ফরায়েজি আন্দোলনের স্বরূপ ও প্রকৃতি আলোচনা কর

ফরায়েজি আন্দালনের স্বরূপ ও প্রকৃতি আলোচনা কর।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় যে দুটি সংস্কার আন্দোলন গড়ে উঠে তন্মধ্যে ফরায়েজি আন্দোলন ছিল অন্যতম। পলাশির পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলার শাসন ক্ষমতা ও স্বাধীনতা ব্রিটিশদের হস্তগত হয়। শাসন ক্ষমতা হারিয়ে বাংলার মুসলমান সমাজ দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে মুসলমানদর মধ্যে শিক্ষার প্রসার না ঘটায় তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে নানা রকম কুসংস্কার ও অনৈসলামিক রীতি-নীতির অনুপ্রবেশ ঘটে। এভাবে বিভিন্ন কুসংস্কার ও অনৈসলামিক রীতি-নীতিতে লিপ্ত থেকে বাংলার মুসলমান সমাজ যখন চরম অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত, ঠিক সেই সময় হাজি শরিয়তুল্লাহ ইসলামের আদর্শে মুসলিম সমাজকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য "ফরায়েজি আন্দোলন" নামে এক ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের সূচনা করেন। শরিয়তুল্লাহর মৃত্যর পর তার পুত্র দুদু মিয়ার নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলন একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে পর্যবসিত হয়।

ফরায়েজি আন্দোলন

আঠারাে শতকের শেষার্ধে এবং উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ইংরেজ বেনিয়া, জমিদার, মহাজন, আমলা ও নীলকরদের অমানবিক নির্যাতন বন্ধ এবং ধর্মীয় কুসংস্কার, গোঁড়ামি ও ইসলাম বিরােধী কার্যকলাপ থেকে মুসলমানদের রক্ষার লক্ষ্যে ১৮১৮ সালে প্রসিদ্ধ সমাজসংস্কারক হাজি শরিয়তুল্লাহ কর্তৃক পরিচালিত ফরজভিত্তিক দুর্বার ও ব্যাপক সংস্কার আন্দোলনই ইতিহাসে "ফরায়েজি আন্দোলন" নামে পরিচিত। সমাজজীবন থেকে সকল প্রকার কুসংস্কার দূর করে ইসলাম ধর্মের আদি অবস্থায় ফিরে যাবার লক্ষ্যে তিনি ফরায়েজি আন্দোলন শুরু করেন। আরবি "ফরজ" শব্দ থেকে ফরায়েজি নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে তার অনুসারীদের বলা হয় ফরায়েজি।

ফরায়েজি আন্দোলনের স্বরূপ বা প্রকৃতি

হাজি শরিয়তুল্লাহর নেতৃত্বে পরিচালিত ফরায়েজি আন্দোলনের স্বরূপ বা প্রকৃতিকে প্রথমত, ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন ও দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক আন্দোলন- এই দুইভাগে বিভক্ত করে নিম্নোক্তভাবে আলােচনা করা যায়….

১. ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন

ধর্মান্তরিত হবার পূর্বে বাংলার অধিকাংশ জনগণই ছিল মূলত হিন্দু, বৌদ্ধ বা প্রকৃতি উপাসক। মুসলিম শাসনের রাজনৈতিক প্রভাব, পীর-ফকিরদের আধ্যাত্মিক শক্তির প্রভাব, চরম বর্ণ-সমাজ ব্যবস্থা প্রভৃতি কারণে স্থানীয় অধিবাসীরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। কিন্তু মুসলমান হলেও তাদের মধ্যে পূর্ব ধর্মজাতি অমুসলিম আচার-অনুষ্ঠান পালনের প্রবণতা থেকে যায়। জন্ম-মৃত্যু, বিবাহ ও সামাজিক উৎসবাদিতে মুসলমানরা নানা রকম অমুসলিম আচার-অনুষ্ঠান পালনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে এসব আচার-অনুষ্ঠানের মাত্রা বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায়। মক্কার ওহাবি আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে হাজি শরিয়তুল্লাহ উপলন্ধি করেন যে, প্রকৃত ইসলাম হতে বাংলার অধিকাংশ মুসলমান কতদূরে অবস্থান করছে। দেশে ফিরেই তিনি মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনকে কুসংস্কার মুক্ত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। এক্ষেত্রে তিনি দুটি তত্ত্বের অবতারণা করেন। যথা…

(ক) অনৈসলামিক কার্যাবলিকে মহাপাপ বলে ঘোষণা

হাজি শরিয়তুল্লাহ মুসলমান কর্তক অনৈসলামিক কার্যাবলিকে মহাপাপ বলে ঘোষণা করেন। এ পাপকে তিনি বেদ্আত ও শিরক বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি পীর পূজা, কবর পূজা, মাজার জিয়ারত, সেজ্দা দেওয়া প্রভৃতি প্রচলিত রীতিকে শিরক পাপ বলে ঘােষণা করেন। অন্যদিকে গাজি কালুর প্রশস্তি গাওয়া, পঞ্চপীর, পীর বদর, খাজা খিজিরের দোহাই দেওয়া, ভেলা ভাসানো, জারি গান গাওয়া, জন্মের সময় ষষ্ঠী পালন করা, মহররমে শাক ও মাতম করা প্রভৃতিকে তিনি বেদআত বা অনৈসলামিক কাজ বলে ঘোষণা করেন। সাথে সাথে তিনি এসব পাপাচার থেকে বিরত থেকে মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।

(খ) অমুসলিম দেশে জুমার নামাজ পড়া ও ঈদ উদযাপন নিষিদ্ধ

হাজি শরিয়তুল্লাহ ফতোয় দেন যে, অমুসলিম শাসিত দেশে জুমার নামাজ পড়া ও দুই ঈদ উদযাপন করা নিষিদ্ধ। তিনি ইংরেজ শাসনাধীন বাংলা প্রদেশকে "দার-উল-হরব" বা "বিধর্মীর রাজ্য" বা শক্রর দেশ বলে উল্লেখ করেন। তাই এদেশে হানাফি মাযহাব অনুযায়ী জুম্মা ও দুই ঈদের নামাজ নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা দেন। কারণস্বরূপ বলেন যে, এদেশে কোথাও ইসলামি প্রশাসন নেই এবং ইসলামি প্রশাসকদের উপস্থিতিতে জুমার নামাজ আদায় প্রথম ও প্রধান শর্ত। তিনি প্রকারান্তরে এদেশে ইসলামি শাসন কায়েম করার স্বপক্ষেই অভিমত প্রকাশ করেন। তার এই মতবাদ বাংলায় মুসলিম জাগরণ ও মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠারই ইঙ্গিতবহ।

২. অর্থনৈতিক আন্দোলন

হাজী শরীয়তুল্লাহর জীবদ্দশাতেই তার ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের গতি কিছুটা অর্থনৈতিক আন্দোলনের প্রকৃতি ধারণ করে। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পর যে জমিদার শ্রেণীর উদ্ভব হয় তার অধিকাংশই ছিল হিন্দু। হিন্দু জমিদাররা প্রজাদের উপর নানা রকম অবৈধ করারোপ করতো। দুর্গা পূজা, কালী পূজা ও নানারকম হিন্দু উৎসবের জন্যও মুসলমান প্রজাদের নিকট থেকে জোরপূর্বক কর আদায় করা হতাে। এমনকি দাড়ি রাখার জন্য মুসলমানদর নিকট থেকে জনপ্রতি আড়াই টাকা হারে কর আদায় করা হতাে। হাজি শরিয়তু্লাহ হিন্দু জমিদার কর্তৃক গাে-হত্যা নিষেধ অমান্যসহ নানা রকম পূজা-পার্বণের কর প্রদান করা থেকে বিরত থাকার জন্য মুসলমান কৃষক-প্রজাদর প্রতি আহ্বান জানান। এর ফলে হিন্দু জমিদারদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হতে থাকলে তারা হাজি শরিয়তুল্লাহ ও ফরায়েজিদের বিরুদ্ধাচরণ ও তাদের উপর নানাভাবে অত্যাচার শুরু করে। ফলে ফরায়েজি কৃষক ও হিন্দু জমিদারদের মধ্যে শুরু হয় অসন্তোষ। এমনকি জমিদারদের চক্রান্তে ১৮৩৯ সালে হাজি শরিয়তুল্লাহর উপর পুলিশি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তবে শরিয়তুল্লাহর সতর্ক নীতির ফলে সেই অসন্তোষ দাঙ্গা-হাঙ্গামায় পর্যবসিত হতে পারে নি।

পরিশেষে বলা যায়, ১৮৪০ সালে হাজি শরিয়তু্লাহর মৃত্যু পর্যন্ত ফরায়েজি আন্দোলন মূলত ধর্ম সংস্কার আন্দোলন রূপেই পরিগণিত ছিল। এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল মুসলমানদেরকে ধর্মনিষ্ঠ করে তােলা এবং পরােক্ষভাবে নৈতিক বলে বলীয়ান করে তাদের অধিকার ও কর্তৃব্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলা।

Next Post Previous Post