১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের গুরুত্ব

১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের গুরুত্ব ও ফলাফল আলােচনা কর।

ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে বিশেষ করে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৩৭ সালের নির্বাচন একটি যুগান্তকারী ঘটনা । কারণ ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিধান করা হলে বাংলাদেশের মুসলমান নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার সঞ্চার হয়। কেননা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগণ এর ফলে এ প্রদেশে রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা ও নিজেদের অবস্থার উন্নতির সুযোগ দেখতে থাকেন । ফলে ১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য তাদের মধ্যে বিপুল সাড়া পড়ে যায় ।

১৯৩৭ সালের নির্বাচন

১৯৩৭ সালে মার্চে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টি এ প্রধান তিনটি দল প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও বাংলায় মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরিণত হয়। নির্বাচনের ফলাফলের দেখা যায়, ২৫০টি মোট আসনের মধ্যে ১১৭টি সংরক্ষিত মুসলিম আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ ৩৫টি, প্রজা পার্টি ৩৬টি, ত্রিপুরা কৃষক সমিতি ৫টি এবং স্বতন্ত্র মুসলমান ৪১টি আসন পায়। সাধারণ আসনের মধ্যে কংগ্রেস পায় ৬০টি বাকি আসন পায় অন্যান্য দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।

১. প্রতিনিধিত্বশীল শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন

১৯৩৭ সালের নির্বাচন ছিল ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে ভারতবর্ষে প্রথম নির্বাচন। এই নির্বাচনের মাধ্যমে ভারতবর্ষে প্রতিনিধিত্বশীল শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।

২. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের প্রদেশ গুলোতে স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয়। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিধানকে বাস্তবরূপ দেওয়ার জন্যই ১৯৩৭ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠান করা হয়। ১৯৩৭ সালের এপ্রিল মাসে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন কার্যকর করা হয়।

৩. প্রাদেশিক দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে দায়িত্বশীল শাসন প্রবর্তনের কথা বলা হয়েছিল । ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে দায়িত্বশীল শাসন বাস্তবরূপ লাভ করে। কেননা এ নির্বাচনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সদস্যদেরকে তাদের কাজকর্মের জন্য দায়ি করার বিধান বা রীতি প্রতিষ্ঠিা করা হয়‌ । এর ফলে ভবিষ্যতে ভারতবর্ষের প্রদেশগুলোতে দায়িত্বশীল শাসন প্রতিষ্ঠার শুভ সূচনা হয়।

৪. নির্বাচন ব্যবস্থার প্রবর্তন

১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থার ভিত্তি রচিত হয়।

৫. সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার প্রয়োগ

১৯৩৭ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়েই ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম "সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার নীতি" সর্বপ্রথম কার্যকর হয়। এর ফলে ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হয়।

৬. গণতন্ত্রের ভিত্তি রচনা

১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক আইনসভার এ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের ভিত্তি রচিত হয়। কেননা সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ লাভ করে জনগণ।

৭. সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার

১৯৩৭ সালের এ নির্বাচনের পর পাঞ্জাব ও বাংলা ব্যতীত ভারতের অন্যান্য প্রদেশে কংগ্রেস সরকার গঠন করে। কংগ্রেস শাসিত এ সকল প্রদেশে কংগ্রেসী পতাকা উত্তোলন ও "বন্দে মাতরম" গাওয়া বাধ্যতামূলক করায় সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটে। এসব প্রদেশে মুসলমানদের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ করা হয়। এর ফলে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়।

৮. মুসলমানদের মধ্যে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার উন্মেষ

১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর কংগ্রেস শাসিত প্রদেশ গুলোতে মুসলমানদের প্রতি বিরূপ আচরণ তাদেরকে ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে সজাগ করে তোলে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এরপর তার বিখ্যাত "দ্বি-জাতি তত্ত্ব" বা Two Nation Theory উপস্থাপন করেন।

৯. শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি

১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর অবিভক্ত ব্রিটিশ বাংলায় শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের ও তার সংগঠন কর্তৃক "প্রজা পার্টি" এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। রাজনীতিতে শেরে বাংলার আবির্ভাব হবার আগে অবাঙালি মুসলিম জমিদার ,নবাব জমিদার ও ভূস্বামীদের দ্বারাই বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হতো। কিন্তু ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর ভোটাধিকার সম্প্রসারণের ফলে বাংলার রাজনীতিতে মুসলিম শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।

পরিশেষে বলা যায়, ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে গুরুত্ব ছিল অত্যাধিক । এর মধ্যে দিয়েই ভারতবর্ষে প্রতিনিধিমূলক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন, নির্বাচন ব্যবস্থার ভিত্তি রচনা, গণতন্ত্রের ভিত্তি রচনা, সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার প্রয়োগ প্রভৃতি গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটে।

Next Post Previous Post