১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাব
১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল-আলোচনা কর।
১৯৪০ সালে লাহাের প্রস্তাব গ্রহণ ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ ঘটনা। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। লাহাের প্রস্তাবের গুরুত্ব সম্পর্কে ড. লালবাহাদুর শাস্ত্রী বলেন, স্যার সৈয়দ আহমেদের সময় লাহাের প্রস্তাব ছিল মুসলমানদের জাগরণ ও আশা-আকাঙ্কার সর্বোচ্চ বাহিঃপ্রকাশ। ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল কি-না?
১. পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি :
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু লাহাের প্রস্তাব জাতি হিসেবে ভারতের অখন্ডতাকে অস্বীকার করে এবং ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে পৃথক পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানায়।
২. স্বার্থের দ্বন্দ্ব শুরু :
কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে সম্প্রদায়িক স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকলেও এতদিন উভয় দল মােটামোটি ঐক্যবদ্ধভাবে অখণ্ড ভারতের স্বায়ত্তশাসন তথা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে। অথচ ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে সেই অখন্ড ভারতের চেতনাকে অস্বীকার করা হয়।
৩. মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি :
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি করে।
৪. নির্বাচনে ব্যাপক জনসমর্থন :
১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগ যেখানে মোট ৪৮৫টি মুসলিম আসনের মধ্যে ১০৯টি আসন লাভ করে, সেখানে ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের পর ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে এ দল মােট ৪৯২টি আসনের মধ্য লাভ করে ৪২৮টি আসন।
৫. হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা :
১৯৪৬ সালের নির্বাচনের পর পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে মুসলিম লীগ ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট 'প্রত্যক্ষ সংগ্রাম' দিবস পালন করে। সেদিন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে এবং পরবর্তীকালে এ দাঙ্গা বাংলা বিহারের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে।
৬. হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি :
হিন্দু মুসলিম সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটতে থাকে। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ উপলব্ধি করেন যে, অখন্ড ভারতে হিন্দু-মুসলিম সহঅবস্থান প্রায় অসম্ভব এবং তারা ভারত বিভাগে সম্মত হয়। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহের সমন্বয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়।
৭. বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভিত্তি :
লাহাের প্রস্তাব শুধু পাকিস্তানের ভিত্তি ছিল না, এটি পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেরও অন্যতম ভিত্তি। লাহাের প্রস্তাবে শুধু মুসলমানদের জন্য একাধিক রাষ্ট্র গঠনের দাবি করা হয় নি, বরং এর অন্যতম প্রধান দাবি ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ।
৮. ভাষা আন্দোলন :
ভাষা জাতির প্রাণ। ভাষা ছাড়া মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না। ভাষার দাবিতে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয় । ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালিদের অধিকার আদায় হয়। লাহাের প্রস্তাবের মধ্যে দিয়ে বাঙালি জাতির মধ্যে যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয় ভাষা আন্দোলনে তার যথার্থ প্রতিফলন ঘটে।
৯. ১৯৬৬ সালের ছয় দফা কর্মসূচি :
১৯৬৬ সালের ছয় দফা কর্মসূচিতে লাহাের প্রস্তাবের সরাসরি উল্লেখ রয়েছে। ছয় দফায় উল্লেখ করা হয় যে, ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। তাই বলা যায় যে, লাহার প্রস্তাবে বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল।
১০. ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন :
১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়, যার মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করে লাহাের প্রস্তাবে উত্থাপিত অঙ্গরাজ্যগুলোর স্বায়ক্তশাসন ও সার্বভৌমত্বের দাবি। এ স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণত হয়।
১১. স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা :
লাহাের প্রস্তাবের মূলধারাকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, লাহাের প্রস্তাবের মধ্যেই বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল। মূল লাহাের প্রস্তাবে পরিষ্কার বলা হয়েছিল, ভারতের উত্তর-পশ্চিম, উত্তর-পূর্বাঞ্চল নিয়ে স্বাধীন 'রাষ্ট্রসমূহ' গঠিত হবে। লাহাের প্রস্তাবের উদ্যোক্তাগণ আসলে সে সময় দুটি মুসলিম রষ্ট্র স্থাপনের কথাই চিন্তা করেছিলেন। একটি হবে পূর্ববাংলা ও আসাম নিয়ে এবং অপরটি হবে সিন্ধু, পাঞ্জব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদশ ও বেলুচিস্তান নিয়ে। লাহাের প্রস্তাবের উপস্থাপক শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক বলেছিলেন, বাংলার শাসনক্ষমতা বাঙালি মুসলমানদের হতে এসেছে।পরে এ কথা নিয়ে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। মি. জিন্নাহ ঘোষণা করেন যে, ভারতে একটিমাত্র মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। তখন মি. জিন্নাহর ব্যক্তিত্ব এবং বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে তার এ কথার বিরোধিতা করা কোনাে নেতার পক্ষেই সম্ভব হয় নি। ফলে ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের এক অধিবেশনে মূল লাহাের প্রস্তাবের "রাষ্ট্রসমূহ" কথাটি বাতিল করে "একটি রাষ্ট্র" গঠনের কথা ঘােষণা করা হয়। যদিও আবুল হাশিমসহ অনেক নেতা এর বিরোাধিতা করেন, কিন্তু কার্যকর কোনো কিছু করত তারা ব্যর্থ হন। ফলে পূর্ববাংলা ও আসাম নিয়ে যে রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা এ অঞ্চলের মুসলিম নেতারা গ্রহণ করেছিলেন, তা আপাতত পাকিস্তান আন্দালনের তীব্রতায় চাপা পড়ে যায়। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই স্বাধীনতার স্পৃহায় লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন দাবি জোরদার হয়ে উঠে এবং কালক্রমে তা স্বাধীন বাংলাদেশের রূপ দেয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী প্রথম আঘাত হানে পূর্ববাংলার ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর। পূর্ববাংলায় মাতৃভাষার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন ও গণআন্দেলন এসবই লাহাের প্রস্তাবভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা এক একটি তীব্র প্রতিবাদ । সুতরাং মহান ভাষা আন্দোলন হতে শুরু করে উল্লিখিত আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়েই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই বলা যায়, লাহাের প্রস্তাবের মধ্যেই স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল। সেদিন তথা ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টে যদি আমরা এ দ্বিখন্ডিত বাঙলার এক খন্ডে স্বাধীন হতাম ১৯৪০ সালের পাকিস্তান প্রস্তাবের রূপায়ণে বা বাস্তবায়নে, তা হলে আমাদের ভাষাসংগ্রাম করতেই হতাে না। এবং ১৯৭১ সালেও করতে হতাে না লক্ষ লক্ষ জান দিয়ে ও মা-বােনের ইজ্জতের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে । ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাব ছিল স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জল একটি আদর্শ দলিল। এ প্রস্তাবের মধ্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল। কেননা ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। এ প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত না হলে অখণ্ড ভারতের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হয়ত সম্ভব হতো না। তাই এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের মধ্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল।