ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভের পটভূমি
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভের পটভূমি/কারণ আলোচনা কর।
সাত-সমুদ্রের ওপার থেকে আগত একটি বাণিজ্যিক সংস্থা তথা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক 'স্বর্গরাজ্য' বলে পরিচিত বাংলার পতন ঘটিয়ে দেওয়ানি লাভের মধ্য দিয়ে একটি মহা উপনিবেশিক রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা আপাতদৃষ্টিতে বিস্ময়কর মনে হলেও বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে কোম্পানির কর্মকাণ্ড ও এতদ্দেশীয় রাজনীতির গতিধারা প্রথম থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে,ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভ ছিল ঘটনাপ্রবাহের প্রতি স্বাভাবিক পরিণতি ।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানি লাভের পটভূমি বা কারণ :
১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী স্থানান্তর করা হলেও এর পশ্চাতে বিভিন্ন পরিস্থিতি ও ঘটনা প্রবাহ কাজ করেছিল এক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিস্থিতি ও ঘটনা প্রবাহ নিন্মে আলোচনা করা হলো :
কোম্পানির বাণিজ্য কুঠি স্থাপন :
১৭৯৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ৮০ জন অংশীদার নিয়ে লন্ডনে প্রথম গঠিত হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি । ১৬০০ সালে রানী এলিজাবেথ কর্তৃক ভারত ও পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে ইংরেজ জাতির পক্ষে একচেটিয়া বাণিজ্য করার জন্য এই কোম্পানি ১৫ বছরের একটি নবায়নযোগ্য চার্টার লাভ করে । কিছুকাল পরে তথা ১৬১৩ সালে কোম্পানির প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপিত হয় ভারতের পশ্চিম উপকূল বন্দর সুরাটে । কিন্তু ১৬৩৩ সালে সর্বপ্রথম বাংলার সাথে কোম্পানি বাণিজ্য যোগাযোগ শুরু হয় এবং ঐ বছরই সুবে বাংলার উড়িষ্যা প্রদেশের হরিহরপুরে কোম্পানির প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপিত হয় । অতঃপর ১৬৫১ সালে বাংলার সাথে ব্যবসা প্রসারের লক্ষ্যে হুগলিতে তাদের প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপিত হয় । এই হুগলিতে কুঠি স্থাপনের ঘটনাকে বলা হয় বাংলায় ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার পথে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক । তাছাড়া ১৬৫৮ সালে কাশিমবাজারে, ১৬৫৯ সালে পাটনায়, ১৬৮৮ সালে ঢাকায় তাদের ভিন্ন ভিন্ন কুঠি স্থাপিত হয় । আর ১৬৯০ সালে কলকাতায় স্থাপিত হয় কোম্পানির প্রধান বাণিজ্য কুঠি ও স্থায়ী বাসস্থান। এভাবে কুঠি স্থাপনের ফলে কোম্পানির বাণিজ্যিক লিপ্সা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে ।
কোম্পানির বাণিজ্যিক অধিকার ও বাণিজ্য বিস্তার :
১৬৫৭ সালে বাংলায় কোম্পানির পৃথক এজেন্সি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্য দ্রুত প্রসার লাভ করতে থাকে । কেননা ১৬৫১ সালে বাংলার সুবাদার শাহ সুজার নিকট থেকে বার্ষিক তিন হাজার টাকা পেশকাল বা পুরস্কার প্রদানের বিনিময়ে বাংলায় বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার লাভের পর থেকেই কোম্পানির বাণিজ্যিক স্পৃহা বৃদ্ধি পায় এবং এরপর থেকে কোম্পানি বাণিজ্য ক্ষেত্রে অধিকতর পুঁজি বিনিয়োগ করতে থাকে ।
কোম্পানির জমিদারি লাভ :
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৮৯৭ সালে সুবাদার আজিমুশশান কে ১৬ হাজার টাকা নজরানা দিয়ে এবং বার্ষিক ১১৯৪ টাকা ১৪ আনা ৪ পয়সা সরকারি রাজস্ব প্রদানের বিনিময়ে ১৬৯৮ সালে সুতানটি, গোবিন্দপুর ও কলকাতা এ তিনটি গ্রামের জমিদারি স্বত্ব লাভ করে । ১৭৬৫ সালে কোম্পানী কর্তৃক দেওয়ানি লাভ, বস্তুত ১৬৯৮ সালের জমিদারি স্বত্বেরই পূর্ণ বিকাশ মাত্র । শুধু তাই নয়, ১৭১৭ সালে মোগল সম্রাট ফারুকশিয়ারের নিকট থেকে কোম্পানি যে ফরমান লাভ করে তাতে উক্ত তিনটি গ্রাম ছাড়াও পার্শ্ববর্তী আরো ৩৮ টি গ্রামের উপর জমিদারি স্বত্ব ক্রয়ের অনুমতি দেওয়া হয়। যদি অতিরিক্ত ৩৮ টি গ্রামের উপর জমিদারি স্বত্ব লাভে কোম্পানি ব্যর্থ হয়, তবুও তারা কলকাতার আশেপাশে বেনামিতে জমি ক্রয় তথায় শহরের সম্প্রসারণ ঘটাতে থাকে। এভাবে জমিদারিত্ব লাভ কোম্পানিকে এদেশে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের পথকে প্রশস্ত করে অভিলাষ চরিতার্থ করার পথকে সুপ্রশস্ত করে দেয়।
বাণিজ্য কুঠিতে দুর্গ নির্মাণ :
বাংলার অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের সুবাদে সুবাদার ইব্রাহিম খান বিদেশি কোম্পানিগুলো কে তাদের স্ব-স্ব প্রধান কুঠিতে দুর্গ স্থাপনের অনুমতি প্রদান করে। এ সুযোগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬৯৬ সালে সুতানটি কুঠিতে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ করে এবং পরবর্তীতে দুর্গটিকে সামরিক সরঞ্জামাদি ও অস্ত্র দ্বারা সুরক্ষিত করে তোলে । অন্যদিকে দাক্ষিণাত্যে ইঙ্গ-ফরাসি সংঘাতকে কেন্দ্র করে কোম্পানি কলকাতাকে সুরক্ষিত করার চেষ্টা করে । ফলে স্বাধীনচেতা নবাব সিরাজউদ্দৌলা কোম্পানিকে দুর্ভেদ্য দুর্গ ও পরিখা খনন করা থেকে বিরত থাকতে বলে । ফলে নবাবের সাথে শুরু হয় কোম্পানির দ্বন্দ্ব । কেননা দুর্গ নির্মাণের মাধ্যমে কোম্পানি এ দেশে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের যে প্রথম খুঁটি স্থাপন করে তাতে বাধা দেওয়ায় নবাবের সাথে দ্বন্দ্ব শুরু হয় ।
পলাশীর যুদ্ধ ও নবাবের পরাজয় :
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যে স্পৃহা ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক অভিলাষ চরিতার্থ করার দিকে ধাবিত হয় । অন্যদিকে নবাব সিরাজউদ্দৌলার নবাবী লাভ তার আত্মীয়স্বজন ও সভাসদ স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি । ফলে ঘষেটি বেগম , মীরজাফর , জগৎশেঠ , রায়দুর্লভ প্রমুখ নবাব কে ক্ষমতাচ্যুত করার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় । আর কোম্পানি এ সুযোগে নবাবের বিরোধীপক্ষকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে । অধিকন্তু কোম্পানির ঔদ্ধত্য দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তারা নবাবের আদেশ ও নিষেধ উপেক্ষা করতেও দ্বিধা করেনি। ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এ ঔদ্ধত্যের সমুচিত শাস্তি প্রদান করতেন নবাব প্রয়াসী হলে ১৭১৭ সালের ২৩ জুন নবাবের সৈন্যবাহিনী ও ইংরেজদের মধ্যে পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয় । কিন্তু যুদ্ধে কপটতা ও বিশ্বাসঘাতকতার মধ্য দিয়ে নবাবের পরাজয় ও পতন ঘটে । পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ও পতনের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য প্রায় ২০০ বছরের জন্য অস্তমিত হয়ে যায় এবং পলাশীর প্রান্তরেই ব্রিটিশ শক্তি এদেশীয় রাজনীতির কর্ণধারে পরিণত হয় । অধিকন্তু কোম্পানির রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের প্রতিবন্ধকতা দূরীভূত হওয়ায় ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভের পথও সুপ্রশস্ত হয় । আর নতুন নবাব মীর জাফর কোম্পানির হাতের পুতুলে পরিণত হয় ।
বক্সারের যুদ্ধ ও কোম্পানির বিজয় :
পলাশীর যুদ্ধের পর মীরজাফর কোম্পানিকে সীমাহীন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বাংলার রাজকোষকে শূন্য করে ফেলেছিলাম । অন্যদিকে বিনাশুল্কে বাণিজ্য সহ ১৭৬০ সালে নাগাদ কোম্পানিকে বর্ধমান ,মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম জেলার জমিদারি প্রদান করেন । কিন্তু বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করে মীরজাফর কোম্পানির প্রভাব মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করলে কোম্পানির সাথে আঁতাত করে মীর কাসিম ১৭৬০ সালের ২০ অক্টোবর বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব হন । মীর কাসিম নবাব হয়ে স্বাধীন অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ ও ইংরেজদের বিনাশুল্কে বাণিজ্য অধিকার খর্ব করার চেষ্টা করলে কোম্পানি বাহাদুরের স্বার্থহানি ঘটে । ফলে শুরু হয় মীর কাসিম ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে সংঘাত ও সংঘর্ষ । ১৭৬৩ সালে মীর কাসিমের সাথে কোম্পানির সংঘর্ষ শুরু হয় এবং কাটোয়া, মুর্শিদাবাদ, ঘেরিয়া, উদয়নালা, সুখী, মুঙ্গের ও পাটনার যুদ্ধে মীর কাসিম পরাজিত হয় । অতঃপর তিনি অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা ও মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সহায়তায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে বক্সারের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন । কিন্তু ১৭৬৪ সালের অক্টোবর মাসে বক্সারের যুদ্ধে মীর কাসিম ও মিত্রবাহিনী ইংরেজদের নিকট চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয় । ফলে বক্সারের যুদ্ধে জয় লাভ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা তথা সমগ্র উত্তর ভারতে একটি অদ্বিতীয় অপরাজেয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় ।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক দেওয়ানি লাভ :
স্বাধীনতার প্রয়াসী মীর কাসিম চূড়ান্তভাবে পরাজিত হওয়ায় মীরজাফরের নাবালক পুত্র নাজমুদ্দৌলাকে বাংলার নতুন নবাবের পদে গদিনশীন করায় । অন্যদিকে দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের সাথে কোম্পানির পক্ষে রবার্ট ক্লাইভ বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা রাজস্ব প্রদান এর বিনিময়ে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী প্রার্থনা করলে সম্রাট তাতে ইচ্ছা পোষণ করে । অতঃপর ১৭৬৫ সালের ১২ আগস্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিল্লির সম্রাট কে বাৎসরিক ২৬ লক্ষ টাকা ও বাংলার নবাব কে ৫৩ লক্ষ ৮৬ হাজার ১ শত ৩১ টাকা ৯ আনা রাজস্ব প্রদানের বিনিময়ে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি অর্থাৎ রাজস্ব শাসনের অধিকার লাভ করে।
পরিশেষে বলা যায় যে, সামান্য বাণিজ্যিক সংস্থা থেকে একটি রাজনৈতিক সংস্থায় উত্তরণ ছিল কোম্পানির পক্ষে আকস্মিক, কিন্তু তা ছিল বাস্তবতার এক নির্মম পরিহাস । বাণিজ্যিক অধিকার ও কুঠি স্থাপন, এদেশীয় রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ, পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলাকে এবং বক্সারের যুদ্ধে মীর কাসিমকে পরাজিত করে কোম্পানি বাংলা তথা ভারতবর্ষের অজয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে । অতঃপর ১৭৬৫ সালের দেওয়ানি লাভের মধ্য দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা তথা ভারতবর্ষ বিজয়ের পথ সুপ্রশস্ত হয়ে যায় । বস্তুত ১৭৫১সালে শাহ সুজা কোম্পানিকে বাণিজ্যিক সুবিধা দিয়ে যে সনদ দান করেন তারই শেষ পরিণতি ছিল ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃক দেওয়ানি লাভ ।