ওহাবি আন্দোলন ও এর প্রকৃতি।
বাংলায় ওহাবি আন্দোলন ও এর প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : বাংলার মুসলিম সমাজের নবজাগরণের ইতিহাসে একটি ওরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল ওহাবি আন্দোলন। পাটনা ছিল ওহাবিদের মুখ্য প্রচার কেন্দ্র। বাংলা ও বিহার ছিল নিয়ােগ কেন্দ্র এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ছিল তাদের কর্মক্ষেত্র। বাংলায় ওহাবি আন্দোলনের প্রধান নায়ক ছিলেন তিতুমীর। তিনি সমাজ থেকে সর্বপ্রকার দুর্নীতি, অত্যাচার, নিপীড়ন ও শোষণ দূর করার নিমিত্তে বজ্রকঠিন শপথে উদ্দীপ্ত হন। এজন্য তিনি বাংলায় ওহাবি আন্দোলন গড়ে তোলেন। এই ওহাবি আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি শোষক জমিদার ও ইতিহাসের জঘন্যতম অত্যাচারী ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
বাংলায় ওহাবি আন্দোলন :
তিতুমীর মক্কায় সৈয়দ আহমদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করার পর বাংলায় ওহাবি আদর্শ
প্রচার শুর করেন। এক্ষেত্রে তিনি হায়দারপুর থেকে ওহাবি সংস্কার আন্দালন শুরু করেন । তিতুমীরের ওহাবি আন্দোলন প্রথমে ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এটি রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে। তিতুমীরের বাংলার ওহাবি আদর্শের মূলকথা ছিল ইসলামের শুদ্ধিকরণ। এজন্য তিতুমীর প্রচার করেন যে–
(ক) পীর-পয়গম্বর মানা যাবে না।
(খ) মন্দির-মসজিদ তৈরি করা যাবে না ।
(গ) যায়তা বা শ্রাদ্ধ শান্তি পালন করা যাবে না।
(ঘ) সুদে টাকা খাটানো যাবে না।
(ঙ) পীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানাে যাবে না
এবং দরগা নির্মাণ করা যাবে না।
(চ) ওহাবি ধর্মশাস্ত্রের শিরাত-ই-মুস্তাকিন মান্য করতে হবে।
(ছ) ওহাবি অনুসারীদের এক বিশেষ ধরনের দাড়ি রাখতে হবে।
(জ) মুসলমান ছেলেমেয়েদের হিন্দুয়ানি নাম রাখা যাবে না।
(ঝ) তার আন্দোলনের নাম হবে 'শরীয়ত-ই-মহম্মদী'।
এই আদর্শের ভিত্তিতে তিতুমীর বাংলায় ওহাবি আন্দোলনের বিস্তার করেন। বাংলায় তিতুমীরের ওহাবি শিষ্যদের মধ্যে জোলা ও রায়ত চাষিরাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। কেননা বিলেতি কাপড়ে আমদানির ফলে বাংলার জোলা বা তাঁতিরা কর্মহীন ও বেকার হয়ে যান । ফলে এই শ্রেণী তিতুমীরের মধ্যে তাদের সমস্যার সমাধানের ইঙ্গিত খুঁজে পান। কৃষক বা রায়তরা ছিল শাষিত। যে কারণে তারাও তিতুমীরের ওহাবি আন্দোলনের মধ্যে শােষণ থেকে মুক্তির সম্ভাবনা অনুভব করেন। কারণ তিতুমীর প্রচার করেন যে, ইংরেজরা মুসলমানদের নিকট থেকে ভারতবর্ষের ক্ষমতা নিয়ে ভারতবর্ষকে একটি 'দার-উল-হারাব' -এ পরিণত করেছে। তাই ওহাবিদের লক্ষ্য হলো ইংরেজদের বিতাড়নের মাধ্যমে ভারতবর্ষকে "দার-উল-ইসলাম" এ পরিণত করা।
তিতুমীর তার ওহাবি আন্দোলনের মাধ্যমে ঘোষণা দেন যে, বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির রাজত্বের অবসান হয়েছে এর ফলে ওহাবি বিরোধী জমিদারগণ ওহাবি সম্প্রদায়কে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে সংঘবদ্ধ হয়। এই সময় ওহাবি বিরোধী জমিদারদের সঙ্গে এই অঞ্চলের নীলকুঠির সাহেবগণও যোগদান করেন। মােল্লাহাটির নীলকুঠির ম্যানেজার ডেভিড তাদের সৈন্য সামন্ত নিয়ে তিতুমীরকে আক্রমণ করেন। এ যুদ্ধে জমিদারবৃন্দ ও ডেভিডের মিলিত বাহিনী তিতুমীরের বাহিনীর নিকট সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়। এ যুদ্ধে পরাজিত অত্যাচারী শাসক শােষকদেরকে আশ্রয়দান করায় তিতুমীর প্রায় ৫০০ লাঠিয়াল নিয়ে গোবরা গোবিন্দপুর গ্রামের জমিদার দেবনাথ রায়কে আক্রমণ করেন । দেবনাথ রায়ও লাঠি, সবকি, তরবারি ও বন্দুকে সজ্জিত বহু লোক নিয়ে তিতুমীর বাহিনীর গতিরোধ করেন। দেবনাথ স্বয়ং অশ্ব আরোহণ করে তরবারি হতে বীরের মতাে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে তিতুমীরের বাহিনীর কয়েকজন হতাহত হলেও জমিদার দেবনাথ রায় পরাজিত ও নিহত হন এবং তার বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এ যুদ্ধে তিতুমীরের শক্তি বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। প্রায় ১০০০ মুসলমান যুবক লাঠি, তরবারি, বল্লম দ্বারা সজ্জিত করে তিতুমীর তার বাহিনীকে সর্বদা যুদ্ধের জন্য প্রস্তত রাখেন। গ্রামাঞ্চলেব অত্যাচারী তালুকদার, মহাজন নীলকুঠির সাহেবগণ এবং ওহাবি বিরোধী ধনী মুসলমানগণকে উচিত শিক্ষ প্রদানের সিন্ধান্ত গ্রহণ করেন। এদের নিকট তিনি রাজস্ব দাবি করেন এবং রাজস্ব না দিলে কঠোর শক্তি প্রয়ােগ হবে বলে ঘোষণা দেন। এ ঘােষণা শোনামাত্র নদীয়া জেলা ও ২৪ পরগনা জেলার বারাসাত অঞ্চলের বহু গ্রামের তালুকদার মহাজন ও ধনী মুসলমান ইতস্তত পলায়ন করতে থাকেন। তিতুমীর এসব অঞ্চলের বিভিন্ন জমিদার অধীনস্থ হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের প্রজাগণকে জমিদারদের প্রদেয় খাজনা বন্ধ করার নির্দেশ দেন। তিতুমীরের নির্দেশ পেয়ে অধিকাংশ প্রজা জমিদারদের খাজনা প্রদান বন্ধ করে দেন। এভাবে বাংলায় তিতুমীর তার ওহাবি আন্দোলন পরিচালনা করেন।
তিতুমীরের ওহাবি আন্দোলনের প্রকৃতি :
তিতুমীরের ওহাবি আন্দোলনের প্রকৃতি নিম্নে তুলে ধরা হলো :
সমকালীন লেখক বিহারীলাল সরকার তিতুমীরের ওহাবি আন্দোলনকে 'ধর্মোন্মাদ মুসলমানদের কান্ড এবং হিন্দু বিরােধী কান্ডরূপে দেখেছেন।'
ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মতে, ওহাবি আন্দোলন ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর মুসলিম সম্প্রদায়ের আক্রমণ।
ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, তিতুমীরের আন্দোলন ছিল নিছুক সাম্প্রদায়িক মুসলমদের আন্দোলন। এটি ছিল মুসলিমদের জন্য, মুসলিমদের দ্বারা, মুসলিম কর্তৃক আন্দোলন।
ড. অভিজিত দত্ত বলেছেন যে, ওহাবি আন্দোলন ছিল সামজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় ভাবধারার সমান্তরাল আন্দোলন। তিনি তীতুমীরের আন্দোলনকে হিন্দু বিরোধী ও সাম্প্রদায়িক আন্দোলন রূপে চিহ্নিত করেছেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলায় তিতুমীরের ওহাবি আন্দোলন ছিল একটি উল্লেখযােগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন। ওহাবি আন্দোলন ছিল জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের শ্রেণীসংগ্রাম। তবে তিতুমীর প্রথমদিকে ইংরেজ বিরােধী না হলেও পরবর্তীতে ইংরেজ বিরোধী হন। তিতুমীর নিজেকে বাদশাহ বলে ঘােষণা করেন। সুতরাং বলা যায় যে, ওহাবি আন্দোলন কথক বিদ্রোহ ছাড়াও ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম। তিতুমীর সকল শ্রেণীর কৃষককে তাঁর পক্ষে আনতে সক্ষম না হওয়ায় তার বিদ্রোহ শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। কেননা তিনি মধ্যযুগের আদর্শ অনুসারে একটি মুসলিম রাজত্ব স্থাপনের কথা ভাবেন। যে কারণে সকল শ্রেণীর মুসলমান তার পক্ষে ছিলেন না। যার ফলশ্রুতিতে তার ওহাবি আন্দোলন ব্যর্থ হয়।