১৭৭২ হতে ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমি রাজস্বনীতি।

১৭৭২ হতে ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমি রাজস্বনীতির বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যালোচনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : ১৭৭২ সালে কোম্পানি বাংলার দেওয়ানি শাসন ক্ষমতা স্বহস্তে গ্রহণ করে। বাংলার প্রথম ইংরেজ গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস ও তৃতীয় গভর্নর লর্ড কর্ণওয়ালিসের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার লাভজনক বন্দোবস্ত সাধন। কিন্তু ভূমি প্রশাসন ব্যবস্থায় অনভিজ্ঞতা এবং এ দেশের আইন-কানুন, প্রথা, প্রতিষ্ঠান ও ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে বারবার প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হয়েছে ।

১৭৭২ হতে ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমি রাজস্বনীতি :

১৭৭২ সাল হতে ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমি রাজস্বনীতি নিম্নে আলােচনা করা হলো :

১. হেস্টিংসের পদক্ষেপ : ১৭৭২ সালে বিলেতের পরিচালক সভা ওয়ারেন হেস্টিংসকে ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর নিয়ােগ করার সময় নির্দেশ দেয় যে, "The company was to stand henceforth as the Dewan," অর্থাৎ এখন থেকে দ্বৈতশাসনের অবসান ঘটিয়ে কোম্পানি যেন নিজহাতে দেওয়ানির দায়িত্ব গ্রহণ করে। এছাড়া পরিচালক সভা তাঁকে ভূমি রাজস্ব বন্দোবস্তের পূর্ণক্ষমতা প্রদান করে। বিলেতের পরিচালক সভার নির্দেশক্রমে ১৭৭২ সালের এপ্রিল মাসে দ্বৈতশাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে হেস্টিংস বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি তথা ভূমি রাজস্ব প্রশাসন নিজ হাতে গ্রহণ করেন। পরিচালক সভার নির্দেশক্রমে ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭২ সালের ১১ মে মুর্শিদাবাদ থেকে খালসা বা ভূমি রাজস্ব অফিস কলকাতায় নিয়ে আসেন।

২. নায়েব দেওয়ানের পদ বিলুপ্তকরণ : কোম্পানির পরিচালকগণ দেশীয় নায়েব দেওয়ানদের চরিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন য, তারা অসৎ ও দুর্নীতিগ্রস্ত এবং তাদের অপসারণ করতে হবে। এজন্য বাংলার রাজস্ব আদায়কারী নায়েব দেওয়ান সৈয়দ মােহাম্মদ রেজা খান এবং বিহারের রাজস্ব আদায়কারী সিতাব রায়কে পদচ্যুত করে দেওয়ান পদ দুটি উঠিয়ে দেন।

৩. ভূমিনীতি প্রণয়ন : দেওয়ানির দায়িত্ব গ্রহণের পর হেস্টিংস ভূমি রাজস্ব বিষয়ক দুটি নীতি গ্রহণ করেন। প্রথমত, ভূমি নিলামে দিয়ে সর্বোচ্চ ভূমি রাজস্ব স্থির করা এবং দ্বিতীয়ত, আপাতত পাঁচ বছরের জন্য নিলামদারদেরকে বন্দোবস্ত দিয়ে রাজস্ব ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা আনয়ন।

৪. বাের্ড অব রেভিনিউ গঠন : উপরিউক্ত দুটি নীতি স্থির করার পর হেস্টিংস গভর্নর ও তার কাউন্সিলের সব সদস্য নিয়ে একটি 'বোর্ড অব রেভিনিউ' গঠন করেন। এ পরিষদ রাজস্ব পরিচালনার পূর্ণ দায়িত্ব লাভ করেন। রাজস্ব বিষয়ে বাের্ডকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য দেশীয় কর্মচারীদের থেকে নিযুক্ত করা হয় একজন মুৎসদ্দি। যার উপাধি ছিল রায় রায়ান।

৫. কালেক্টরদের দায়িত্ব বণ্টন : হেস্টিংস কোম্পানির রাজস্ব আদায়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী 'Supervisor' -দের নাম 'Collector'-এ পরিবর্তিত করে তাদের উপর জেলার রাজস্ব আদায়, রাজস্ব কার্যের পরিচালনা এবং ভূমি নিলাম বন্দোবস্ত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। জেলা কালেক্টরকে সাহায্য করার জন্য দেশীয় কর্মচারীদের মধ্য থেকে একজনকে দেওয়ান নিযুক্ত করা হয়। বোর্ড অব রেভিনিউ জেলা কালেক্টরদের কাজকর্মের তদারকি করার দায়িত্ব ও ক্ষমতা লাভ করে।

৬. কমিটি অব সার্কিট গঠন : গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস ও তার কাউন্সিলের চারজন সদস্য নিয়ে ১৭৭২ সালে গঠন করা হয় "Committee of Circuit" নামে একটি ভ্রাম্যমাণ কমিটি। এ কমিটির দায়িত্ব ছিল জেলায় জেলায় ঘুরে কালেক্টরদের সাহায্যে জমির নিলাম বন্দোবস্ত করা।

৭. পাঁচসালা বন্দোবস্ত প্রবর্তন : রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে উপরিউক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানােরপর হেস্টিংস ১৭৭২ সালে স্থির করেন যে, প্রতি জেলায় জমি নিলামে পাঁচ বছরের জন্য বন্দোবস্ত দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি সার্বোচ্চ কর দিতে রাজি হবে তাকেই পাঁচ বছরের জন্য জমি ইজারা দেওয়া হবে। এ নিলামগ্রহীতাদের নাম দেওয়া হয় ইজারাদার

৮. কালেক্টর প্রথা বিলােপ : কিছুদিন পর হেস্টিংস লক্ষ্য করেন যে, জেলার ইংরেজ কালেক্টররা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা নিলাম দেওয়ার সময় উৎকোচ ও উপঢৌকন নিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন এবং এসব অর্থ ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে বিনিয়ােগ করেন। এমতাবস্থায় তিনি ইংরেজ কালেক্টরের পদ বিলুপ্ত করেন। তদস্থলে প্রতি জেলায় ভারতীয় দেওয়ান নিয়োগ করেন।

৯. প্রাদশিক কাউন্সিল গঠন : নতুন ভারতীয় দেওয়ানের ভূমি রাজস্ব সংক্রান্ত কাজের তদারকির জন্য ছয়টি প্রাদেশিক কাউন্সিল গঠন করা হয়। প্রাদেশিক কাউন্সগিলগুলোর নাম ছিল ঢাকা, কলকাতা, মুশির্দাবাদ, বর্ধমান, দিনাজপুর ও পাটনা।

১০. আমিনি কমিশন গঠন : চড়া দামে নিলাম ধরে নতুন জমিদাররা সর্বস্বান্ত হলে এবং কোম্পানির কর্মচারীদের দুর্নীতির কারণে পাঁচসালা বন্দোবস্ত ব্যর্থ হতে চললে হেস্টিংস ভূমি রাজস্ব সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য ১৭৭৬ সালে 'আমিনি কমিশন' গঠন করেন। এ কমিশনকে জমির সঠিক রাজস্ব কি হওয়া উচিত এবং জমি কিভাবে বন্দোবস্ত দেওয়া উচিত সে সম্পর্কে তদন্ত করে তথ্য দিতে বলা হয়।

১১. একসালা বন্দাবস্ত প্রবর্তন : ১৭৭৭ সালে পাঁচসালা বন্দোবস্তের মেয়াদ শেষ হলে হেস্টিংস এটি রদ করেন এবং আপাতত একসালা বন্দোবস্ত চালু করেন। এ বন্দোবস্ত অনুযায়ী ইজারাদারদের বাদ দিয়ে পুরাতন জমিদারদের সাথে প্রতি বছর জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। জমিদার রাজস্ব বাকি ফেললে জমিদারির একাংশ বিক্রি করে রাজস্ব পরিশােধের নিয়ম চালু করা হয়। জেলায় পুনরায় ইংরেজ কালেক্টর নিয়ােগ দেওয়া হয়। তাদের সাহায্যের জন্য দেশীয় কানুনগো নিয়ােগ দেওয়া হয়।

১২. কর্নওয়ালিসের তথ্য সংগ্রহ : লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৮৬ সালে গভর্নর জেনারেলের পদ গ্রহণ করেন। ১৭৮৭ সালে তিনি জেলা কালেক্টরের মাধ্যমে কতকগুলাে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ শুরু করেন। যেমন
(ক) রাজস্বের পরিমাণ কত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
(খ) কাদের সাথে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া উচিত
(গ) জমিদারদের অত্যাচার থেকে রায়ত অর্থাৎ প্রজাবর্গকে রক্ষা করার জন্য কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন ইত্যাদ

১৩. দশসালা বন্দোবস্ত : জেলা কালেক্টরগণ কর্নওয়ালিসের নির্দেশানুসারে দীর্ঘ দুই বছর ধরে তথ্যাদি সংগ্রহ করে পাঠান। এসব তথ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কর্নওয়ালিস ১৭৮৯ সালে জমিদারদের সাথে দশ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্ত দিতে প্রস্তত হন। এ বন্দোবস্তের সাথে এ প্রতিশ্রুতিও তিনি দিতে চান যে, কোম্পানির পরিচালক সভার অনুমােদন পেলে দশসালা বন্দাবস্তকেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত করা হবে।

১৪. বোর্ড অব কন্ট্রোলে দশসালা অনুমোদন : কর্নওয়ালিস তার রাজস্ব বিভাগের সচিব স্যার শােরের পরামর্শক্রমে ১৭৮৯ সালে বাংলা ও বিহারে এবং পরের বছর উড়িষ্যায় দশসালা বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। এটি অনুমােদনের জন্য তিনি বিলেতের 'বোর্ড অব কন্ট্রোলের' নিকট আবেদন করলে বোর্ডের সভাপতি হেনরি ডান্ডাস ও ইংল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিট কর্নওয়ালিসের সুপারিশগুলো পর্যালােচনা করে চূড়ান্ত অনুমোদন দান করেন।

১৫. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত : লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৮৯ সালে দশসনা বন্দোবস্তের সাথে সাথে ঘোষণা করেছিলেন যে, তাঁর এই দশসনা বন্দোবস্ত 'কোর্ট অব ডাইরেক্টর 'অনুমেদন করলেই তা চিরস্থায়ী বলে ঘোষণা করবেন। লর্ড কর্ণওয়ালিস দশসনা বন্দোবস্ত করলে সাথে সাথে তা চিরস্থায়ী করার জন্য কর্তৃপক্ষের নিকট সুপারিশ করেন। তাঁর সুপারিশের প্রেক্ষিতে বাের্ড অব কন্ট্রোলের সদস্যদের মধ্যে বিভিন্ন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। অবশেষে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর কোম্পানির অর্থনৈতিক স্বার্থের সাথে সাথে রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার জন্য ১৭৯২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কোর্ট অব ডাইরেক্টর দশসনা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী করার পক্ষে অনুমােদন প্রদান করে। অতঃপর লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালের ২৩ মার্চ দশসনা বন্দোবস্তকেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে ঘােষণা দেন এবং জমিদারদের সাথে চিরস্থায়ী জমি বন্দোবস্তের নীতি গ্রহণ করেন। এভাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয়।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৭৭২ থেকে ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত বাংলার ভূমি রাজস্ব নিয়ে চলে ব্যাপক গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এ সময়ে প্রবর্তিত পাঁচসালা ও একসালা বন্দোবস্তে রাজস্বের হার বেশি হওয়ায় রাজস্ব অনাদায়ী থাকত এবং রায়তদের শোষণ করা হতো। অবস্থার উন্নতির জন্য কর্নওয়ালিস দশসালা ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন বটে কিন্তু অবস্থার তেমন উন্নতি হয় নি; বরং নতুন ব্যবস্থায় রায়ত ও পুরাতন জমিদাররা ধ্বংসের সম্মুখীন হয়।

Next Post Previous Post