাজতান্ত্রিক মতবাদ

মানুষের সমাজ ব্যবস্থা মূলত পদ, প্রত্যয় নীতি এবং সাধারণীকরণের উপর প্রতিষ্ঠিত । সমাজবিজ্ঞান এসব বিষয়ের সারগর্ভ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে । এজন্য সমাজবিজ্ঞানকে সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বিজ্ঞান হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ।

সমাজব্যবস্থার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ

বর্তমানে আমরা যে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করছি, তা একদিনে কিংবা হঠাৎ করে গড়ে ওঠেনি । এর পিছনে রয়েছে যুগ-যুগান্তরের বিবর্তন, পরিবর্তন ও ক্রমবিকাশ । সমাজবিজ্ঞান এসব বিবর্তন ,পরিবর্তন ও ক্রমবিকাশের বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে ।

পরিবার সমাজতত্ত্ব

সমাজবিজ্ঞান পরিবারের উৎপত্তি, বিকাশ,প্রকরণ, কার্যাবলী ও সমস্যা সম্পর্কে বাস্তবধর্মী বিচার-বিশ্লেষণ করে ।ফলে ক্ষেত্রবিশেষে সমাজবিজ্ঞানকে একটি পারিবারিক বিজ্ঞান হিসেবে দৃষ্ট হয় ।

সামাজিক জনবিজ্ঞান

সুষ্ঠু সমাজ বিনির্মাণে সমাজবিজ্ঞান সমাজের জনসংখ্যা তত্ত্ব, জনসংখ্যা কাঠামো, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বন্টন এবং এর সামাজিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করে । এমনকি এ সংক্রান্ত করণীয় নির্ধারণ করে । এজন্য সমাজবিজ্ঞানকে সামাজিক জনবিজ্ঞান হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ।

রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব

সমাজের মানুষের সার্বিক কল্যাণেই যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আবর্তিত হয় । তাই প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলনের সামাজিক পটভূমি, উপযোগিতা,রাজনৈতিক আদর্শ সমূহের উদ্ভব এবং বিকাশ, সরকার এবং রাষ্ট্রের গঠন ও কার্যাবলী সমাজবিজ্ঞান পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনা করে ।

সাংস্কৃতিক সমাজতত্ত্ব

প্রতিটি সমাজের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে রয়েছে । সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কোনোটি বস্তুগত আবার কোনোটি অবস্তুগত । তবে বস্তুগত ও অবস্তুগত যা-ই হোক না কেন এসব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উদ্ভব, বিকাশ এবং সমাজ জীবনে এগুলোর প্রভাব ইত্যাদি বিষয় সমাজবিজ্ঞান যুক্তিক বিশ্লেষণ করে ।

শিল্প সমাজতত্ত্ব

উনিশ শতকের মধ্যভাগে শিল্প বিপ্লবের ফলে সমাজ কাঠামোর শ্রমিক শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে । সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সমাজবিজ্ঞান শ্রমিকের সামাজিক পটভূমি, শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক উন্নয়ন, ব্যবস্থাপক তথা শিল্প-কারখানার সম্পর্ক, ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রমিকের সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিতকরণ, শ্রমিক আন্দোলন এবং এর সামাজিক প্রভাব ইত্যাদি বিষয়ে পঠন-পাঠন এবং গবেষণা করে ।

চিকিৎসা সমাজতত্ত্ব

চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার গুলোর একটি। সমাজবিজ্ঞান রোগীর সামাজিক পটভূমি, রোগ ও চিকিৎসা সম্পর্কিত সমাজের মানুষের প্রচলিত বিশ্বাস, চিকিৎসা পদ্ধতির সামাজিক দিক, রোগ মুক্তির পর রোগীর সামাজিক পুনর্বাসন ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য নির্ভর আলোচনা করে । এতে সমাজের মানুষ চিকিৎসার ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠে ।

শিক্ষা সমাজতত্ত্ব

শিক্ষা মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশের নিশ্চয়তা বিধান করা । সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষা সমাজতত্ত্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, শিক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষা অর্জনের গুরুত্ব ও বাধ্যবাধকতা সর্বোপরি অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথে এর সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে সারগর্ভ আলোচনা করে ।

ধর্মীয় সমাজতত্ত্ব

ধর্ম মানুষের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা । এর আচার-অনুষ্ঠান, বিশ্বাস ও প্রথা মানুষকে সুশৃংখল জীবনযাপন উদ্বুদ্ধ করে, যা সুষ্ঠু সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক হয় । এজন্য সমাজবিজ্ঞান মানুষের ধর্ম ও এর বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান সম্পর্কে বিশদ আলোচনায় ব্যাপৃত থাকে।

সামাজিক মনোবিজ্ঞান

সমাজবিজ্ঞান ব্যক্তির সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া অর্থাৎ একজন মানুষ কিভাবে সমাজের সদস্য হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে সে সম্বন্ধে দিকনির্দেশনা প্রদান করে । আর তা করতে গিয়ে সমাজবিজ্ঞান মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিভিন্ন বিষয়ে গবেষনায় ব্যাপৃত থাকে ।

গ্রামীণ ও নগর সমাজতত্ত্ব

শিল্প বিপ্লবের ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়নের সাড়া জেগেছে । মানুষ গ্রাম ছেড়ে নগরমুখী হচ্ছে । এমতাবস্থায় সমাজবিজ্ঞান গ্রামীণ ও নগর সমাজের বিভিন্ন দিক আলোচনা করে গ্রামের মানুষকে গ্রামীণ সমাজ আর শহরের মানুষকে নাগরিক সমাজের বসবাসে উদ্বুদ্ধ করছে ।

অন্যান্য

এছাড়া আইনের সমাজতত্ত্ব, সামাজিক পরিসংখ্যান, অপরাধ সমাজতত্ত্ব, শিল্পকলার সমাজতত্ত্ব, লোকসমাজতত্ত্ব, সমাজচিন্তা ইত্যাদি বিষয়েও সমাজবিজ্ঞানের পরিধির আওতাভুক্ত ।

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ব্যক্তি বা সমাজ জীবনের এমন কোনো দিক নেই যা সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আওতাবহির্ভূত । ফলে ব্যক্তির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক, ধর্মীয়, শিক্ষাগত, ইত্যাকার জীবন তথা গোটা মানবীয় আচরণ সমাজবিজ্ঞানের পরিধিভুক্ত । সমাজবিজ্ঞানের পরিধি বা বিষয়বস্তুর এ ব্যাপকতার জন্যই একে একটি গতিশীল ও বিশ্লেষণধর্মী বিজ্ঞান হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় ।

Next Post Previous Post