স্পেনের গৃহযুদ্ধকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহড়া বলার কারণ।

স্পেনের গৃহযুদ্ধকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহড়া বলা হয় কেন?

উত্তর : ভূমিকা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পূর্বে সংঘটিত স্পেনের গৃহযুদ্ধ অন্তর্বর্তীকালীন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তৎকালীন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে এ গৃহযুদ্ধ উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে। এর কারণ হলাে ইউরোপের অধিকাংশ বৃহৎ শক্তি স্পেনের অভ্যন্তরে সংঘটিত এ ব্যাপারটির সাথে জড়িয়ে পড়ে এবং তাদের সক্রিয় হস্তক্ষেপ এ গৃহযুদ্ধের ফলাফলকে প্রভাবিত করে।

স্পেনীয় গৃহযুদ্ধকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহড়া বলার কারণ :

স্পেনের গৃহযুদ্ধকালীন সময় থেকেই ইউরােপীয় দেশগুলাে দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একপক্ষ স্পেনের প্রজাতান্ত্রিক সরকারের পক্ষ নেয় । অন্যপক্ষ জাতীয়তাবাদীদের পক্ষ নেয়। ফলে স্পেনের গৃহযুদ্ধ গণতান্ত্রিক ও একনায়কতন্ত্র সংঘর্ষে রূপান্তরিত হয়। ইউরোপীয় দেশগুলাের মধ্যে ইতালি, জার্মানি ও রাশিয়া প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে ফ্রান্স ও ব্রিটেন নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে। সকল দেশই নিজের প্রভাব বৃদ্ধির জন্য যুদ্ধে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে। স্পেনে গরিব কৃষক ও ধনী ভূস্বামী এবং সুবিধাভােগকারী যাজক শ্রেণীঅত্যাচারী অভিজাত সম্প্রদায় বিরাজ করছিল বলে রাশিয়া ঐ জায়গাকে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত ক্ষেত্র বলে বিবেচনা করতাে। সুতরাং স্পেনে যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হয় রাশিয়া তাকে স্বাগত জানায় এবং প্রজাতন্রের সমর্থকদের পক্ষাবলম্বন করে তাদের আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দিতে থাকে। অন্যদিকে ইতালি ও জার্মানি বিদ্রোহীদের পক্ষ নেয়। মুসােলিনি স্পেনের গৃহযুদ্ধের সুযােগ নিয়ে ফ্রাঙ্কোকে সাহাযা দানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করে ভূমধ্যসাগরে আধিপত্য বিস্তারে প্রয়াস পান। মুসোলিনি স্প্যানিশ মরক্কোর মাধ্যমে উত্তর আফ্রিকায় ফরাসি উপনিবেশে অনুপ্রবেশ করারও লক্ষ্য নেন। মুসোলিনির উদ্দেশ্য ছিল স্পেনে ফ্রাঙ্কোর একনায়কতন্ত্র স্থাপন করে ইতালির শত্রু ফ্রান্সকে বেষ্টন করা। হিটলারও ফ্রাঙ্কোকে সমর্থন করেন। কারণ তার নেতৃত্বে ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে একটি ফ্যাসিস্ট সরকার গঠিত হলে রাইনভূমি দখলের পর জার্মানির জন্য এর রণকৌশলগত ও কূটনৈতিক মূল্য হবে অনেক বেশি। জেনারেল ফ্রাঙ্কো হয়তো কৃতজ্ঞতাস্বরূপ জার্মানিকে প্রয়ােজনীয় কাঁচামাল যুগিয়ে যাবেন। এমনকি স্পেনের সমুদ্র তীরে জার্মান সাবমেরিনের জন্য ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ দেবেন। এছাড়াও বিদ্রোহীদের সমর্থন দানের পেছনে হিটলারের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল। তার সামরিক নেতৃবৃন্দকে তাদের নতুন অস্ত্রশস্ত্রের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখার সুযােগ দেওয়া যাতে তারা ভবিষ্যতে ঝটিকা অভিযানের জন্য সর্বোত্তম পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারে।

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বুঝ যায়, রাশিয়া, ইতালি ও জার্মানি প্রত্যেকেই নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী মনােভাবে স্পেনের গৃহযুদ্ধে জড়িয় পড়ে। প্রত্যকেই নিজের সীমানা ও প্রভাব বলয় বৃদ্ধির জন্য এ গৃহযুদ্ধকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করে। একই সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য ইউরোপীয় দেশকে কোণঠাসা করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। নিজেদের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দেয় স্পেনের গৃহযুদ্ধ থেকেই। দেখা যায় গৃহযুদ্ধ নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলাের মধ্যে স্বাক্ষরিত "হস্তক্ষেপ না করার চুক্তি" পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাসের জন্য ভেঙে যায়। ১৯৩৯ সালে ফ্রাঙ্কো প্রজাতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করার পর তিনি একটি মধ্যপন্থি নীতি গ্রহণ করেন। এদিকে ১৯৩৬ সালে হিটলার রাশিয়ার বিরুদ্ধে জাপানের সাথে "কমিনটার্ন বিরােধী চক্তিতে" আবদ্ধ হয়েছিলেন । ১৯৩৭ সালে ইতালি এ চুক্তিতে যোগদান করলে "রোম-বার্লিন-টোকিও অক্ষজোট" গডে উঠে। এভাবে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে স্পেনের গৃহযুদ্ধ চলাকালীনই এক নতুন শক্তিসাম্য গড়ে উঠে । যার ফলে বিশ্ব রাজনীতিরও রূপান্তর ঘটে। স্পেনের গৃহযুদ্ধ এ ইঙ্গিত দেয় যে, ইতালি ও জার্মানির আক্রমণাত্মক জাতীয়তাবাদী একনায়কতন্ত্র পরস্পরের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইউরোপের গণতান্ত্রিক সরকারগুলোকে পরাস্ত ও পর্যদুস্ত করতে বদ্ধপরিকর। ইতালি ও জার্মানির মধ্যে সম্পাদিত "রােম-বার্লিন অ্যাক্সিস" মোসুলিনি ও হিটলারের উচ্চাভিলাষের ইঙ্গিত ইউরোপে এক গভীর আশংকার সৃষ্টি করে। ইউরোপের গণতান্ত্রিক সরকারগুলাের দুর্বলতা মুসাোলিনি ও হিটলারকে যথাক্রমে আবিসিনিয়া ও অস্ট্রিয়ার ব্যাপারে দুঃসাহসিক অভিযানে প্রবৃত্ত হতে উৎসাহিত করে। মুসােলিনির আবিসিনিয়া অভিযান এবং হিটলারের অস্ট্রিয়া ও চেকোশ্লোভাকিয়া অভিযান ইউরােপে এক আন্তর্জাতিক সংঘর্ষ ও সংগ্রামের ক্ষেত্র রচনা করে।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, স্পেনের গৃহযুদ্ধের আপাত ফলাফল হলো প্রজাতান্ত্রীক সরকারের বিলুপ্তি ও ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে একটি প্রতিক্রিয়াশীল সমরবাদী রাজনীতির সাফল্য। কিন্তু স্পেনের গৃহযুদ্ধের প্রকৃত গুরুত্ব নিহিত ছিল স্পেনের বাইরে। স্পেনের গৃহযুদ্ধ ইউরোপে একটি যুদ্ধজনিত পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে প্রথম ইউরােপীয় সংঘাতের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। তাই স্পেনের গৃহযুদ্ধকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহড়া বলা হয়।

Next Post Previous Post