অখন্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র পরিকল্পনা

অখন্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র পরিকল্পনা বলতে কি বুঝায়?

অখন্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস ছিল ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি যুগান্তকারী ঘটনা। ভারতবর্ষ কখনও একজাতিক রাষ্ট্র ছিল না। পৃথিবীর মানচিত্রে বহুজাতি অধ্যুষিত ভারত একটি উপমহাদেশ । যদি স্বাধীনভাবে বিকশিত হওয়ার সুযােগ পেতাে, তাহলে এসব জাতির পক্ষে এখানে একাধিক জাতি-রাষ্ট্র গঠনের যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। ভাষা, রক্ত-সম্বন্ধ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, ভৌগােলিক অবস্থান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় ভারতের অন্য এলাকার চেয়ে বাংলায় জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা ছিল সবচেয়ে উজ্জ্বল। কিন্তু ইউরােপ স্বাধীনভাবে জাতি গঠনের যে সুযােগ পায়, ভারত তা পায় নি। তুর্কি আফগান, মুগল, ব্রিটিশ প্রভৃতি বহিরাগত বিজাতীয় শক্তির দীর্ঘ (৭১২ থেকে) শাসন, বিশেষ করে দুশাে বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন এখানে এক অস্বাভাবিক পরিবেশ-পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায়, যা জাতি-প্রশ্নটির স্বাভাবিক সমাধানের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে একে ভিন্নপথে পরিচালিত করে। ব্রিটিশবিরােধী স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতি-প্রশ্নটি উঠে আসার সুযােগ সৃষ্টি হলেও বস্তুত একই অবস্থার কারণে তা অখন্ড ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বনাম ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের বিকৃত রূপ পরিগ্রহ করে। ফলে জাতি-সমস্যার সমাধানের প্রশ্নটি ঐতিহাসিক বিভ্রান্তির শিকার হয় এবং অমীমাংসিত থেকে যায়। এমনি এক ঐতিহাসিক ধারায় দেশবিভাগের প্রাক্কালে অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ২৭ এপ্রিল (১৯৪৭) দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন, সার্বভৌম, অখণ্ড বাংলা” প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ গ্রহণের কথা ঘােষণা করেন। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সেক্রেটারি আবুল হাশিম, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জ্যেষ্ঠ ব্রাতা শরশ্চন্দ্র বসু এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সংসদীয় নেতা কিরণ শংকর রায় প্রমুখ ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন এবং এক্ষেত্রে তাঁরা সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এ প্রচেষ্টা সফল হলে ১৯৪৭ সালেই ভারত ও পাকিস্তানের পাশাপাশি অখণ্ড বাংলা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হতাে।

অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে যুক্তি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি যখন ভারতবর্ষ থেকে তাদের ঔপনিবেশিক শক্তি গুটিয়ে নিচ্ছিলেন তখন এ অঞ্চলের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী স্বাধীনতার বিষয়টি নানা পক্ষ থেকে নানাভাবে উপস্থাপিত হতে থাকে। এমনি এক রাজনৈতিক পটভূমিতে সােহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম ‘ অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসেন ।

বাংলাবিভক্তির দাবির পশ্চাতে সক্রিয় হিন্দু মনমানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি। এ দাবির অযৌক্তিকতা, বাংলাবিভক্তির পরিণতি, বাংলার ঐক্যবদ্ধ থাকার অপরিহার্যতা, স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্রে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক এবং এ রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর আলােকপাত করে সােহরাওয়ার্দী এক দীর্ঘ বক্তব্য পেশ করেন।

হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসের বাংলাবিভক্তির দাবিকে অদূরদর্শী এবং পরাজিতের মানসিকতা' বলে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন যে, ১৯৩৭ সাল থেকে বাংলার হিন্দুরা তাদের সংখ্যা, সম্পদ, শিক্ষা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির তুলনায় বঙ্গীয় মন্ত্রিসভায় আসন লাভ করতে না পারায় তা থেকে সৃষ্ট হতাশাই উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য দায়ী। বাংলার হিন্দুদের ঐ অবস্থার মূল কারণ হিসেবে প্রধানত সর্বভারতভিত্তিক হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের কথা তিনি উল্লেখ করেন, যেখানে সব ধরনের সমস্যা সর্বভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচিত হয়ে থাকে। প্রত্যেকটি প্রদেশ নিজ ব্যাপারে সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব লাভ করলে পুরােপুরি ভিন্ন এক অবস্থার উদ্ভব হবে এ আশাবাদ ব্যক্ত করে সােহরাওয়ার্দী বলেন, স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রে আমরা সবাই এক সঙ্গে বসে এমন একটি সরকারব্যবস্থা প্রণয়ন করতে সক্ষম হবাে, যা সকলের সন্তুষ্টি বিধান করতে পারে।'

১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে ভয়াবহ কলকাতা দাঙ্গার অব্যবহিত পরে পূর্ব বাংলার নােয়াখালী জেলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়, যাতে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্তরাই অধিক ক্ষতি হয়েছিল। নােয়াখালী দাঙ্গা'কে অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রে হিন্দুদের সম্ভাব্য অবস্থার একটি নজির হিসেবে কোনাে কোনাে মহল তুলে ধরার চেষ্টা করলে সােহরাওয়ার্দী তা খণ্ডন করে হিন্দু সম্প্রদায়কে স্মরণ করিয়ে দেন যে, নােয়াখালী ছাড়া বাংলার আরও বহু জেলা রয়েছে, যেখানে মুসলমানরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও উভয় সম্প্রদায় বহুকাল ধরে শান্তি ও পারস্পরিক সৌহার্দ্যের মধ্যে বসবাস করে আসছে। বাংলাবিভক্তি হিন্দুদের জন্যও আত্মহত্যার শামিল হবে’-এ অভিমত ব্যক্ত করে তিনি দৃঢ়ভাবে ঘােষণা করেন যে, অর্থনৈতিক ঐক্য, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং একটি কার্যকর শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের আবশ্যকতা বিবেচনায় বাংলা সর্বদাই অবিভাজ্য।

তিনি বাঙ্গালি-অবাঙালি প্রশ্ন তুলে কিভাবে এক শ্রেণির অবাঙালি কর্তৃক বাংলা শােষিত হচ্ছে সে কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলাকে সমৃদ্ধিশালী হতে হলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে...বাংলাকে অবশ্যই তার ধন-সম্পদ এবং নিজ ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হতে হবে। বাংলা ঐক্যবদ্ধ ও স্বাধীন হলে এর ভবিষ্যৎ চিত্র কেমন হতে পারে তার ইঙ্গিত দিতে গিয়ে সােহরাওয়ার্দী বলেন এটা বস্তুত একটি মহান দেশে পরিণত হবে, ভারত উপমহাদেশে যা হবে সবচেয়ে সমৃদ্ধ। এখানে জনগণ উন্নত জীবন ধারনের সুবিধা নিয়ে উন্নতির চরম শিখরে পৌছাতে সক্ষম হবে। কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি অর্জন করে কালক্রমে এ দেশ বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ও উন্নত রাষ্ট্রের মর্যাদা অর্জন করতে সমর্থ হবে।

সােহরাওয়াদী এ মর্মে আরও অভিমত ব্যক্ত করেন যে, হিন্দু ও মুসলমানরা সম্মিলিতভাবে বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে সক্ষম হলে এক সময়ে বাংলার সঙ্গে তৎসংলগ্ন ও বিহার প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত মানভূম, সিংহভূম ও পূর্ণিয়া জেলা এবং আসাম প্রদেশের সুরমা এলাকার সংযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশবিভাগকে কেন্দ্র করে দু’সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অবসান হলে আসামের বাকি অংশ বাংলার সঙ্গে একীভূত হয়ে একক রাষ্ট্র গঠনে এগিয়ে আসবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এটাই ছিল সােহরাওয়ার্দীর বৃহত্তর বাংলা’ রাষ্ট্রের ধারণা।

অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠন সম্পর্কে সােহরাওয়ার্দীর দিল্লি ঘােষণার দু'দিনের মধ্যে ২৯ এপ্রিল আবুল হাশিম এক বিবৃতিতে এ পরিকল্পনার সপক্ষে জোরালাে বক্তব্য তুলে ধরে বাংলাবিভক্তির আন্দোলনে মদদ দানের জন্য বিদেশি পুঁজি এবং ভারতীয় দোসরদের দায়ী করেন। তিনি হিন্দুদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, তারা (হিন্দুরা) বাংলার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক এবং হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোনাে এক সম্প্রদায়ের পক্ষে অপরকে পদানত করে রাখা সম্ভব নয়।

অখন্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রের প্রকৃতি

অখন্ড বাংলা রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলির প্রকৃতি কেমন হবে সে সম্পর্কে সােহরওয়ার্দী সুস্পষ্ট মতামত দানে বিরত থাকলেও হাশিম হিন্দুদের উদ্দেশ্যে যুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং প্রশাসনে তাদেরকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের ‘বেঙ্গল প্যাক্ট' (১৯২৩) অনুযায়ী ৫০:৫০ আসন প্রদানের কথা ঘােষণা করেন। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাংলার যুব সম্প্রদায়ের প্রতি এক আবেগপূর্ণ আবেদনে তিনি মন্তব্য করেন যে, উদ্ভূত সঙ্কট নিরসনের পন্থা হচ্ছে গভীর দেশপ্রেমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ ও স্বাধীন করা, একে বিভক্ত করা নয়।

অখন্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি

বহু আলাপ-আলােচনার পর ১৯৪৭ সালের ২০ মে শরৎ বসুর কলকাতাস্থ বাড়িতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে অবিভক্ত ও স্বাধীন বাংলার সমর্থক উভয় সম্প্রদায়ের বাঙালি নেতৃবৃন্দ ঐকমত্যে পৌছে একটি চুক্তি প্রণয়ন করতে সক্ষম হন,যা ছিল নিম্নরূপ

  • বাংলা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে। ভারতের বাকি অংশের সঙ্গে এ রাষ্ট্রের সম্পর্ক কি হবে তা সে নিজে নির্ধারণ করবে।
  • এ স্বাধীন বাংলার শাসনতন্ত্রে হিন্দু ও মুসলমানের সংখ্যা অনুপাতিক আসন সংরক্ষণসহ যুক্ত নির্বাচন ও প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে আইনসভা নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকবে। হিন্দু ও তফসিলী হিন্দুদের মধ্যে জনসংখ্যা অনুপাতে অথবা উভয়ের সম্মতিক্রমে নির্ধারিত পদ্ধতিতে আসন বণ্টন করা হবে। নির্বাচন হবে একটি এলাকা থেকে একাধিক প্রার্থী নির্বাচনমূলক (multiple) এবং ভােট হবে বণ্টনধর্মী (distributive), সর্বোচ্চ আসনসংখ্যাভিত্তিক (cumulative) নয়। কোনাে প্রার্থী যদি নির্বাচনে তার নিজ সম্প্রদায়ের প্রদত্ত ভােটের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােট লাভ করেন এবং অন্য সম্প্রদায়ের প্রদত্ত ভােটের ২৫% পান, তাহলে তিনি নির্বাচিত বলে গণ্য হবেন। যদি কোনাে প্রার্থী ও শর্ত পূরণে ব্যর্থ হন, তাহলে যিনি নিজ সমপ্রদায়ের বেশিরভাগ ভােট লাভ করলেন তাকে নির্বাচিত ঘােষণা করা হবে।
  • ব্রিটিশ সরকার এ মর্মে ঘােষণা প্রদান করবে যে, স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে এবং বাংলা বিভক্ত হবে না; বাংলার বর্তমান মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়া হবে এবং মুখ্যমন্ত্রীর পদ বাদে সমসংখ্যক মুসলমান ও হিন্দু (তফসিলী হিন্দুসহ) সদস্য নিয়ে একটি নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। এ মন্ত্রিসভায় মুখ্যমন্ত্রী হবেন একজন মুসলমান এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন একজন হিন্দু।
  • নতুন শাসনতন্ত্র অনুযায়ী আইনসভা ও মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়া পর্যন্ত হিন্দু (তফসিলী সম্প্রদায়) এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সামরিক বাহিনী ও পুলিশসহ সকল চাকুরিতে সমান অংশ থাকবে। এসব চাকুরিতে কেবল বাঙালিদেই নিয়ােগ করা হবে।
  • ইউরােপীয় সম্প্রদায়ভুক্ত সদস্যগণ বাদে বঙ্গীয় আইনসভায় মুসলমান ও অমুসলমান সদস্যগণ মিলে ১৬ জন মুসলমান এবং ১৪ জন হিন্দু সদস্য অর্থাৎ মােট ৩০ সদস্যবিশিষ্ট একটি সংবিধান পরিষদ নির্বাচিত করবে।

এ চুক্তি স্বাক্ষরিত এবং পরবর্তীতে প্রচারিত হবার পর বাঙালি-মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বঙ্গীয় মুসলীম লীগের একটি গ্রুপ প্রকাশ্যে স্বাধীন অখণ্ড বাংলা প্রস্তাবের বিরােধিতা শুরু করে। এ গ্রুপে ছিলেন মাওলানা আকরাম খাঁ, নুরুল আমীন, হামিদুল হক চৌধুরী প্রমুখ। এরপর তারা ঘন ঘন দিল্লী যাতায়াত শুরু করেন এবং লাহাের প্রস্তাবের দোহাই দিয়ে পত্রিকায় সােহরাওয়ার্দী ও হাসিম গ্রুপের বিরুদ্ধে নানারকম অপপ্রচার শুরু করা হয় ।

Next Post Previous Post