বাংলায় জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ।
বাংলায় জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ও বিকাশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার কতটা সহায়ক হয়েছিল?
উত্তর : ভূমিকা : উনিশ শতক ছিল মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক সৃষ্টিশীল চিন্তাধারা ও আবিষ্কারের যুগ। এ শতকে ইউরোপে যে উদারনৈতিক চিন্তাধারা, জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র বিকাশ লাভ করে তার ঢেউ ভারতীয় উপমহাদেশেও অনুভূত হয়। আর এ শতকে উপমহাদেশের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলাে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ। এক্ষেত্রে যে সমস্ত উপাদান সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল তন্মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব ও প্রসার ছিল সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। ভারতবাসী সর্বপ্রথম পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ, ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রভৃতি দৃষ্টিভঙ্গির আঙ্গিকে নিজেদেরকে উদ্ভাসিত করে তুলতে সচেষ্ট হয়।
বাংলায় জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ও বিকাশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব :
উপমহাদেশে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ও বিকাশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। নিম্নে ভারভীয় উপমহাদেশে জাতীয়তাবাদের উন্মেষে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার কতটা সহায়ক হয়েছিল তা উল্লেখ করা হলো :
১. আত্মসচেতনতা সৃষ্টি : ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার ফলে বাঙালি তথা ভারতবাসী আত্মসচেতন হয়ে উঠে এবং পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতবাসী পাশ্চাত্য সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি ও বিজ্ঞান বিষয়ে সম্যক জ্ঞান লাভের জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠে। ভারতবাসী প্রথমে নিজেদের ধর্মীয় ও সামাজিক ক্রটি- বিচ্যুতি ও ক্রমে ক্রমে ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র সম্পর্কে সচেতন হয় উঠে। এ সচেতনতাই তাদের মধ্যে নবজাগরণের সৃষ্টি করে । আর এ নবজাগরণের প্রভাবে তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে।
২. নতুন যুগের সূচনা : ভারতে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের ফলে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। ইংরেজি ভাষা সকল শিক্ষিত ব্যক্তির ভাব প্রকাশের মাধ্যমে পরিণত হয়। এ সময় ইংরেজি শিক্ষা লাভই উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষের ক্ষমতা, মর্যাদা ও ধনসম্পদ অর্জনের একমাত্র পথ বলে বিবেচিত হয়। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরা লক, রুশাে, ভলতেয়ার, গ্যারিবল্ডি, এন্ডমন্ড বার্ক প্রমুখ মনীষীর রাজনৈতিক দর্শন পড়ে গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়।
৩. সহজ ভাব বিনিময় : ভারতীয় জনগণের জাতীয়তাবোধের বিকাশ সাধনে ইংরেজি ভাষা তাৎপর্যপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। ইংরেজি শিক্ষা সকল উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রবর্তিত হলে ভারতের সকল অঞ্চলের মানুষ একে অন্যের সাথে সহজেই ভাব বিনিময় করতে সক্ষম হয়। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত নেতৃবৃন্দ তাদের পারস্পরিক ভাব বিনিময়ে এবং তাদের বিভিন্ন সভা-সমিতি পরিচালনায় এ ভাষাকে সহজেই গ্রহণ করতে পেরেছিলেন। এক ও অভিন্ন ভাষা না থাকলে বহু ভাষাভাষী অধ্যুষিত ভারতবর্ষের মানুষের পক্ষে জাতীয়তাবােধ সৃষ্টি করা কঠিন ছিল ।
৪. গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী চিন্তার জাগরগ : ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে ইউরোপীয় রাজনীতি, অর্থনীতি ও ইউরোপের জাতীয়তাবাদী আদর্শ ও তার প্রসার সম্বন্ধে শিক্ষিত ভারতবাসী জ্ঞান লাভ করে। ফলে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতবাসীর মধ্যে আধুনিক যুগোচিত যুক্তিবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী চিন্তা জাগ্রত হয়।
৬. যুক্তিবাদী শিক্ষিত শ্রেণীর সৃষ্টি : পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের সাথে সাথে শিক্ষিত ভারতীয়রা ইউরোপের ইতিহাস, ঐতিহ্য, পাশ্চাত্য দর্শন ও সমসাময়িককালের জ্ঞান-বিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জন করে। এর ফলে ভারতে এক যুক্তিবাদী শিক্ষিত শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে। এ যুক্তিবাদী শিক্ষিত শ্রেণী ছিলেন নবজাগরণের অগ্রদূত। তাদের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়েই ভারতে জাতীয়তাবাদের চেতনা জাগ্রত হয়।
৬. যােগসূত্রের ভূমিকা পালন : পাশ্চাত্য শিক্ষা ভারতবাসীর মধ্যে ঐক্য স্থাপনে যোগসূত্রের ভূমিকা পালন করে। ফলে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণের কারণে শিক্ষিত ভারতীয় সমাজের মধ্যে ঐক্যবোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সমতা আসে । ইংরেজরা সর্বভারতে একই ধরনের শিক্ষাপদ্ধতি প্রচলন রেখেছিল। একই ধরনের শিক্ষাপদ্ধতির কারণে ছাত্রদের মধ্যে একই ধরনের অর্থনৈতিক জ্ঞান বিস্তার লাভ করে। এর ফলে ভারতের সর্বত্রই শিক্ষিত সমাজের মতামত, অনুভূতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আদর্শ একই ধারায় গড়ে উঠতে থাকে। পরবর্তীতে এধরনের জ্ঞান লাভের কারণে ভারতবাসীর মনে জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ ঘটে।
৭. রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি : ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন হলে ভারতীয় জনগণের মনে আধুনিক রাজনৈতিক চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ ঘটে। ফলে ভারতীয় জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি হয়। এ রাজনৈতক সচেতনতা তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাগ্রত করে।
৮. ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের আদর্শের প্রভাব : ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে ইউরোপীয় রাজনীতি, অর্থনীতি ও ইউরোপের জাতীয়তাবাদের আদর্শ ও এর প্রসার সম্বন্ধে শিক্ষিত ভারতবাসী জ্ঞান লাভ করে । উনিশ শতকের শেষার্ধে ইউরোপে বিশেষ করে ইংল্যান্ডে উদারনীতিবাদের চরম বিকাশ ঘটে । মিল্টন, মিল, বেন্থাম প্রমুখ মনীষীর রচনা শিক্ষিত ভারতবাসীকে গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে তোলে।
৯. নেতৃত্ব সৃষ্টি : আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা তথা পাশ্চাত্য শিক্ষা দ্বারা সুশিক্ষিত ভারতীয় সমাজ পাশ্চাত্য চিন্তাধারার সাথে পরিচিতি লাভ করে এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে আধুনিক ভাবধারা তথা আধুনিক যুগোচিত যুক্তিবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিল। সুতরাং দেখা যায় উপমহাদেশে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ও বিকাশে পাস্চাত্য শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
১০. জ্ঞানী-গুণী ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের জন্ম : পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এ দেশে নব্য শিক্ষিত ভারতীয়দের মধ্য থেকে একশ্রেণীর জ্ঞানী-গুণী ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। এসব বুদ্ধিজীবী শ্রেণী পাশ্চাত্য মানবতাবাদী লেখকদের ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতবাসীকে সাম্য, স্বাধীনতা ও স্বশাসনের ধারণায় উজ্জীবিত করে । ফলে তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি-দেশপ্রেম, স্বাধীনতার প্রতি প্রবল আগ্রহ-এসব ধারণার বিকাশ ঘটে।
১১. সাহিত্য চর্চা ও এর বিকাশ : পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের ফলে এদেশে সাহিত্য চর্চার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। অনেকে সাহিত্য চর্চা করে খ্যাতি অর্জন করেন। এসব ভারতীয় সাহিত্যিক তাদের লেখনীর মাধ্যমে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় সচেতনতাবোধ ও জাতীয়তাবাদ জাগ্রত করতে ভূমিকা রাখেন।
১২. বিভিন্ন সভা-সমিতি প্রতিষ্ঠা : পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয় নেতৃবৃন্দ জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত হয়ে তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া সরকারের নিকট তুলে ধরার জন্য বিভিন্ন সভা-সমিতি প্রতিষ্ঠা করন। এসব সভা-সমিতির বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতি গড় উঠতে থাকে। সুতরাং পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয় নেতৃবৃন্দ এসব সমিতি গঠনের মাধ্যমেই ভারতবর্ষে আধুনিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পথে অগ্রসর হয়।
১৩. প্রতিবাদী ও দেশাত্মবােধক সাহিত্যের বিকাশ : পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফলে এদেশে প্রতিবাদী ও দেশাত্বাবোধক সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। এসব সাহিত্য ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিক পালন করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মধ্যুগীয় ধ্যান-ধারণা ও গতানুগতিক রীতিনীতির স্থলে যুক্তিবাদ, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির আঙ্গিকে বিশেষ করে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতীয় উপমহাদেশে যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে তা ছিল প্রকৃতপক্ষে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা ও চেতনার প্রত্যক্ষ ফল। যদিও এক্ষেত্রে অন্যান্য উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তবুও পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার ফলেই ভারতীয়দের চিন্তা জগতে একটি বৈপ্লবিক ও সৃজনশীল পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল।