১৭৬৫ সালের এলাহাবাদের চুক্তি/সন্ধি
১৭৬৫ সালের এলাহাবাদের চুক্তি/সন্ধি কি? এই চুক্তি/সন্ধির ধারা সমূহ কি ছিল? এই চুক্তির পটভূমি উল্লেখ কর। বাংলায় কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠায় এ চুক্তির গুরুত্ব বর্ণনা কর।
১৭৬৫ সালের এলাহাবাদের চুক্তি/সন্ধি বলতে কি বুঝায়?
পলাশি ও বক্সারের যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ও মীর কাসিমের পরাজয়ের পর বাংলার রাজনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে। বাংলার নবাব, অযােধ্যার নবাব ও মুঘল বাদশাহ কোম্পানির হাতে পরাজিত হলে লর্ড ক্লাইভ তাদেরকে ১৭৬৫ সালে এলাহাবাদ চুক্তি সম্পাদনে বাধ্য করেন। ভারতের এলাহাবাদ নামক স্থানে এই চুক্তি সম্পাদিত হয় এটা এলাহাবাদ চুক্তি নামে পরিচিত। এই এলাহাবাদ চুক্তির ফলে কোম্পানি বাংলার দেওয়ানি বা রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা লাভ করেন।
১৭৬৫ সালের এলাহাবাদের চুক্তি/সন্ধির পটভুমি কি ছিল ?
১৭৬৫ সালে সম্পাদিত এলাহাবাদ চুক্তির পটভূমি সম্পর্কে নিম্নে আলােচনা করা হলাে :
পলাশির যুদ্ধে কোম্পানির জয়লাভ :
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলাকে পরাজিত করে রবার্ট ক্লাইভ বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে ইংরেজ শক্তির সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেন। পলাশির যুদ্ধের আগে ইংরেজ কোম্পানি ছিল ভারতে অন্যান্য বণিক জাতির অন্যতম। কিন্তু পলাশির যুদ্ধের পর ক্লাইভের 'পাশবিক কূটনীতি (Brutal diplomacy), তার ম্যাকিয়াভেলির কৌশল এবং সামরিক শক্তির আস্ফালন কোম্পানিকে এক শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করে।কোম্পানি power behind the throne-এ পরিণত হয়। এভাবে ক্লাইভ বাংলার দেওয়ানি লাভের সুযোগ খুঁজতে থাকেন।
কোম্পানির বাংলার বিভিন্ন জেলার রাজস্ব দাবি :
মীর জাফর সিংহাসন লাভের জন্যে তার ক্ষমতার অতিরিক্ত অর্থ ইংরেজ কোম্পানিকে প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু মীর জাফর তার প্রতিশ্রুত অর্থ নিয়মিত প্রদানে ব্যর্থ হলে কোম্পানি দাবি করে যে, নগদ টাকার পরিবর্তে তিনি যেন বাংলার কয়েকাটি জেলার রাজস্ব কোম্পানিকে ছেড়ে দেন। এভাবে ২৪ পরগনা,বর্ধমান, নদীয়া, চট্টগ্রাম প্রভৃতি জেলা কোম্পানির হাতে আসতে থাকলে কাম্পানি এক পর্যায়ে সমগ্র বাংলার রাজস্ব দখলের সুযোাগ খুঁজতে থাকে।
৩. বক্সারের যুদ্ধে কোম্পানির জয়লাভ :
১৭৬৪ সালের ২৩ অক্টোবর বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজ কোম্পানির নিকট বাংলা ও অযােধ্যার নবাব মীর কাসিম ও সুজা-উদ-দৌলা এবং মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের পরাজয় ঘটে বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের ফলে বাংলায় কোম্পানির প্রত্যক্ষ আধিপত্য এবং অযোধ্যায় পরােক্ষ আধিপত্য স্থাপিত হয়। এমনকি মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম কোম্পানির বৃত্তিভোগীতে পরিণত হন।
৪. ক্লাইভের দ্বিতীয় দফা ভারত আগমন :
বাংলার নবাব, অযোধ্যার নবাব এবং মুঘল সম্রাট কোম্পানির হাতে পরাজিত হওয়ার পর তাদের সাথে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত স্থাপনের জন্য কোম্পানির কর্তৃপক্ষ ক্লাইভকে দায়িত্ব দিয়ে ১৭৬৫ সালে দ্বিতীয়বারের মতো ভারতে পাঠান। ক্লাইভের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য তাকে 'লর্ড' উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
৫. কোম্পানির ক্ষমতাকে বৈধতা দান :
বক্সারের যুদ্ধে জয়ের পর কোম্পানির অপ্রত্যাশিত ক্ষমতা লাভকে দৃঢ়ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এবং কূটকৌশল ও বলপ্রয়ােগ দ্বারা অর্জিত ক্ষমতাকে বৈধরূপ দেওয়ার জন্য ইংরেজদের সন্ধি-চুক্তির সন্ধান করতে হয়, যা এলাহাবাদে এসে তারা পেয়ে যায়।
১৭৬৫ সালের এলাহাবাদের সন্ধি/চুক্তি কাদের মধ্যে ও কয়টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়?
লর্ড ক্লাইভ এলাহাবাদে দুটি সন্ধি স্বাক্ষর করেন । তন্মধ্যে প্রথমটি অযােধ্যার নবাব সুজা-উদ-দৌলার সাথে এবং দ্বিতীয়টি মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সাথে । দুটি সন্ধিই সম্পাদিত হয়েছিল ১৭৬৫ সালের আগস্ট মাসে।
১৭৬৫ সালের এলাহাবাদের প্রথম সন্ধি কি ও এর ধারা সমূহ কি ছিল?
১৭৬৫ সালের আগস্ট মাসে লর্ড ক্লাইভ ও অযোধ্যার নবাবের সঙ্গে এলাহাবাদের প্রথম সন্ধি সম্পাদিত হয়। এ সন্ধির ধারাসমূহ ছিল নিম্নরূপ
১. সুজা-উদ-দৌলাকে রাজ্য ফেরত দান :
এলাহাবাদের প্রথম সন্ধির প্রথম ধারাতেই বলা হয় যে, নবাব উজির সুজা-উদ-দৌলাকে তার রাজ্য অযােধ্যা ফিরিয়ে দেবেন।
২. ক্ষতিপূরণ :
উজির সুজা-উদ-দৌলাকে তার রাজ্য অযােধ্যা ফিরিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে নবাব সুজা-উদ-দৌলা কোম্পানিকে ৫০ লক্ষ টাকা যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ দিবেন।
৩. কোরা ও এলাহাবাদ কোম্পানিকে প্রদান :
এছাড়া নবাব ইংরেজ কোম্পানিকে কোরা ও এলাহাবাদ অঞ্চল ছেড়ে দিবেন।
৪. বলবন্ত সিংহকে জমিদারি ফেরত দান :
বেনারসের রাজা বলবন্ত সিংহকে নবাব তার জমিদারি ফিরিয়ে দিবেন।
৫. সামরিক মিত্রতা :
অয্যেধ্যার নবাবের সঙ্গে কোম্পানির একটি সামরিক মিত্রতা স্থাপিত হয়। তা এ শর্তে স্থির হয় যে, অযোধ্যার উপর কোনো শক্রুর আক্রমণ হলে (মারাঠা এবং আফগান) ইংরেজ সেনা তার সাহায্যের জন্য পাঠানো হবে। তবে এজন্য যে অর্থ ব্যয় হবে নবাব তা নির্বাহ করবেন।
১৭৬৫ সালের এলাহাবাদের দ্বিতীয় সন্ধি :
এলাহাবাদের প্রথম সন্ধির পর ১৭৬৫ সালের আগস্ট মাসে লর্ড ক্লাইভ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সাথে দ্বিতীয় এলাহাবাদের সন্ধি স্বাক্ষর করেন।
১৭৬৫ সালের এলাহাবেদের দ্বিতীয় সন্ধির ধারাসমূহ :
১. সম্রাটের মর্যাদা অক্ষুন্ন :
এলাহাবাদের দ্বিতীয় সন্ধির দ্বারা সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের মর্যাদা ও ক্ষমতা কোম্পানি স্বীকার করে নেয়।
২. কোরা ও এলাহাবাদ সম্রাটকে প্রদান :
অযােধ্যার নবাবের নিকট থেকে পাওয়া কোরা ও এলাহাবাদ প্রদেশ কোম্পানিকে ছেড়ে দেন।
৩. বাংলার দেওয়ানি কোম্পানিকে প্রদান :
বিনিময়ে সম্রাট কোম্পানিকে বাংলা-বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি তথা রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা স্থায়ীভাবে ছেড়ে দেন।
৪. বাদশাহ ও নবাবের হিস্যা :
এজন্য কোম্পানি সম্রাটকে বছরে ২৬ লক্ষ টাকা এবং বাংলার নবাবকে নিজামতের খরচার জন্য ৫৩ লক্ষ টাকা দিতে রাজি হয়।
৫. সম্রাটকে সাহায্যের আশ্বাস :
উপরন্তু কোম্পানি সম্রাটকে সাহায্য প্রদানের আশ্বাস দেয়।
বাংলায় কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠায় ১৭৬৫ সালের এলাহাবাদ সন্ধির গুরুত্ব আলোচনা কর
বাংলায় কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষত্রে ১৭৬৫ সালের এলাহাবাদের সন্ধির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলাে
১. বাংলায় কোম্পানির বৈধ অধিকার প্রতিষ্ঠা :
বল প্রয়োগের পরিবর্তে কৌশলে এলাহাবাদের চুক্তির মাধ্যমে কোম্পানি মুঘল সম্রাটের ফরমান লাভ করেন। বাংলায় কোম্পানির defacto ক্ষমতা dejure বা বৈধ ক্ষমতায় পরিণত হয়। এর ফলে বাংলায় কোম্পানির ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার তৃতীয় পর্ব সমাপ্ত হয়।
২. বাংলায় কোম্পানির পূর্ণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা :
এলাহাবাদ চুক্তির মাধ্যমে কোাম্পানি বাংলার দেওয়ানি লাভ করার ফলে বাংলায় কোম্পানি তথা ব্রিটিশের পূর্ণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। মীর জাফরের পুত্র নজমুদ্দৌলাকে নামে মাত্র সিংহাসনে রেখে কোম্পানিই সকল ক্ষমতা অধিকার করে। P. J. Marshall-এ ব্যবস্থাকে Sub-imperialism নামে অভিহিত করেন।
৩. সমগ্র বাংলার রাজস্ব লাভ :
এতদিন কোম্পানি মীর জাফর ও মীর কাসিমের সাথে চক্তিবলে বর্ধমান,মেদিনীপুর, চট্টগ্রাম ও ২৪ পরগনার রাজস্ব ভােগ করতো। এলাহাবাদ চুক্তির পর তারা গোটা বাংলা সুবা তথা বাংলা,বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্বের অধিকারী হয়। কারণ নজমুদ্দৌলা দেওয়ানির আগের সন্ধির দ্বারা তার শাসন ক্ষমতা কোম্পানি নির্ধারিত নায়েব সুবাদার রেজা খানের হাতে ছেড় দেন।
৪. দ্বৈতশাসন প্রতিষ্ঠা :
দেওয়ানি লাভের পর ক্লাইভ বাংলায় দ্বৈতশাসন প্রতিষ্ঠা করেন । অর্থাৎ বাংলার রাজস্ব ও সামরিক ক্ষমতা কোম্পানি নিজ হাতে রাখে। পক্ষান্তরে আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্ব নবাবের উপর ছেড়ে দেয়। অর্থ ও ক্ষমতাহীন নবাব আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্ব লাড করায় প্রশাসন ও শৃঙ্খলা দ্রুত ভেঙে পড়ে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, এলাহাবাদ চুক্তি বাংলায় কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠার সর্বশেষ পর্ব ছিল। এ পর্বে সমস্ত নাটক মঞ্চস্থ করেন রবার্ট ক্লাইভ।P.J Marshall ১৭৬৫ সালের দেওয়ানি লাভকে বাংলার মুঘল যুগ ও ব্রিটিশ যুগের Dividing line বলে মনে করেন।