প্যারিস শান্তি সম্মেলনের প্রেক্ষাপট

প্যারিস শান্তি সম্মেলনের প্রেক্ষাপট আলোচনা কর।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী মিত্রশক্তি পরাজিত জার্মানি ও তার মিত্রদেশগুলাের সঙ্গে শান্তি চুক্তি সম্পাদনের জন্যে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আহ্বান করে। ১৯১৯ সালের ১৮ জানয়ারি ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলন প্যারিস শান্তি সম্মেলন নামে পরিচিতি লাভ করে। প্যারিসে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল বলেই এরূপ নামকরণ করা হয়েছিল। প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে পৃথিবীর মোট ৩২টি দেশের প্রতিনিধি যােগ দেয়। এ সম্মেলনে ৩২টি দেশের প্রতিনিধিবৃন্দ অংশগ্রহণ করলেও নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব বর্তায় তিনটি দেশের রাষ্টপ্রধানের উপর। এ তিন প্রধান ছিলেন ফরাসি মন্ত্রী ক্লিমেনশাে ব্রিটেনের মন্ত্রী লয়েড জর্জ এবং মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে এ সম্মেলন নিরপেক্ষ দেশ সুইজারল্যান্ডে হওয়ার কথা ছিল কিন্তু ফ্রান্সের দৃঢ়তায় শেষ পর্যন্ত এ সম্মেলন প্যারিস নগরীতেই শুরু হয় এবং ফরাসি মন্ত্রী ক্লিমেনশো এতে সভাপতিত্ব করেন।যুদ্ধপ্রসূত ক্ষতিই তৎকালীন সময়ের মিত্রপক্ষের শক্তিগুলোকে একটি আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন আহ্বানে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১৭৯০ হতে ১৯১৩ সালের মধ্যে বিশ্বে যে সকল যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছি সেগুলোর কোনােটিই ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের মতো ছিল না। পূর্বের তুলনায় এ যুদ্ধে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল দ্বিগুন। উপরন্তু যু্দ্ধের ভয়াবহতা, ব্যাপকতা, মারণাস্ত্রের ব্যবহার ও ধন-সম্পত্তির বিনাশ প্রভৃতিও ছিল পূর্বের যুদ্ধগুলাের কয়েকণুণ বেশি। তাই সবকিছুর বিবেচনায় এ যুদ্ধ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হিসেবে বিবেবচিত হয়। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আওতায় এসেছিল। এর মধ্যে মিত্রপক্ষের দেশগুলোর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লোক প্রাণ হারায়। এ যুদ্ধে ধন-সম্পদ কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছিল তা সঠিকভাবে নির্ণয় করার উপায় ছিল না। যুদ্ধরত দেশগুলাের সামরিক ব্যয় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হয়েছিল। সৈন্যগণের তুলনায় বেসামরিক জনগণের প্রাণহানির সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। যুদ্ধ বিরতি চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে ১৯১৮ সালের নভেম্বরে মাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। কিন্তু তখনও প্রকৃত শান্তি স্থাপিত হয়নি। উপরন্তু এ যুদ্ধের জন্য দায়ী রাষ্ট্রগুলো এবং যুদ্ধের কারণে ক্ষয়-ক্ষতির নিরসনের ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে এবং সার্বিক পুনর্বাসনের জন্য এবং পরবর্তীতে যাতে এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় সে জন্য তৎকালীন সময়ের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানরা আলােচনায় বসার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। অতঃপর স্থায়ী সন্ধি ও শান্তি ও অন্যান্য সমস্যাগুলাের সুম্পষ্ট সমাধানের জন্য মিত্রপক্ষের দেশগুলো সর্বপ্রথম প্যারিসে এক বেঠকে সমবেত হয়।

পরিশেষে বলা যায় যে,প্যারিস শান্তি সম্মেলন যুদ্ধ পরবর্তী শান্তি আলােচনার ক্ষেত্রে ছিল একটি ঐতিহাসিক দলিল। কেননা এ সন্ধির উপর ভিত্তি করে ইউরােপ তথা বিশ্বরাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়। আর এ সম্মেলনের পেছনে যে ব্যক্তিটির অবদানের কথা স্বীকার করতেই হবে সেই ব্যক্তিটি হলেন উড্রো উইলসন। উড্রো উইলসনের চৌদ্দ দফার উপর ভিত্তি করেই এ সম্মেলনের মূলনীতি ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

Next Post Previous Post