সমাজবিজ্ঞানে ব্যবহৃত বিভিন্ন পদ্ধতি গুলোর আলোচনা।

সমাজবিজ্ঞানে ব্যবহৃত বিভিন্ন পদ্ধতি গুলোর আলোচনা কর। বাংলাদেশের সমাজ অধ্যয়নে কোন পদ্ধতি তুমি অধিক পছন্দ কর? আলাচনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : সমাজ সম্পর্কে সবরকম জ্ঞান অর্জন করতে হলে সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে কতকগুলাে পথ ও উপায় অবলম্বন করতে হয়। নচেৎ পূর্ণাঙ্গ সমাজজীবন আলোাচনা করা সম্ভব হয় না। অন্য যেকোনাে বিজ্ঞানের ন্যায় বিশ্লেষণ ও সমন্বয় সাধনের পথ ধরে অগ্রসর হওয়াই সমাজবিজ্ঞানের পদ্ধতি। সমাজবিজ্ঞানের ক্রমােন্নতি এবং অসংখ্য সামাজিক সমস্যার সমাধানে এসব পদ্ধতি অনুসরণ করে কাজ করা প্রয়াজন।

সমাজবিজ্ঞান ব্যবহৃত বিভিন্ন পদ্ধতি গুলোর আলোচনা :

সমাজবিজ্ঞানকে সুন্দর ও সঠিকভাবে বিশ্লেষণ এবং অধ্যয়নের জন্য নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলাে অনুসরণ করা প্রয়াজন। যেমন-

১। ঐতিহাসিক পদ্ধতি : যে পদ্ধতিতে কোন প্রতিষ্ঠানের অতীত অবস্থা এবং গতি প্রকৃতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয় তাকে ঐতিহাসিক পদ্ধতি বলে। ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে ঐতিহাসিক তথ্য পর্যালোচনা করে আরােহ পদ্ধতিতে সাধারণ একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। এ পদ্ধতিতে বিভিন্ন সামাজিক রীতিনীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলাে বর্তমানে কি অবস্থায় আছে, অতীতে কি অবস্থায় ছিল এবং কিভাবে রূপান্তরিত হচ্ছে তা বিশ্লেষণ করে দেখা হয়।

২। তুলনামূলক পদ্ধতি : যে পদ্ধতিতে অতীতের এবং বর্তমানের সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের তুলনামূলক বিচার- বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোন সমাজতাত্ত্বিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় তাকে তুলনামূলক পদ্ধতি বলে। তুলনামূলক পদ্ধতির একটি বিশেষ গুরুত্ব হচ্ছে- এ পদ্ধতিটি বিভিন্ন সমাজের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বুঝাতে সাহায্য করে। অধিকন্তু সমাজভেদে মানুষের সামাজিক অচরণের মধ্যে কেন তারতম্য সৃষ্টি হয় তা জানা সম্ভব হয়।

৩। নমুনা জরিপ পদ্ধতি : সমাজবিজ্ঞানী কোনো একটি এলাকা বা সমগ্র দেশের জনসংখ্যা সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে সাধারণত ঐ এলাকা বা দেশের জনসংখ্যার একটি প্রতিনিধিত্বকারী অংশকে নমুনা হিসেবে বেছে নিয়ে নমুনাভূক্ত জনসংখ্যার উপর একটি প্রশ্নমালা তৈরি করে গবেষণা চালান। এভাবে কোনো এলাকাবাসীর মতামত, মনােভাব, আয়, জীবনযাত্রা প্রণালি ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণার জন্য এলাকাবাসীর একটি অংশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তা যথারীতি বিচার-বিশ্লেষণ করার জন্য নমুনা জরিপ পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ।

৪। পরীক্ষণ পদ্ধতি : যে পদ্ধতিতে দুটি উপাদানের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য একটি প্রকল্পকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয় তাকে পরীক্ষণ পদ্ধতি বলে। এ পদ্ধতিতে দুই বা ততােধিক সামাজিক ঘটনা বা প্রপঞ্চের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাধীনে পরীক্ষা করা হয় ।

৫। ঘটনা জরিপ পদ্ধতি : এ পদ্ধতিতে এক বা একাধিক ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে একটি সাধারণ সূত্রে আসার চেষ্টা করা হয়। এ পদ্ধতির ক্ষেত্রে গবেষক কোনো একটি সম্প্রদায়, গ্রাম, নগর বা কোনাে পেশাভিত্তিক শ্রেণীর জীবনযাত্রা প্রণালি সম্পর্কে অনুসন্ধান চালান। ঘটনা জরিপের মাধ্যমে বৃহৎ সমাজ সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ করা যায়।

৬। দার্শনিক পদ্ধতি : সমাজের প্রকৃতি, কার্যাবলি, ব্যক্তির সাথে তার সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে মীমাংসা যে উপায় বা পদ্ধতিতে করা হয় তাকে দার্শনিক পদ্ধতি বলে। এ পদ্ধতিতে কতিপয় বিমূর্ত অবস্থাকে সত্য বলে ধরে নিয়ে, পরে সমাজের প্রকৃতি, অবস্থা ও লক্ষ্য অনুসারে অবরোহ পদ্ধতিতে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়।

৭। পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি : যে পদ্ধতিতে পরিমাপ ও সংখ্যায়নের সাহায্যে তত্ত্ব ও গবেষণার মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা হয় তাকে পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি বলে। এ পদ্ধতিতে সর্বপ্রথম সামাজিক জীবন পর্যবেক্ষণ করে উন্নত সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং তাদের কর্মতৎপরতার পর্যালােচনা সাপেক্ষে সত্যানুষ্ঠানের চেষ্টা করা হয়। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সামাজিক তথ্য সংগ্রহ করে তা বিশেষভাবে যাচাই করে দেখে নিতে হয়।

৮। নৃতাত্ত্বিক পদ্ধতি : নৃতাত্ত্বিক পদ্ধতি হলো এমন একটি পদ্ধতি যেখানে মানুষের উৎপত্তি, দৈহিক গঠন, ক্রমবিকাশ, প্রকারভেদ, দৈহিক বৈশিষ্ট্যের আদিরূপ কি ছিল এবং বিবর্তনের ফলে কি রূপ লাভ করেছে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলােচনা করা হয়। এ পদ্ধতি প্রয়ােগের ফলে সমাজের সাংস্কৃতিক সংকট উত্তরণ ও বিবিধ আচার-অনুষ্ঠানের পার্থক্য ও বিরোধিতার সহজ সমাধান সম্ভব হয়। তাছাড়া এ পদ্ধতি প্রয়োগের দ্বারা মানব জাতিতত্ত্বের সঠিক ধারণা পাওয় যায় ।

৯। পরিসংখ্যান পদ্ধতি : তথ্য, বা উপাত্ত সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং তাৎপর্য ব্যাখ্যার জন্য যে পদ্ধতি বা কৌশল অবলম্বন করা হয় তাকে পরিসংখ্যান পদ্ধতি বলে। পরিসংখ্যান পদ্ধতিকে সামাজিক গবেষণা তথা সামাজিক সমস্যা বিশ্লেষণের প্রধান হাতিয়ার বলা হয়।

১০। কেসস্টাডি পন্ধতি : কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সম্প্রদায় অথবা অন্যকোনো ধরনের গবেষণার জন্য গৃহীত ব্যবস্থাকে কেসস্টাডি পদ্ধতি বলে। কেসস্টাডি পদ্ধতি চিকিৎসা বিজ্ঞানে বহুল ব্যবহৃত হয়। সামাজিক নৃবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও এ পদ্ধতি বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

বাংলাদেশের সমাজ অধ্যয়নে আমার অধিক পছন্দনীয় পদ্ধতি :

বাংলাদেশ একটি দরিদ্র দেশ। কাজেই আমার মতে, বাংলাদেশের জন্য অধিক পছন্দনীয় পদ্ধতি হচ্ছে নমুনা জরিপ পদ্ধতি। কেননা এ পদ্ধতিতে সমাজবিজ্ঞানী কোনাে একটি এলাকা বা সমগ্র দেশের জনসংখ্যা সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে সাধারণত ঐ এলাকা বা দেশের জনসংখ্যার একটি প্রতিনিধিত্বকারী অংশকে নমুনা হিসেবে বেছে নিয়ে নমুনাভূক্ত জনসংখ্যার উপর একটি প্রশ্নমালা তৈরি করে গবেষণা চালান। এতে শ্রম ও অর্থ কম লাগে। এভাবে কোনো এলাকাবাসীর মতামত, মনোভাব, আয়, জীবনযাত্রা প্রণালি ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণার জন্য এলাকাবাসীর একটি অংশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তা যথারীতি বিচার-বিশ্লেষণ করার জন্য নমূনা জরিপ পদ্ধতি অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সমাজ গবেষণার জন্য সমাজবিজ্ঞানে বিভিন্ন পদ্ধতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করা হয়। যদিও সব পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে না তবুও এসব পদ্ধতি সমাজবিজ্ঞানের জন্য অপরিহার্য।

Next Post Previous Post