ওয়ারেন হেস্টিংসের রাজস্ব সংস্কার
ওয়ারেন হেস্টিংসের রাজস্ব সংস্কার আলোচনা কর।
ক্লাইভ প্রবর্তিত দ্বৈতশাসন এবং ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ফলে বাংলার রাজস্ব তথা অর্থনৈতিক জীবনে যখন চরম নৈরাজ্য চলছিল তখন ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতার গভর্নর হয়ে আসেন। অতঃপর বিলাতের পরিচালক সভার নির্দেশানুসারে তিনি রাজস্ব সংস্কারে মনোনিবেশ করেন। রাজস্ব আদায়, রাজস্ব নিরপণ, রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। অতঃপর এক্ষেত্রে তিনি কিছু নিত্যনতুন সংস্কার সাধন করেন।
ওয়ারেন হেস্টিংসের রাজস্ব সংস্কার
ওয়ারেন হেস্টিংসের রাজস্ব সংস্কারের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে নিম্নে বিস্তারিতভাবে আলোচনা তুলে ধরা হলো
১. রাজস্ব নীতি নির্ধারণ
দেওয়ানের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর ওয়ারেন হেস্টিংস রাজস্ব বিষয়ক দুটি নীতি গ্রহণ করেন। প্রথমত, জমি নিলামে বন্দোবস্ত দিয়ে জমির সর্বোচ্চ রাজস্ব স্থির করা। দ্বিতীয়ত, আপাতত পাঁচ বছরের জন্যে নিলামদারকে বন্দোবস্ত দিয়ে রাজস্ব ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা আনয়ন করা। আর তা করেছিলেন রাজস্ব আদায়ের সমস্যা সমাধানের জন্য তার গঠিত ভ্রম্যমাণ কমিটির সুপারিশক্রমে।
২. বাের্ড অব রেভিনিট গঠন
হেস্টিংস গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহণ করেই তিনি নিজে ও তার কাউন্সিলের সদস্যদের নিয়ে একটি বোর্ড অব রেভিনিউ বা রাজস্ব পরিষদ গঠন করেন। এ পরিষদ রাজস্ব পরিচালনার পূর্ণ দায়িত্ব লাভ করে।
৩. কালেক্টরদের দায়িত্ব বণ্টন
হেস্টিংস কোম্পানির রাজস্ব আদায়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী যাদের এতদিন পরিদর্শক Supervisor বলা হতো তাদের নাম পরিবর্তন করে Collector-এ রুপান্তর করেন। Collector-দের উপর জেলার রাজস্ব আদায়, রাজস্ব সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ পরিচালনা এবং জমি নিলাম বন্দোবস্ত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। বাের্ড অব রেভিনিউ দ্বারা জেলা Collector-দের কাজকর্মের তদারক করার ব্যবস্থা করেন।
৪. কমিটি অব সার্কিট গঠন
রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য ওয়ারেন হেস্টিংস দেওয়ানি কোষাগার মুশির্দাবাদ থেকে কলকাতায় স্থানান্তর করেন। তাছাড়া বাের্ড অব রেভিনিউর কয়েকজন সদস্য নিয়ে একটি Committee of Circuit বা ভ্রাম্যমাণ কমিটি গঠন করেন । এ কমিটি জেলায় জেলায় ঘুরে কালেক্টরদের সাহায্যে জমির নিলাম বন্দোবস্ত করার দায়িত্ব লাভ করে।
৫. পাঁচসালা বন্দোবস্ত প্রবর্তন
রাজস্ব আদায়ের উপর্যুক্ত যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্নের পর হেস্টিংস ১৭৭২ সালে স্থির করেন যে, প্রতি জেলায় জমি নিলামে পাঁচ বছরের জন্য বন্দোবস্ত দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি সর্বোচ্চ হার দিতে রাজি হবে তাকেই পাঁচ বছরের জন্য জমি ইজারা দেওয়া হবে। এ নিলাম গ্রহীতাদের নাম দেওয়া হয় ইজারাদার।
৬. কালেক্টর প্রথা বিলােপ
কিছুদিন পর হেস্টিংস লক্ষ করেন, জেলার ইংরেজ কালেক্টররা দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন। তাছাড় তারা জমি নিলাম দেওয়ার সময় উৎকোচ ও উপঢৌকন নিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন এবং ব্যক্তিগত ব্যবসায়ের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনে লিপ্ত হচ্ছেন। এজন্য তিনি ইংরেজ কালেক্টরের পদ বিলুপ্ত করেন। তদস্থলে প্রতি জেলায় ভারতীয় নায়েব দেওয়ান নিয়োগ দেন।
৭. প্রাদেশিক কাউন্সিল গঠন
নতুন ভারতীয় নায়েব দেওয়ানদের রাজস্ব সংক্রান্ত কাজের তদারকির জন্য ছয়টি প্রাদেশিক কাউন্সিল গঠন করা হয়। এ ছয়টি প্রাদেশিক কাউপিল কলকাত, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, দিনাজপুর ও পাটনায় স্থাপিত হয়। প্রাদেশিক কাউন্সিলরদের কার্যে সহায়তা করার জন্য একজন করে দেশীয় দেওয়ান নিযুক্ত করেন ।
৮. আমিনী কমিশন গঠন
চড়া মূল্যে নিলাম ধরে একদিকে নতুন ও পুরাতন জমিদাররা সর্বশান্ত হয়ে যায়, অন্যদিকে কোম্পানির কর্মচারীদের দুর্নীতির কারণে পাঁচসালা বন্দোবস্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এমতাবস্থায় হেস্টিংস ভূমি রাজস্ব সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য ১৭৭৬ সালে আমিনী কমিশন গঠন করেন। এ কমিশনকে জমির সঠিক রাজস্ব কি হওয়া উচিত এবং জমি কিভাবে বন্দোবস্ত দেওয়া উচিত সে সম্পর্কে তদন্ত করে তথ্য দিতে বল হয়।
৯. একসালা বন্দোবস্ত প্রবর্তন
১৭৭৭ সালে পাঁচসালা বন্দোবস্তের মেয়াদ শেষ হলে হেস্টিংস এটি রদ করেন এবং পরীক্ষামূলকভাবে একসালা বন্দোবস্ত চালু করেন। এ বন্দোবস্তে হেস্টিংস যে নীতি অনুসরণ করেন তা ছিল নিম্নরূপ
- প্রথমত, একসালা বন্দোবস্ত অনুযায়ী ইজারাদারদের বাদ দিয়ে পুরাতন জমিদারদেরকেই জমি প্রতিবছর বন্দোবস্ত দেওয়ার নীতি প্রবর্তন করেন।
- দ্বিতীয়ত, গত তিন বছরের রাজস্বের গড় নির্ধারণ করে সেই হারে একসালা বন্দোবস্তে রাজস্ব আয়ের ব্যবস্থা করা হয়।
- তৃতীয়ত, জমিদাররা সময়মতো রাজস্ব প্রদান করলে পরের বছর তাদেরই জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেন।
- চতুর্থত, কোনো জমিদার রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হলে তার জমিদারির একাংশ বিক্রি করে রাজস্ব পরিশোধের নিয়ম চালু করেন।
- পঞ্চমত, প্রতিটি জেলায় পুনরায় ইংরেজ কালেক্টর নিয়ােগ করেন। তাদের সাহায্য করার জন্য দেশীয় কানুনগো নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। ১৭৭৭ থেকে ১৭৮৯ সাল পর্যন্ত একসালা বন্দোবস্ত চালু থাকে
- ষষ্ঠত, একসালা বন্দোবস্ত একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে প্রচলিত হয়েছিল।
পরিশেষে বলা যায় যে, ওয়ারেন হেসিটংসের রাজস্ব সংস্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।কোম্পানির রাজস্ব বৃদ্ধিকল্পে তিনি সর্বাত্মক প্রয়াস চালান। যদিও হেস্টিংস পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা একটি স্থায়ী ভূমি রাজস্ব নীতি গঠনের চেষ্টা করেন । কিন্তু তার পাঁচসালা ও একসালা বন্দোবস্তের হার বেশি হওয়ায় রাজস্ব বহুল পরিমাণে অনাদায়ী থেকে যায় এবং রায়ত চাষিদের উপর শোষণ বৃদ্ধি পায়।