উড্রো উইলসনের চৌদ্দ দফা

উড্রো উইলসনের চৌদ্দ দফার বিবরণ দাও।

মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্বপ্রথম যে বীভৎস ও ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয় তা হলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ১৯১৪ সাল থেকে যুদ্ধটি শুরু হলেও ১৯১৮ সালের ৫ অক্টোবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের মধ্যস্থতায় জার্মানি ও তার মিত্ররাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির প্রার্থন জানায়। ১৯১৮ সালের জানুয়ারি মাসে মার্কিন কংগ্রেসে প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন বিখ্যাত চৌদ্দ দফা সংবলিত যে শান্তি প্রস্তাব উত্থাপন করেন তার ভিত্তিতেই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। যুদ্ধ সমাপ্তির অব্যবহিত পরে বিজয়ী রাষ্ট্রগুলো বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রের পুনর্বিন্যাসের জন্য প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে যে একাধিক শান্তিচুক্তি সম্পাদন করে তার প্রধান ভিত্তিই ছিল উইলসনের চৌদ্দ দফা

উড্রো উইলসনের চৌদ্দ দফা :

১.গোপন চুক্তি পরিহার :

বিভিন্ন দেশের মধ্যে খোলাখুলিভাবে চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে। এভাবে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনো গোপন চুক্তির অবকাশ থাকবে না; কূটনীতি প্রকাশ্যে ও অকপটভাবে চলতে থাকবে।

২. নৌ-চলাচলের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা :

যুদ্ধ ও শান্তির সময় নির্বিশেষে রাষ্ট্রীয় সীমানা বহির্ভূত সমুদ্র এলাকায় যেকোনাে দেশের নৌ-চলাচলের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা থাকবে। অবশ্য আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে কোনাে রাষ্ট্রকে এ অধিকার থেকে বঞ্চিতও করা যেতে পারে।

৩. অর্থনৈতিক অগ্রগতি :

সম্ভাব্য সকল উপায়ে অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে যাবতীয় বাধা-নিষেধ অপসারণ করতে হবে। অধিকন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার সমতা বিধান করতে হবে।

৪. অতিরিক্ত অস্ত্র পরিহার :

কোনো রাষ্ট্রই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রয়ােজনের অতিরিক্ত অস্ত্রশস্ত্র রাখতে পারবে না।

৫. জনসাধারণের স্বার্থ রক্ষা :

পরিপূর্ণ নিরপেক্ষতার সাথে সকল দেশের ঔপনিবেশিক দাবির সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে এবং তা করতে গিয়ে উপনিবেশগুলাের জনসাধারণের স্বার্থের প্রতিও সমান গুরুত্ব দিতে হব।

৬. রুশ অঞ্চল থেকে সৈন্য প্রত্যাহার :

অধিকৃত রুশ অঞ্চল থেকে কেন্দ্রীয় শক্তিভুক্ত দেশগুলাের সৈন্য অপসারণ করতে হবে।

৭. বেলজিয়ামের স্বাধীনতা প্রদান :

বেলজিয়াম থেকে বৈদেশিক সৈন্যবাহিনী অপসারণ করতে হবে এবং বেলজিয়ামকে তার হৃত স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে হবে।

৮. ফ্রান্সের নিরাপত্তা :

ফরাসি দেশ থেকে বিদেশি সৈন্যবাহিনী অপসারণ করতে হবে ও আলসেস-লােরেন অঞ্চল ফ্রান্সকে প্রত্যর্পণ করতে হবে।

৯. ইতালি সংক্রান্ত বিষয় :

ইতালীয় সীমান্তে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের ভিত্তিতে ইতালি সীমান্তের পুনর্বিন্যাস করতে হবে।

১০. অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় বিষয় :

অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের জনসাধারণকে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার অবাধ সুযােগ দিতে হবে।

১১. রুমানিয়া, সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রো :

রুমানিয়া, সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রো থেকে বিদেশি সৈন্য অপসারণ করতে হবে ও সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন সার্বিয়ারি যোগাযােগ ব্যবস্থার অসুবিধা দূর করার জন্য সমুদ্রে তীরবর্তী কোনাে একটি অঞ্চল তার অধিকারে ছেড়ে দিতে হবে।

১২. তুর্কি সংক্রান্ত বিষয় :

ওসমানীয় সাম্রাজ্যের তুর্কি অধ্যুষিত অঞ্চলের সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। কিন্তু তুর্কি শাসিত অন্যান্য জাতিকে স্বায়ত্তশাসনের নিরঙ্কুশ সুযােগ দেওয়া হবে। দার্দানেলিস প্রণালিকে আন্তর্জাতিক জলপথের মর্যাদা দেওয়া হবে।

১৩. পােল্যান্ড বিষয় :

পােল অধ্যুষিত বিভিন্ন অঞ্চলের সমন্বয়ে স্বাধীন পােল্যান্ড রাষ্ট্র স্থাপন করে তার জন্য সমুদ্রপথের ব্যবস্থা করত হবে।

১৪. সকল রাষ্ট্রের সমন্বয়ে বিশ্ব সংস্থা গঠন :

ছােট বড় সকল রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখন্ডতার নিশ্চয়তা বিধানের উদ্দেশ্যে সুনির্দিষ্ট চুক্তির ভিত্তিতে একটি বিশ্ব সংস্থা গঠন করতে হবে।

পরিশেষে বলা যায় যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের বিখ্যাত চৌদ্দ দফা ছিল প্রলয়ঙ্কারী ও ভয়াবহ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানকল্পে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ । অধিকন্তু তার চৌদ্দ দফা বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং এই লক্ষ্যে বিশ্বসংস্থা প্রতিষ্ঠার পক্ষ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই দিক থেকে উইলসনের চৌদ্ধ দফার গুরুত্ব ছিল অনস্বীকার্য।

Next Post Previous Post