বাংলাদেশে সুফিবাদের উৎপত্তি ও বিকাশ
সুফিবাদ কী? বাংলাদেশে সুফিবাদের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্বন্ধে
আলােচনা কর।
অথবা, সুফিবাদের সংজ্ঞা দাও। বাংলাদেশে সুফিবাদের বিকাশ সম্বন্ধে
আলোচনা কর।
উত্তর ॥ ভূমিকা : পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামক যে সুশ্যামল রাষ্ট্র আপন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে সুউচ্চভাবে দাঁড়িয়ে আছে তার অন্তরালে রয়েছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। এ ইতিহাসের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে এদেশে মুসলমানদের আগমন। ইসলামের মানবপ্রেম, সাম্য, ভ্রাতৃত্বের বাণী বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ইসলামি আধ্যাত্মিক দর্শন হিসেবে পরিচিত সুফিবাদ' এর ভূমিকা অগ্রগণ্য। বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে এদেশে অগত সুফিবাদ বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
সুফিবাদ বলতে কি বুঝায় :
ইসলামের মরমি ভাবধারাই সুফিবাদ নামে পরিচিত। হৃদয়ের গভীরে পরম প্রিয়জনকে খুঁজে বের করা এবং তাঁর সাথে নিবিড় যোগসূত্র স্থাপনের যে প্রয়াস তাই সুফিবাদ। সুফিসধকগণ সুফি নামে আখ্যায়িত। আল্লাহর প্রেমের উপলব্ধি ও আত্মার পবিত্রতা বিধানই তাদের সাধনার লক্ষ্য। মানবাত্মার সাথে পরমাত্মার ও মিলন সাধন সুফি সাধনার মর্মকথা।
সুফিবাদ কাকে বলে :
বিভিন্ন ইসলামি চিন্তাবিদ বিভিন্নভাবে সুফিবাদের সংজ্ঞা দিয়েছেন। যেমন-
হাসান আল বসরীর মতে,
জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যকে পরিহার করে পারলৌকিক সুখকে প্রাধান্য দেয়াকে সুফিবাদ বলা হয়।
মারুফ আল কারখী (র) বলেন,
আল্লাহর জাতের (সত্তার) উপলব্ধিই সুফিবাদ।
হযরত যুননুন মিশরী (র) বলেন,
আল্লাহ ব্যতীত সকল কিছু পরিত্যাগ করাই সুফিবাদ ।
জুনায়েদ বাগদাদী (র) বলেন,
জীবন ও মৃত্যুসহ সকল বিষয়ে আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ তাওয়াকুল বা নির্ভরতাই সুফিবাদ।
আল্লাহুমা কুশায়রী (র) বলেন,
বাহ্য ও অভ্যন্তরীণ বিশুদ্ধতা অর্জনের সাধনা পদ্ধতিই সুফিবাদ।
আবুল হুসাইন আল নূরী (র) এর মতে,
সুফিবাদ হলো ইন্দ্রীয়জ আত্মার সর্বপ্রকৃতির বিসর্জন।
ইমাম আল গাযালী (র) এর মতে,
আল্লাহ ব্যতীত অপর সব কিছু থেকে হৃদয়কে পবিত্র করে সতত, আল্লাহর আরাধনায় নিমজ্জিত থাকা এবং সম্পূর্ণরপে আল্লাহকে নিমগ্ন হওয়ার অপর নামই সুফিবাদ।
হযরত বায়েজিদ বােস্তামী (র) বলেন,
আরাম আয়েশ ত্যাগ করা এবং আল্লাহকে পাওয়ার উদ্দেশে দুঃখ-কষ্ট কে বরণ করাই প্রকৃত সুফিবাদ।
উপরের সংজ্ঞা থেকে আমরা বলতে পারি যে, সুফিবাদ অন্তরের বিশুদ্ধতা ও পবিত্রতার উপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করে।অতএব মহানবী (স) এর তরিকা অনুযায়ী আত্মশুদ্ধি করে ইসলামের জাহেরি ও বাতেনি দিকের প্রেমপূর্ণ বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে পরম জাতের পূর্ণ জ্ঞানার্জন ও আল্লাহ তায়ালার সর্বোচ্চ নৈকট্য লাভজনিত রহস্যময় উপলন্ধিকেই সুফিবাদ বলা হয়
বাংলাদেশে সুফিবাদের বিকাশ :
সুফিতত্ত্বের প্রভাবে বাংলায় আবির্ভাব হয়েছে অগণিত সুফি দরবেশ ও পীর ফকিরের। বহুবিধ তরিকার মাধ্যমে তাঁরা নিজেরা যেমন করেছেন সাধনা, তেমনি পথ দেখিয়েছেন তাদের শিষ্য মুরিদদেরকে অবার সুফিতত্ত্বের প্রভাবেই বাংলাদেশে সুফি তরিকার আবির্ভাব হয়েছে। তার মধ্যে চিশতিয়া, কাদেরিয়া, মুজান্দেদিয়া, সােহরাওয়ার্দিযা, ওয়াসেসিয়া, আহমাদিয়া, নকশেবন্দিয়া, খিজিরিয়া, কলন্দারিয়া ও তাবাকাদী বা মাদারিয়া প্রধান।
বাংলাদেশে সুফিবাদের সূত্রপাত :
এদেশে প্রথম যে সুফিসাধক আগমন করেছিলন তিনি হচ্ছেন সুফি সম্রাট হযরত বায়ােজিদ বোস্তামী (র)। তাঁর আগমনের সত্যতা সম্পর্কে মতভেদ বিদ্যমান। এ পর্যন্ত বিশ্বাসযােগ্য ইতিহাস পাওয়া যায় নি যে, তিনি এদেশে আগমন করেছিলেন তবুও তাঁর কিছু নিদর্শন চট্টগ্রামে বিদ্যমন রয়েছে। তবে বাংলাদেশে সুফিবাদের বিকাশ ঘটতে থাকে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির ১২০১, খ্রিস্টাব্দে বঙ্গ বিজয়ের পর থেকে। তাঁর বঙ্গ বিজয়ের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও এর আশেপাশের এলাকা থেকে দলে দলে সুফি সাধক ইসলামের পবিত্র বাণী ও মহান আদর্শ নিয়ে এদেশে আগমন করতে থাকে। মূলতঃ বঙ্গ বিজয়ের পর এদেশের ভূখণ্ড সুফি সাধকের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। ফলে বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় সুফিসাধকের পদাচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছিল । তাদের মাজারও গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে রয়েছে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশে সুফিবাদের বিকাশ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অসংখ্য সুফিসাধক ঘুমিয়ে রয়েছেন। তাদের আধ্যাত্মিক প্রভাব অসংখ্য জনতার আলাের পথের সন্ধান দিচ্ছে। এদেশের জনগণের প্রাত্যহিক কাজকর্মে, চিন্তা ভাবনায়: গানে কবিতায়, শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে সুফি দরবেশের শিক্ষা ও প্রভাব বিদ্যমান। সুতরাং বাংলাদেশ পীর আউলিয়ার দেশ। এদেশ সুফিদের তীর্থস্থান।