ভার্সাই চুক্তি কি আরোপিত চুক্তি ?
ভার্সাই চুক্তি কি আরোপিত চুক্তি? ব্যাখ্যা কর।
উত্তর : ভূমিকা : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে বিজয়ী ও বিজিতদের মধ্যে যে পাঁচটি শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয় ভার্সাই চুক্তি ছিল তন্মধ্যে প্রথম ও প্রধান চুক্তি। ভার্সাই চুক্তি আধুনিককালের এক গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কমূলক দলিল। জার্মান জাতি এই চুক্তিকে "Dictated Peace" বা বিজিতের উপর বিজেতারা জবরদস্তিমূলক শান্তিচুক্তি বলে মনে করে।
ভার্সাই চুক্তি কি আরোপিত চুক্তি :
জার্মান জাতি এমনকি ইউরোপের আরাে অনেক জাতি ভার্সাই সন্ধিকেজার্মানির উপর আরােপিত চুক্তি হিসেবে অভিহিত করেছেন। অবশ্য পরাজিত শত্রুর নিকট সকল শান্তিচুক্তি অন্যায় ও নিষ্ঠুর বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। জার্মানি ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত শক্তি। পরাজিত শক্র কর্তৃক শান্তিচুক্তি সানন্দে গ্রহণ করার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে নেই। কোনো দেশই যুদ্ধে পরাজয়ের জন্য নিজেকে কখনাে দোষী সাব্যস্ত করে না। যুদ্ধে জার্মানি জয়লাভ করলে মিত্রশক্তিবর্গের প্রতি জার্মানিও অনুরূপ আচরণ করতো। কেননা রাশিয়া ও রুমানিয়ার সাথে সম্পাদিত যথাক্রমে ব্রেস্ট-লিটভস্ক ও বুখারেস্টের সন্ধির মধ্যে জার্মানির প্রতিশোধাত্মক মনােভাবের সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। তবে এ কথা সত্য যে, ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে মিত্রশক্তিবর্গ জার্মানির উপর তাদের প্রতিশোধাত্মক মনোভাব চাপিয়ে দিয়েছিল। ঐতিহাসিক ই.এইচ. কার (E.H. Car)-এর মতে,
যুদ্ধের অবসানকল্পে যেসব সন্ধি রচিত হয়, সেগুলো প্রায় প্রতিটি পরাজিত শত্রুর উপর জবরদস্তিমূলকভাবে চাপান হয়ে থাকে, কারণ পরাজিত শত্রু কখনো স্বেচ্ছায় তার পরাজয়ের গ্লানি বহন করে না। কিন্তু আধুনিককালে রচিত অপরাপর সন্ধিগুলাের তুলনায় ভার্সাই সন্ধিতে বিজিত শক্রুর প্রতি বিজেতার জবরদস্তিমূলক মনােভাবের তীব্রতা অধিক লক্ষ্য করা যায়।
ভার্সাই চুক্তি যে জার্মানির উপর আরােপিত ছিল সে প্রসঙ্গে নিম্নে কিছু যুক্তি দেখান হলো :
প্রথমত, ভার্সাই সন্ধির দ্বারা জার্মানির ভৌগোলিক সীমাহ্রাস করা হয়। এতে জার্মানি ফ্রান্সকে আলসাস, লােরেন এবং বেলজিয়ামকে মরসনেট, ম্যালমেডি ও ইউপেন নামক স্থানের অধিকার দিয়েছিण। তাছাড়া জার্মানির কয়লা খনি সমৃদ্ধ সার' অঞ্চল ১৫ বছরের জন্য জাতিপুঞ্জ কমিশনের তত্ত্বাবধানে ছেড়ে দেয়া হয় এবং ফ্রান্স তা থেকে সুবিধা ভােগ করে। উত্তর সাইলেশিয়া অঞ্চলকে অন্যায়ভাবে পোল্যান্ডের কর্তৃত্বে দেওয়া হয়। এভাবে জার্মানির ভৌগোলিক সীমাহ্রাস করে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার নীতির দেহে অস্ত্রোপাচার করা হয়।
দ্বিতীয়ত, ভার্সাই সন্ধিতে স্বাক্ষরকারী সকল রাষ্ট্রই যুদ্ধের সাজ সরঞ্জাম ও যুদ্ধাস্ত্র হ্রাস করার নীতি গ্রহণ করে। কিন্তু কার্যক্ষত্রে এ নীতি উপেক্ষিত হয়েছিল। স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রবর্গ নিজ নিজ রাষ্ট্রের সামরিক শক্তি অপরিবর্তিত রেখে জার্মানির ক্ষেত্রেই কেবল এ নীতি কঠোরভাবে প্রয়ােগ করেছিল।
তৃতীয়ত, ভার্সাই চুক্তিতে জার্মানির কাধে এক বিশাল পরিমাণ ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছি জার্মানি কিভাবে এ বিশাল ক্ষতিপূরণের অঙ্ক পরিশোধ করবে তার কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশ সন্ধিপত্রে ছিল না।
চতুর্থত, পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও জার্মানির উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। এমনকি জার্মানির কিয়েল খালে সকল জাতিকে অবাধ নৌ-চলাচলের অধিকার দানসহ এলব, ওডার, নাইম্যাম ও দানীয়ুব নদীকে আন্তর্জাতিকীকরণ করা হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ভার্সাই চুক্তি ছিল আরোপিত চুক্তি। জার্মানির প্রতি ইউরোপীয় শক্তিবর্গের প্রতিশােধমূলক মনোভাব এবং অপমানজনক ব্যবহারের ফলে মানসিক প্রক্রিয়ার দিক দিয়ে ভার্সাই চুক্তি ছিল শান্তির প্রতিকূল।