ভার্সাই সন্ধির শর্তাবলীর মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল।
"ভার্সাই চুক্তির শর্তাবলির মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল"-আলােচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : ভার্সাই চুক্তি আধুনিক কালের এক গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কমূলক বিষয়। জার্মান জাতি একে একটি 'Dictated Peace' বা বিজিতের উপর বিজেতার জবরদস্তিমূলক চাপানাে শান্তিচুক্তি, জার্মানির "সর্বস্ব হরণের চুক্তি এবং একটি 'বিরাট অপহরণ' বলে অভিহিত করেছিল। ফলে শুরু থেকেই জার্মানি এ চুক্তি অকার্যকর করতে নানা ধরনের টালবাহানা শুরু করে। পরবর্তীতে দেখা যায় যে, এ চুক্তি আর পুরােপুরি কার্যকরও হয়নি। ভার্সাই চুক্তি সম্পর্কে জার্মান জাতির চরম নেতিবাচক মনােভাবের জন্যই পরবর্তীকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতাে ভয়াবহ পরিস্থিতি ডেক আনে।
ভার্সাই চুক্তির শর্তাবলির মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল কিনা :
যে সকল কারণে বলা হয় যে, "ভার্সাই চুক্তির শর্তাবলির মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল" সেগুলো নিম্নরূপ :
১. তীব্র অসন্তোষ ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ :
ভার্সাই চুক্তিতে জার্মানির বিরুদ্ধে ইউরোপীয় শক্তিবর্গের ও ইউরােপীয় জনগণের তীব্র অসন্তোষ ও ঘৃণার সুস্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়। পরাজিত শত্রুর প্রতি শান্তি সম্মেলনের নেতৃবৃর্গ পূর্ব হতেই এরূপ বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন যে, শক্রর পতনের পর তার প্রতি অনুকম্পা, উপযুক্ত মর্যাদা, ন্যায় বা সভ্যতা প্রদর্শন করার প্রয়োজন তারা অনুভব করেন নি। শক্রর প্রতি এরূপ বিরুদ্ধ মনোভাব নিয়ে সন্ধিপত্র রচনা করতে গিয়ে ইউরােপীয় প্রতিনিধিগণ দূরদৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিতে পারেন নি।
২. ঘৃণা ও অসম্মান প্রদর্শন :
জার্মান প্রতিনিধিগণকে অপরাধীর ন্যায় প্রহরাধীনে শান্তি সম্মেলনের অধিবেশন কক্ষে নেওয়া হয় এবং সে অবস্থায় অধিবেশন শেষে বাইরে নিয়ে আসে। এরূপ অপমানজনক ব্যবহার করে অযথা জার্মান জাতির প্রতি ঘৃণা ও অসম্মান প্রদর্শন করা হয়েছিল। মিত্রপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নিতান্ত অনুদার ও প্রতিশােধাত্মক। জার্মান প্রতিনিধিগণ এরূপ প্রতিহিংসামূলক মনোবৃত্তি লক্ষ্য করেই মন্তব্য করেছিলেন, "আমরা জানি, আমাদের প্রতি কি পরিমাণে ঘৃণা বর্ষণ করা হচ্ছে।" সুতরাং জার্মান জাতির প্রতি প্রতিশােধাত্মক মনােভাব ও অযথা অপমানজনক ব্যবহার জার্মান জাতির মনে এক দারণ ঘৃণা ও বিদ্বেষের সৃষ্টি করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ জার্মান জাতির এই মনোভাবের মধ্যেই নিহিত ছিল।
৩. অর্থনৈতিক শােষণ :
ভার্সাই চুক্তির অর্থনৈতিক ও উপনিবেশিক শর্তগুলো ছিল অনুদার এবং অন্যায়মূলকভাবে জার্মানিকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পঙ্গু করে রাখার উদ্দেশ্যে তার উপনিবেশগুলো কেড়ে নেওয়া হয়। তার শিল্প ও খনিজ প্রধান অঞ্চলগুলােও কেড় নেওয়া হয়।
৪. ক্রটিপূর্ণ বণ্টন ব্যবস্থা :
জাতীয়তাবাদ ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের নীতির উপর ভিত্তি করে ইউরােপের পুনর্বন্টন করা হয়েছিল। কিন্ত এ জাতীয়তাবাদী নীতি সর্বত্র সমানভাবে অনুসরণ করা হয়নি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বােহেমিয়াতে পাভদের অধীনে অনেক জার্মান এবং ডালমেশিয়াতে বহু শ্লাভ ইতালির অধীনে থেকে যায়। দেখা যায় যে, পরবর্তীতে জার্মান সংখ্যালঘুরা পিতৃভূমিতে ফিরে.আসার জন্য দারুণ গােলযোগ সৃষ্টি করে। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ ভার্সাই চুক্তিতেই অঙ্কুরিত হয়।
৫. প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ :
ভার্সাই চুক্তিতে মিত্রপক্ষের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের পরিচয় পাওয়া যায়। কারণ জার্মানিকে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়ছিল তা প্রতিপালিত হয়নি। উইলসনের চৌদ্দ দফা নীতি অবলম্বনেও সন্ধিপত্র রচিত হয়নি । ভার্সাই চুক্তির বিরুদ্ধে এটাই ছিল জার্মানির প্রধান অভিযােগ । সমুদ্রের উপর সকল দেশের জাহাজগুলাের অবাধ চলাচলের নীতিও সর্বত্র সমভাবে প্রয়োগ করা হয়নি।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ভার্সাই চুক্তিতে জার্মানির প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানি তৎপর হয়ে উঠে এবং বিশ বছর পর জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে। আর তাই বলা যায়, "ভার্সাই চুক্তির শর্তাবলির মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল।"