ভার্সাই সন্ধির ধারা/শর্তসমূহ।

১৯১৯ সালের ভার্সাই সন্ধির ধারা বা শর্তসমূহ পর্যালোচনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : দীর্ঘ চার বছর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলার পর ১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসে জার্মানি বিনাশর্তে মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বিশ্বে পুনরায় শান্তি- শৃঙ্খলা স্থাপন, ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য ১৯১৯ সালে মিত্র শক্তির প্রতিনিধিগণ ফ্রান্সের ভার্সাই শহরে এক সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তিই ঐতিহাসিক ভার্সাই চুক্তি নামে পরিচিত। জার্মানিকে দোষী সাব্যস্ত করে আষ্টেপৃষ্ঠে শৃঙ্খলিত করার উদ্দেশ্যে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

ভার্সাই সন্ধি স্বাক্ষর :

১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে সন্ধিপত্র রচনার কাজ শুরু হয়। অনেক আলাপ-আলােচনা, তর্ক-বির্তকের পর ২০০ পৃষ্ঠা সম্বলিত খসড়া সন্ধিপত্র প্রস্তুত করা হয়। খসড়া চুক্তি তৈরির পর জার্মান প্রতিনিধিকে এর কপি দিয়ে লিখিত মন্তব্য রাখতে বলা হয়। এজন্য পনের দিন সময় দেওয়া হয়। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাউন্ট ফন ব্রকডর্ফ রান্টসাউ খসড়া চুক্তি হাতে পেয়ে উত্তেজিত হন। খসড়া চুক্তির উপর জার্মানির লিখিত মম্তব্য যথা সময়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সামান্য কিছু রদবদল করে মূল খসড়া চুক্তিটিকেই বহাল রাখা হয়। ১৯১৯ সালের ২৮ জুলাই রাজপ্রাসাদের হল অব মিরবে মিত্রশক্তির নেতৃবৃন্দ কর্তৃক গৃহীত শান্তিচুক্তি নামক একটি চুক্তিতে জার্মানি স্বাক্ষর দান করে। ইতিহাসে এটি ভার্সাই সন্ধি নামে পরিচি জার্মানির পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর দান করেন ড. হেরসান মুলার এবং ড. জোহান্সবেন।

ভার্সাই সন্ধির শর্তসমূহ :

ভার্সাই সন্ধিতে মূলত জার্মানিকে কোণঠাসা করার জন্য একতরফা শর্ত প্রদান করা হয়েছিল। নিম্নে ভার্সাই সন্ধির শর্তসমূহ আলােচনা করা হলাে :

(ক) পুনর্বন্টন সংক্রান্ত শর্তাদি : ভার্সাই সন্ধির শর্তানুযায়ী জার্মানি -

  1. ফ্রান্সকে আলসাস-লোরেন ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হলাে।
  2. বেলজিয়ামকে মরেসনেট, ইউপেন ও মেলমেডি দিতে বাধ্য হলাে।
  3. পােল্যান্ডকে পােজেনের অধিকাংশ এবং পশ্চিম প্রুশিয়া ছেড়ে দিতে হলাে।
  4. লিথুনিয়াকে মেমেল বন্দরটি ছেড়ে দিতে হলা।
  5. আফ্রিকার উপনিবেশসমূহ, চীন, শ্যাম, মিসর, মরক্কো, তুরস্ক, ডেনমার্কের শ্লেজভিগ প্রভৃতি স্থানের অধিকার ও সুযােগ-সুবিধা পরিত্যাগ করতে হলো এবং স্থির হলো এগুলাে স্বায়ত্তশাসনের উপযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত ব্রিটেন, ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের কর্তৃত্বাধীন থাকবে।
  6. উত্তর সাইলেশিয়া ও পূর্ব প্রুশিয়ার অধিবাসীগণকে গণভােটের সুযোগ দেওয়া হলাে। তারা যদি পােল্যান্ডের সাথে যুক্ত হতে চায় তবে ঐ স্থান দুটি পোল্যান্ডকে দিতে হবে।
  7. জার্মানির শিল্প ও খনিজ প্রধান অঞ্চল সার উপত্যকা পনের বছর ফ্রান্সের অধীনে থাকবে। পনের বছর পর সার উপত্যকার অধিবাসীগণ গণভোট দ্বারা তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে।
  8. পােলিশ করিডোর দিয়ে জার্মানিকে দ্বিখন্ডিত করা হলো।
  9. জার্মান অধ্যুষিত ডানজিগের শাসনভার জাতিপুঞ্জের হস্তে অর্পিত হলো।
  10. জার্মান সৈন্য অপসারণের ফলে বাল্টিক অঞ্চলে লিথুনিয়া, এসথেনিয়া, লাটভিয়া ও ফিনল্যান্ড প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হলো।

(খ) সামরিক শর্তাবলি : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যাবতীয় দায়ভার জার্মানির উপর চাপিয়ে দেওয়া হলাে। ভবিষ্যতে জার্মানি যাতে সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে সে জন্য নিম্নোক্ত শর্তাদি আরোপ করা হলো ;

  1. জার্মানির সৈন্য সংখ্যা শুধুমাত্র এক লক্ষ্যে নামিয়ে আনা হলাে এবং বাধ্যতামূলক সৈন্য সংগ্রহ বন্ধের নির্দেশ জারি করা হলাে।
  2. নৌবহরের সংখ্যা হ্রাস করা হলো এবং তার কিউন ও হেলিগােল্যান্ডর সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করে দেওয়া হলাে।
  3. যে সামান্য সংখ্যক সৈন্য জার্মানিকে রাখতে দেওয়া হলো তা শুধু অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে নিযুক্ত থাকবে বলে স্থির হলাে।
  4. রাইন নদীর তীরে ত্রিশ মাইলের মধ্যে যেসব দুর্গ বা সামরিক ঘাঁটি ছিল সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হলো এবং তা পনের বছর মিত্রশক্তির অধীনে রাখা হলাে।
  5. শর্তে স্থির হলাে জার্মানি কোনাে বিমানবহর রাখতে পারবে না এবং গােলাবারুদ উৎপাদনের পরিমাণ হাস করার আদেশ দেওয়া হলাে।
  6. এসব শর্ত পালন করা হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণের জন্য জার্মানির খরচেই মিত্রপক্ষের সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলো।

(গ) অর্থনৈতিক শর্তাবলি : অর্থনৈতিক দিক দিয়ে জার্মানিকে দুর্বল করার জন্য মিত্রশক্তি দূরভিসন্ধি করল। জার্মানির উপর নিম্নলিখিত শর্তাবলি আরােপ করা হলো :

  1. জার্মানির বাণিজ্য জাহাজের অধিকাংশ ফ্রান্স আত্মসাৎ করল। ২. সার অঞ্চলের কয়লা খনিগুলো ক্ষতিপূরণ হিসেবে ফ্রান্সকে ভোগ করতে দেয়া হলো।
  2. যুদ্ধের জন্য জার্মানির আর্থিক দন্ড করা হলাে ৫০০ কোটি ডলার সমমূল্যের স্বর্ণ বা অন্য মূল্যবান জিনিস, যা ১৯২১ সালের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে বলে স্থির করা হয়।
  3. আমদানি রপ্তানিতে জার্মানিকে ৫ বছরের জন্য মিত্রপক্ষকে সুযােগ দিত হলাে।
  4. বিদেশে জার্মান নাগরিকদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা মিত্রশক্তি লাভ করল।
  5. জার্মানি বেলজিয়াম ও ইতালিকে কয়লা সরবরাহ করতে বাধ্য থাকবে। তাহাড়া ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিভিন্ন দেশকে লৌহ ও রাবার সরবরাহ করার নির্দেশ দেওয়া হলো।

(ঘ) রাজনৈতিক শর্তাদি : রাজনৈতিক দিক থেকে জার্মানিকে দুর্বল করার জন্য নিম্নোক্ত শর্তাবলি আরোপ করা হয়,

  1. প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দায়িত্ব জার্মানিকে স্বীকার করতে বাধ্য করা হলো এবং যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য তাকে বাধ্য করা হলাে।
  2. আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করার জন্য জার্মানির কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়ামের বিচার দাবি করা হলো সাথে জার্মানির অন্যান্য নেতৃবর্গের আত্মসমপর্ণ দাবি করা হলো।
  3. জামানি কর্তৃক রাশিয়ার সাথে স্বাক্ষরিত ব্রেস্ট লিটভস্ক এর সন্ধি ও অপরাপর সন্ধিগুলাে বাতিল করা হলো।
  4. লীগ অব নেশনের শর্তাদিও ভার্সাই চুক্তির আন্তর্ভুক্ত করা হলো।
  5. আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার নীতির দ্বারা অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্য হতে চেকোশ্লোভাকিয়া ও যুগােশ্লাভিয়া নামে দুটি স্বাধানী প্রজাতন্ত্রের সৃষ্টি হলো। সেই সাথে পােল্যান্ড ও বেলজিয়ামের স্বাধীনতা স্বীকৃত হলা।

উপসংহার : নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘটনা, পরিস্থিতি এবং এ চুক্তির শর্তাবলি পর্যালােচনা করলে দেখা যায় এটি কোনােভাবেই সমর্থনযােগ্য ছিল না। এতে জার্মানির উপর যে জবরদস্তিমূলক শর্ত আরােপ করা হয়েছিল তার জন্য এটিকে শান্তিচুক্তি না বলে একটি বিরাট অপহরণ চুক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।কারণ ভার্সাই চুক্তি যে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের বীজ বপন করেছিল এটি সন্দেহাতীতভাবে সত্য।এর ফলে ইতিহাসের ভয়াবহতম যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ১৯৩৯ সালে সংঘটিত হয়।

Next Post Previous Post