সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি

সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতির বিভিন্ন পর্যায় ও ফলাফল।

দাক্ষিণাত্য নীতি সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনকালের একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। উত্তর ভারতের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করে সম্রাট দক্ষিণ ভারতের দিকে নজর দেন এবং ১৬৮১ খ্রিস্টাব্দ থেকে তাঁর জীবনের শেষ পর্যন্ত দাক্ষিণাত্যে মারাঠা দমনের প্রচেষ্টা এবং বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা অধিকার করেই জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটান। সম্রাটের দাক্ষিণাত্য নীতির পেছনে বিবিধ রাজনৈতিক, সামরিক ও প্রশাসনিক কারণ নিহিত ছিল।

পূর্বপুরুষদের নীতি অনুসরণ : অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি সম্রাট আকবরের সম্প্রসারণ নীতিরই অনুসরণ মাত্র। ভৌগোলিক বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধির জন্য ভারতের আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দাক্ষিণাত্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় আকবরসহ সকল সম্রাটই চেষ্টা করেছিলেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব পূর্বপুরুষদের এ নীতি অনুসরণ করেন। ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড ও গ্যারেট বলেন, "আওরঙ্গজেব ষোড়শ শতাব্দীতে আকবর প্রবর্তিত আক্রমণাত্মক নীতি এবং পূর্বসূরি জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের নীতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ।"

মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষা : বিজাপুর, গোলকুণ্ডাসহ দাক্ষিণাত্যের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম রাজ্যসমূহ মুঘল সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাছাড়া মহারাষ্ট্রীয় অভ্যুত্থান মোকাবিলার জন্যও বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা নিয়ন্ত্রণ জরুরি বলে সম্রাট আওরঙ্গজেব মনে করেছিলেন।

প্রশাসনিক কারণ : বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা মুঘল সাম্রাজ্যকে নিয়মিত করদানে চুক্তিবদ্ধ ছিল। কিন্তু তারা চুক্তি ভঙ্গ করে কর দানে বিরত থাকায় সম্রাট প্রশাসনিক প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি বলে মনে করেছিলেন।

মারাঠা অভ্যুত্থান রোধ : শিবাজী ও তাঁর পুত্র শম্ভুজীর নেতৃত্বে দাক্ষিণাত্যে মারাঠা শক্তির অভ্যুত্থান সম্রাট আওরঙ্গজেবের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মারাঠাদের জাতীয়তাবাদী অভ্যুত্থান মুঘল সার্বভৌমত্বের প্রতি বিশেষ হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছিল । এ হুমকি মোকাবিলায় মারাঠা শক্তির অভ্যুত্থান রোধ করার জন্য সম্রাট আওরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্য নীতি গ্রহণ করতে হয়।

যুবরাজ আকবরের বিদ্রোহ দমন : সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিদ্রোহী পুত্র যুবরাজ আকবরের সাথে মারাঠা নেতা শম্ভুজীর মৈত্রী ও সন্ধি স্থাপনে সম্রাট বিচলিত বোধ করেন। পুত্রের বিদ্রোহ দমন ও তাঁকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে সম্রাট দাক্ষিণাত্যে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন।

দাক্ষিণাত্য নীতির পর্যায় (Stages fo Deccan Policy)

সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতিকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। যথা :

প্রথম পর্যায় : প্রথম পর্যায়ে ১৬৫৮-৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত এ পর্বে সম্রাট দাক্ষিণাত্যে মারাঠা নেতা শিবাজীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিলেন।

দ্বিতীয় পর্যায় : ১৬৮০-৮৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ব্যাপ্ত সময়কালে সম্রাট দাক্ষিণাত্যের মুসলিম রাষ্ট্র বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা অধিকার করেন। তাছাড়া বিদ্রোহী যুবরাজ আকবরের আশ্রয়দাতা এবং তদানীন্তন মারাঠা নেতা শম্ভুজীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন।

তৃতীয় পর্যায় : ১৬৮৭-১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেব মারাঠা নেতা শম্ভুজী ও অন্যান্য মারাঠা নেতাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত ছিলেন।

Aurangzeb was following the policy of aggressive imparialism intitiated by Akbar in the 16th century and encouraged by his successors Jahangir and Shahjahan -Ref Illiot & Dawson History of India as Told by its Own Historians.

প্রথম পর্যায়

শিবাজীর উত্থান : ভারতে মারাঠা অভ্যুত্থানের মহানায়ক শিবাজী। তাঁর পিতার নাম শাহজী ভোসলে এবং মাতা জিজাবাঈ । মারাঠা অভ্যুত্থানের প্রধান নায়ক শিবাজীর জন্ম ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর পিতা শাহজী দ্বিতীয় তুকবাঈকে নিয়ে শিবাজীর জন্মের পূর্বেই কনাটক চলে গেলে শিবাজী এবং তাঁর মা পুনাতে দাদা কোন্দদের নামে এক ব্রাহ্মণের তত্ত্বাবধানে বাস ভারতে থাকেন। এসময় থেকে রামায়ণ ও মহাভারতের নানা বীরত্বগাথার সাথে পরিচয় সূত্রে শিবাজীর মধ্যেও বীর হওয়ার বাসনা জাগ্রত হয়। গুরু রামদাস ও তুকরাম শিবাজীকে ভারতে স্বাধীন হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করেন। এ লক্ষ্যে শিবাজী পার্বত্যাঞ্চলের মারাঠা কৃষিজীবীদের সংগঠিত করে মারাঠাদের জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে ঐক্যবদ্ধ এক সংগ্রামী জাতিতে পরিণত করেন।

শিবাজীর বিরুদ্ধে অভিযান : আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের সুবাদার থাকা অবস্থায়ই শাহী ভোসলে ও তাঁর পুত্র শিবাজীর তৎপরতা লক্ষ করেন। ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দে শিবাজী বিজাপুরের তোমা দুর্গ এবং এরপর রায়গড় দুর্গ অধিকার করে একে একে। তিনি ঢাকান, বারমতী, ইন্দ্রপুর, পুরন্দর ও কোন্দার দুর্গ জয় করেন। শিবাজীর ডৎপরতায় ক্ষুব্ধ হয়ে বিজাপুরের সুলতান তাঁর পিতা শাহজী ভোসলেকে জিম্মি করলে ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শিবাজী তাঁর সমর তৎপরতা বন্ধ রাখেন। কিন্তু শিবাজী ১৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দে চন্দ্ররাও মোরের নিকট থেকে অর্ধস্বাধীন সামন্ত রাজ্য জাবালী দখল এবং ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে আহমদনগর ও জুনার লুণ্ঠন করেন। শিবাজীর শক্তি বৃদ্ধিতে আওরঙ্গজেব শঙ্কা বোধ করেন এবং দাক্ষিণাত্যে সুবাদার থাকা অবস্থায়ই তাঁকে দমনের চেষ্টা করেন। কিন্তু উত্তরাধিকার সংঘাতের কারণে তিনি পদক্ষেপ নিতে পারেননি। ক্ষমতায় বসে সম্রাট শিরাজীর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী আফজাল খানকে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দের ১০ নভেম্বর শিবাজী কৌশলে আফজাল খানকে তার প্রতাপগড় দুর্গে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন। নেতৃত্বহীন বিজাপুর বাহিনী পরাজিত হলে সম্রাট শিবাজীকে তার অধিকৃত অঞ্চলের স্বাধীন শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দানে বাধ্য হন। আফজাল খানের মৃত্যুর পর প্রথমে শায়েস্তা খান ও পরে শাহজাদা মুয়াজ্জমকে দাক্ষিণাত্যের সুবাদার করে পাঠানো হয়। শায়েস্তা খান সফল না হলেও মুয়াজ্জম রায়গড় ও পুরন্দর দুর্গসহ একে একে শিবাজীর নিয়ন্ত্রিত বেশ কয়েকটি দূর্গ দখল করে তাঁকে কোণঠাসা করে ফেলে। শেষ পর্যন্ত শিবাজী মুঘলদের সাথে পুরন্দরের চুক্তি সম্পাদনে বাধ্য হন। চুক্তি মোতাবেক শিবাজি তাঁর অধিকৃত ২৫টি দুর্গ মুঘলদের হাতে ছেড়ে দেন। বিজাপুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুঘলদের সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। মুঘলরাও শিবাজীকে বিজাপুর রাজ্যের কয়েকটি জেলার চৌথ আদায়ের অনুমতি দেয়। বিজাপুর ও গোলকুন্ডার সাথে শিবাজী যেন কোনো ঐক্য পড়তে না পারে সেজন্য জয় সিংহ কৌশলে শিবাজীকে মুঘল রাজদরবার আগ্রায় নিয়ে নজর বন্দি করে রাখেন। অবশ্য শিবাজী কৌশলে আগ্রা থেকে মহারাষ্ট্রে যান। প্রায় তিন বছর শক্তি সঞ্চয় করে ১৬৭০ খ্রিষ্টাব্দে শিবাজী পুনরায় মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে আওরঙ্গজেবের ব্যস্ততার সুবাদে মুঘল প্রদেশ। মেবার, বাগলানা ও খান্দেশ আক্রমণ এবং সুরাট থেকে চৌথ আদায় করে নিজেকে শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দের ৬ জুন রায়গর দুর্গে শিবাজীর রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠিত হয়। শিবাজী 'ছত্রপতি' উপাধি গ্রহণ করেন। শিবাজীর অভিষেকের মধ্য দিয়ে দাক্ষিণাত্যে একটি হিন্দু রাজা গঠিত হয়। ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে মহারাষ্ট্রে শিবাজীর মৃত্যু হয়।

দ্বিতীয় পর্যায়

ছত্রপতি শিবাজীর মৃত্যুতেও মারাঠা শক্তি দুর্বল হয়নি বরং দাক্ষিণাত্যে ক্রমে মুঘল বিরোধিতা বাড়তে থাকে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মেবারে রাজপুত দমনে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হলে সম্রাট আওরঙ্গজেব শাহজাদা আকবরকে সেখান থেকে প্রত্যাহার করেন। এতে রুষ্ট হয়ে আকবর বিদ্রোহ করেন এবং মারাঠা নেতা শিবাজীর পুত্র শম্ভুজীর সাথে যোগ দেন। এতে মারাঠাদের শক্তি বৃদ্ধি পায়। এ ঘটনায় সম্রাট শঙ্কাবোধ করেন এবং দাক্ষিণাত্যের ব্যাপারে নতুন নীতি গ্রহণ করতে হয়। সকল দিক বিবেচনা করে স্বয়ং সম্রাট রাজধানী ছেড়ে দাক্ষিণাত্যে চলে আসেন এবং আহমদনগরে বসবাস শুরু করেন। ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দ থেকে তাঁর রাজত্বের অবশিষ্টাংশ পর্যন্ত আহমদনগরই তাঁর প্রধান রাজনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়।

বিজাপুর অভিযান : দাক্ষিণাত্যের বিজাপুর রাজ্য মুঘলদের বার্ষিক করদানে চুক্তিবদ্ধ ছিল। কিন্তু তাঁরা চুক্তি ভঙ্গ করলে ১৬৬৫, ১৬৮০ ও ১৬৮২ খ্রিষ্টাব্দে যথাক্রমে জয় সিংহ, দিলিরখান এবং শাহজাদা মোয়াজ্জমের তিনটি ব্যর্থ অভিযান পরিচালিত হয়। ১৬৮৫ খ্রিষ্টাব্দে শাহজাদা মোয়াজ্জমের নেতৃত্বে মুঘল বাহিনী পুনরায় বিজাপুর অবরোধ করে। দীর্ঘ পনেরো মাসের অবরোধ সত্ত্বেও বিজাপুর দখল করা সম্ভব না হওয়ায় স্বয়ং সম্রাট অবরোধ তত্ত্বাবধানে বিজাপুর উপস্থিত হন। সম্রাটের উপস্থিতিতে মুঘল বাহিনীর মনোবল বৃদ্ধি পায় এবং ১৬৮৬ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে বিজাপুরের সুলতান। সিকান্দার শাহ আত্মসমর্পণ করেন। এ আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আদিলশাহী সালতানাতের অবসান ঘটে এবং বিজাপুর মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।

গোলকুণ্ডা অধিকার : গোলকুণ্ডার কুতুবশাহী সুলতান আবুল হাসান মুঘলদের বিরুদ্ধে মারাঠা ও বিজাপুরকে সমর্থন দিয়ে সম্রাটের বিষদৃষ্টিতে পড়েছিলেন। তাই সম্রাট ১৬৮৫ খ্রিস্টাব্দে গোলকুণ্ডা আক্রমণ করেন। সুলতান পরাজিত হয়ে গোলকুণ্ডা দুর্গে আশ্রয় নিলে সম্রাট স্বয়ং ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ ফেব্রুয়ারি দুর্গ অবরোধ করেন। ৮ মাস অবরোধের পরও দুর্গ অধিকৃত না হওয়ায় উৎকোচ দিয়ে গোলকুণ্ডার প্রধানমন্ত্রী আবদুল্লাহ পনি দুর্গের ফটক খোলার ব্যবস্থা করেন। নিরুপায় হয়ে সুলতান আবুল হাসান আত্মসমর্পণ করলে তাকে বার্ষিক ৫০,০০০ টাকা বৃত্তি দিয়ে দৌলতাবাদ দুর্গে আবদ্ধ রাখা হয়। গোলকুণ্ডা মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।

তৃতীয় পৰ্যায়

মারাঠাদের বিরুদ্ধে পুনরায় অভিযান : বিজাপুর ও গোলকুন্ডা জয়ের পর আওরঙ্গজের পুনরায় মারাঠাদের দিকে নজর দিলেন। নবনিযুক্ত মুঘল সামরিক অধিনায়ক মুকাররম খান সামেশ্বর থেকে শম্ভুজীকে বন্দি করেন। ১৬৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ মার্চ শম্ভুজীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। মুঘলরা মারাঠা রাজধানী রায়গড় অধিকার করেন। শম্ভুজীর পুত্র শাহুকে বন্দি করা হয়। ত্রিলোচনপরী ও তাঞ্জোরের হিন্দু রাজারা আওরঙ্গজেবের আনুগত্য স্বীকার করে নেন। তবে তখনও মারাঠা প্রতিরোধের অবসান ঘটেনি। শিবাজীর পুত্র রাজারাম মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অব্যাহত রাখেন। এ সময় মুঘলরা। জিঞ্জি (১৬৯৮ খ্রি.) দুর্গসহ মারাঠাদের বেশ কিছু দূর্গ দখল করে বটে তবে রাজারামের নেতৃত্বে মারাঠা গেরিলারা তাদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে রাজারাম মৃত্যুবরণ করলে তার বিধবা স্ত্রী তারাবাঈ শিশু পুত্র তৃতীয় শিবাজীর নেন। প্রথর নামে শাসনভার নেন। প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন এই মহিলা মারাঠাদের সুসংঘবদ্ধ করে মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন । আওরঙ্গজেব অনেক চেষ্টা করেও মারাঠাদের নির্মূল করতে ব্যর্থ হন।

দাক্ষিণাত্য নীতির যৌক্তিকতা : সম্রাট আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতির যৌক্তিকতা সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ একমত নন। অনেকেই মনে করেন দাক্ষিণাত্য নীতি বিশেষ করে বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা বিজয় আওরঙ্গজেবের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার পরিচায়ক। স্মিথ, এলফিনস্টোন প্রমুখের মতে, বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা রাজ্য বিজয় সুলতানের অদূরদর্শী পদক্ষেপ। কেননা এর ফলে তাদের প্রতিরোধের মতো আর কোনো শক্তি না থাকায় দাক্ষিণাত্যে মারাঠাদের উত্থানের পথ প্রশস্ত হয়। তাদের মতে, মারাঠাদের বিরুদ্ধে সম্রাট এ দুটি রাষ্ট্রের যৌথ শক্তিকে ব্যবহার করতে পারতেন। আর নিজেদের স্বার্থেই রাষ্ট্র দুটি মারাঠা দমনে চেষ্টা করত। কিন্তু তিনি তা করেননি। সুন্নি সম্রাট শিয়া রাষ্ট্র দুটিকে ধর্মীয় কারণে দখল করেছিলেন বলে কেউ কেউ মনে করেন। অবশ্য ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার, রায় চৌধুরী প্রমুখ উপরিউক্ত মতের বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাদের মতে, গোলকুণ্ডা ও বিজাপুর রাজ্যের স্বাধীনতা বজায় থাকলেও তাদের দ্বারা মারাঠাদের প্রতিহত করা সম্ভব হতো এমনটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কেননা এ দুটি রাজ্য ছিল আত্মকলহে লিপ্ত দুর্বল ও পতনোন্মুখ। তাছাড়া সম্রাটের দাক্ষিণাত্য নীতির পেছনে ধর্মীয় উন্মাদনা কাজ করেছিল এরূপ বলাও সংগত নয় । বস্তুতপক্ষে দাক্ষিণাত্যনীতি সম্রাটের সাম্রাজ্যবাদী নীতিরই বহিঃপ্রকাশ।

দাক্ষিণাত্য নীতির ফলাফল ( Results of Deccan Policy)

দাক্ষিণাত্য নীতির ফলে সম্রাট আওরকাজের আপাতদৃষ্টিতে অনেক কিছু লাভ করলেও প্রকৃতপক্ষে সব কিছুই হারান। এ সময় থেকে তার পতন শুরু হয়। এ নীতি তার জীবনে অত্যন্ত মর্মান্তিক ও নৈরাশ্যজনক অধ্যায়ের সূচনা করেছিল, যা মুঘল সাম্রাজ্যের পতনকেও ত্বরান্বিত করে। স্যার যদুনাথ সরকার এ সম্পর্কে বলেন,

'All Seemed to have been gained by Aurangzeb now; but in reality all was lost. It was the beginning of his end. The saddest and most hopeless chapter of his life now opened."

প্রথমত, দাক্ষিণাত্য বিজয়ের ফলে সম্রাট আওরঙ্গজের কাবুল থেকে চট্টগ্রাম এবং কাশ্মির হতে কাবেরী পর্যন্ত এর বিশাল বিস্তৃত সাম্রাজ্যের অধিপতি হলেন। ইতোপূর্বে অন্য কোনো মুঘল সম্রাট আর এরূপ বিস্তৃত সাম্রাজ্যের অধিপতি হতে পারেননি। তবে এত বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনা ও সর্বত্র সুশাসন প্রতিষ্ঠা একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। উপরন্তু এর ফলে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গিবন বলেন, 'দাক্ষিণাত্য রাজধানী থেকে বেশ দূরে হওয়ায় কেন্দ্রীয় শাসনে বেশ শৈথিল্য দেখা দেয়। ফলে উত্তর ও মধ্য ভারতে চরম বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা দেয়।

দ্বিতীয়ত, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের ফলে সাম্রাজ্যের অর্থনীতিতেও সংকট দেখা দেয়। কৃষিব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য অধঃগতিতে নিপতিত হয়। ফলে রাজকোষের ওপর দারুণ চাপ পড়ে। এর ফলে সৈন্যদের বেতন বকেয়া পড়ায় সাম্রাজ্যে সেনাবিদ্রোহের পরিস্থিতি তৈরি হয় ।

তৃতীয়ত, দাক্ষিণাত্যে দীর্ঘ ২৫ বছরের যুদ্ধে বহু সৈন্য প্রাণ হারায়। মারাঠাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে ব্যর্থতায় মুঘল বাহিনীর সামরিক ক্ষমতা, দক্ষতা ও আত্মপ্রত্যয় হ্রাস পায়।

চতুর্থত, উত্তর ভারতে সম্রাটের দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে সেখানে তার প্রভাব হ্রাস পায়। উত্তর ও মধ্য ভারতে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা দেখা যায়। মুঘলদের বিরুদ্ধে মারাঠাদের প্রতিরোধ যুদ্ধে উৎসাহিত হয়ে আফগান, শিখ, জাঠ, মেওয়াটি ও রাজপুতরা চারদিক থেকে মাথা তুলে দাঁড়ায়। মুঘলদের বিরুদ্ধে তাদের বিদ্রোহ সাম্রাজ্যের ভিত্তিমূলকে দুর্বল করে দেয়। উত্তর ভারতে সম্রাটের অনুপস্থিতিতে বাংলায় ইংরেজ শক্তির উত্থান নিষ্কণ্টক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় মুঘ সাম্রাজ্যকে পতনের দিকে ধাবিত করে। সার্বিক দিক বিবেচনায় বলা যায় যে, দাক্ষিণাত্যনীতি সম্রাট ও সাম্রাজ্যের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনেনি। স্মিথ বলেন, “দাক্ষিণাত্য সম্রাটের খ্যাতি ও দেহের সমাধিভূমি ছিল।, স্প্যানিশ ক্ষত নেপোলিয়নকে যেভাবে ধ্বংস করে, আওরঙ্গজেবকেও অনুরূপভাবে দাক্ষিণাত্য ক্ষত ধ্বংস করে। যদুনাথ সরকার পঞ্চমত, দাক্ষিণাত্য বিজয়ের পর সম্রাট দাক্ষিণাত্য নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাই সার্বিকভাবে সাম্রাজ্যের উন্নতির দিকে তিনি মনোযোগ দিতে পারেননি। ফলে সাম্রাজ্যের ভিত যেমন নড়বড়ে হয়ে পড়ে, তেমনি কৃষ্টি ও সভ্যতার বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়।

Next Post Previous Post